কিসসা চালিশা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
চ-ল্লি-শ বছর!
চারটি দশক।
৩৬৫কে ৪০ দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যাটা বের হবে, ততগুলো দিন!
নাহ্, আর নিতে পারা যাচ্ছে না, মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের সময়ও তো পেরিয়ে গেল, এখন তো কেবল মাঝির ডাকের অপেক্ষা।
চল্লিশ বছর মানে জীবনের তিনভাগের মধ্যে দুই ভাগ ফিনিশ।নাকি তার চেয়েও বেশি? এ দুনিয়ায় অনেক কৃতী, যশস্বী মানুষ চল্লিশের মুখ দেখার আগেই গত হয়েছেন।আমার মনে হয়, এঁরা ভগবানের সবচেয়ে আদরের সন্তান। ‘দোজ হুম গড লাভস, ডাই ইয়ং!’ মান্দালয় জেল থেকে বাসন্তীদেবীকে পাঠানো চিঠিতে সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন।গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণের অব্যবহিত পরে।
আমি ঈশ্বর-ভক্ত, তবু তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারলাম কই? যৌবন সেই কবেই চোরের মতো পা টিপে টিপে পলাতক হয়েছে, শরীর টানছে ওষুধে, মনের অন্দরমহল ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত, কাঁপুনি থামছে না, জগতের কাছে আর কোনও প্রত্যাশা নেই, আমার কাছ থেকে নেই জগতেরও, তবু তো সেই লগি ঠেলেই যাচ্ছি।হাওয়ার বিপরীতে, নাভিঃশ্বাস ওঠার অবস্থা, তীরের দেখা কিছুতেই মিলছে না কেন? যাওয়ার কথা নয় যাদের তারা চোখের সামনে গটগট করে চলে যাচ্ছে, অথচ পুঁটলি বেঁধে, মনে মনে সব্বাইকে বিদায় জানিয়ে যাওয়ারজন্য উন্মুখ হয়ে যে বসে আছে, সে-ই ডাক পায় না কেন? যিনি সকল কাজের কাজি এ তাঁর কেমন বিচার?
‘ও ভাইরে, ওভাই কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়!’
ছিঁচকাঁদুনিতে যখন ভবী ভোলারই নয়, আসুন চল্লিশের মাহাত্ম্যের ওপর কিছুটা দৃকপাত করা যাক।বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণটি হল, আমার ইস্কুলের নাম গুগুল, মাস্টারের নাম উইকিপিডিয়া। ওয়েব-শাসিত নয়া দুনিয়ায় এরাই তো এখন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস!
খুলে বসেই মনে হল মাজাটা টনটন করছে, সংখ্যাতত্ত্বের বিজ্ঞানে পথ ভুলে ঢুকে পড়েছি, চোখের সামনে কেবল ধুতরো ফুল। কার্ডিনাল, অর্ডিনাল, নিউমারাল সিস্টেম, ফ্যাক্টরাইজেশন, ডিভিসার, গ্রিক নিউমারাল, রোমান নিউমারাল, লাতিন প্রেফিক্স, বাইনারি, টার্নারি, অক্টাল, ডুওডেসিমাল, হেক্সাডেসিমাল! পরপর সাজিয়ে দিলে হয়তো পোস্ট-মডার্ন কোনও শিল্পকর্ম হয়ে যেতে পারে, আমার পেটটা কিন্তু গুড়গুড় করে উঠল। রোমান ডেসিমালটি ছাড়া আমি আর কিচ্ছুটি জানি না।
তাতে কী? কবিবরই তো বলে গেছেন, ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’? লাইনটি আওড়ে অজ্ঞানতা জনিত লজ্জাবোধ কিছুটা লাঘব হল, চোট খাওয়া আত্মবিশ্বাসও কয়েক ছটাক ফিরে পেলাম। সত্যই তো জানার কি কোনও শেষ আছে? আপনাকে এই জানার প্রয়াসও কি ফুরোয় কোনও দিন?
অবশেষে ধর্মের প্রাঙ্গণে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, বিশুদ্ধ শীতল বাতাসের মৃদুমন্দ দোলায় শরীর-মন একেবারে জুড়িয়ে গেল।অতএব ধম্মং শরণং গচ্ছামি! চল্লিশ বছর নেহাতই একটা সংখ্যা নয়, তদতিরিক্ত আরও অনেক কিছু।ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম মায় আমাদের হিন্দু ধর্মেও চল্লিশ একটা বিশেষ ব্যাপার।
যেমন হিব্রু বাইবেলে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা চিহ্নিত করতে ‘চল্লিশ দিন’ অথবা ‘চল্লিশ বছরের’ উল্লেখ আছে।
- বন্যার সময় চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত্রি জুড়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়েছিল।
- বন্যার পরে পাহাড়ের চুড়ো দৃশ্যমান হওয়ার জন্য নোয়া চল্লিশ দিন অপেক্ষা করেছিলেন।
- কানানদের হাল-হকিকৎ ভালো করে বুঝে আসার জন্য মোসেজ যে গুপ্তচর বাহিনী পাঠিয়েছিলেন তাদের চল্লিশ দিন সেখানে থাকতে বলা হয়েছিল।
- তাদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডে প্রবেশ করার আগে ইহুদিদের চল্লিশ বছর বাইরে বসে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
