নিজস্ব প্রতিবেদন: জোখাং মন্দির। তিব্বতি বৌদ্ধদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মস্থান। রোদ ঝলমলে এক সকালে মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রধান সন্ন্যাসী লাকপা জানালেন, দলাই লামা নন, তাঁদের আধ্যাত্মিক গুরু জাই জিনপিং। চিনের প্রেসিডেন্ট তথা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। মন্দির চত্বরে শ্রোতার ভূমিকায় তখন তিব্বত সফরে যাওয়া একদল আন্তর্জাতিক সাংবাদিক।
সব কিছুতেই ঢাকঢাক গুড়গুড় আর লুকোচুরি বেজিংয়ের মজ্জাগত। সংবাদমাধ্যমের ওপরেও প্রশাসনের কড়া নজরদারি। এক কথায়, চিনের সম্পর্কে সচরাচর ততটুকু খবরই বিশ্বের দরবারে পৌঁছয়, যতটা বেজিং চায়। এ হেন চিন সরকার সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের জন্য তিব্বতে একটি সফরের আয়োজন করেছিল। উদ্দেশ্য, কমিউনিস্ট পার্টির ৭০ বছরের শাসনে ওই অঞ্চলে ‘সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন’-