- হিব্রু ঐতিহ্যে চল্লিশ বছর একটি প্রজন্মের দ্যোতক। সে জন্যই দেখা যায় অনেক ইহুদি রাজাই টানা চল্লিশ বছর শাসন চালিয়েছেন, তার একটি দিনও বেশি নয়।
- ডেভিডের কাছে পরাজয় স্বীকার করার আগে গলিয়াথ টানা চল্লিশ দিন দু’বেলা করে ইহুদিদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
- সিনাই পর্বতের চূড়োয় মোসেজ একবার টানা ১২০ দিন কাটিয়েছিলেন। এই পর্বটি ছিল তিন ভাগে বিভক্ত, প্রতিটির মেয়াদ চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত।
- খ্রিস্টানদের বাইবেলে যীশুর সঙ্গে চল্লিশ সংখ্যাটির গাঁটছড়া দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ব্যাপ্টিজিমের পর টেম্পটেশন পর্বে টানা চল্লিশ দিন মরুভূমিতে বসে অনশন করেছিলেন যীশুখ্রিস্ট। এই সময়ে শয়তান এসে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার তাঁকে নানা ভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করত, যীশুকে টলানো যায়নি।
- আধুনিক খ্রিস্টধর্মে ইস্টারের অব্যবহিত আগের পর্বটিকে বলা হয় ‘লেন্ট’। এর সময়কালও ওই চল্লিশ দিন।
- ইসলাম বলছে পয়গম্বর যখন দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের দর্শন পেয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ঠিক চল্লিশ।
- হিন্দুধর্মে অনেক পরিচিত প্রার্থনায় চল্লিশটি স্তবক অথবা দোহা দেখতে পাওয়া যায়। সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ ‘হনুমান চালিশা’।
- সাবরীমালা মন্দিরে প্রবেশের আগে ভক্তদের উপবাস করতে হয় চল্লিশ দিন।
- শিখেদের গুরুগ্রন্থের পঞ্চম ও শেষ পর্বটি হল আনন্দ সাহিব। এতে আছে চল্লিশটি অনুচ্ছেদ। প্রার্থনার শেষে চল্লিশতম অনুচ্ছেদ-পাঠ অবশ্যকর্তব্য।
চল্লিশের গেরোয় আটকা পড়ে থাকে অনেক মানুষের সংস্কারও।যেমন রাশিয়ান, বুলগেরিয়ান ও সার্বদের অনেকে বিশ্বাস করে কোনও মানুষের মৃত্যু হলে তার প্রেতাত্মা মৃত্যুর জায়গাটির চারপাশে চল্লিশ দিন ধরে ঘোরাফেরা করে।ফলে চল্লিশ দিন বাদে সেখানে আবার পুজোপাঠের ব্যবস্থা হয় যাতে অতৃপ্ত আত্মা নিরাপদে ভগবানের আশ্রয়ে চলে যেতে পারে।
বাহিনীর সংখ্যা হিসেবেও চল্লিশ বেশ জনপ্রিয়। আলিবাবার সঙ্গী চোরের সংখ্যা ছিল চল্লিশ।ঠিক তেমনি শিখগুরু গোবিন্দ সিংয়ের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন চল্লিশ জন শিষ্য, যাদের বলা হয় ‘চালি মুক্তে’।
আরও আছে, নানা জায়গায় নানা ব্যবহারে। বয়স ধরে রাখার উদ্বেগ যাদের সবচেয়ে বেশি তারা নির্বিকার গলায় বলে থাকে, ‘লাইফ বিগিনস অ্যাট ফর্টি।’
ঝপ করে একপ্রস্থ ঘুমিয়ে নেওয়াকে বলে ‘ফর্টি উইংকস’। বুলেটের ক্যালিবার, সেখানেও ফর্টি বেশ জনপ্রিয়। সন্তান গর্ভে থাকার চালু মেয়াদ চল্লিশ সপ্তাহ। আরবি প্রবাদ অনুসারে কোনও মানুষকে যদি ভালো করে জানতে চাও, তার সঙ্গে অন্তত চল্লিশ দিন কাটাতেই হবে। এই যে করোনা অতিমারির কারণে ‘কোয়ারিন্টিন’ শব্দটি প্রায় বাংলা অভিধানে ঢুকে যাওয়ার জোগাড় তার উৎসে আছে ইতালির ভেনিসের একটি শব্দবন্ধ। Quaranta Gironi। মানে হল সেই চল্লিশ দিন। ব্ল্যাক ডেথের মহামাহারিতে ইউরোপ যখন ছারখার হয়ে যাচ্ছে ইতালিতে চালু হয় একটি অনুশাসন। বাইরে থেকে কোনও জাহাজ সে দেশের কোথাও নোংর করলে যাত্রীদের টানা চোদ্দদিন নীচে নামতে দেওয়া হত না। তাদের জাহাজের অন্দরে বসেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হত।
অতএব, কালীদা, যেখানেই তাকাও চল্লিশের হাতছানি দেখতে পাবেই। অনেকটা সেই কবিতার পঙক্তির মতো, ‘যেখানেই কেন নোংর করো না, বাতাস তবুও ডাকবে/ তরী ছেড়ে যদি তরু হও তবু ভিজে হাওয়া গায়ে লাগবে।’
এই যে এতক্ষণ ধরে আপনাদের চালিশার নানা কিসসা শোনালাম তা কিন্তু মোটেই আমার খামখেয়ালিপনা নয়। এর একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গও আছে। আজ রাত পোহালে আমি আমার সাংবাদিক জীবনের চল্লিশতম বছরটি পূর্ণ করব। চাট্টিখানি কথা নয়, কী বলেন?
এই যে এতক্ষণ ধরে আপনাদের চালিশার নানা কিসসা শোনালাম তা কিন্তু মোটেই আমার খামখেয়ালিপনা নয়। এর একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গও আছে। আজ রাত পোহালে আমি আমার সাংবাদিক জীবনের চল্লিশতম বছরটি পূর্ণ করব। চাট্টিখানি কথা নয়, কী বলেন?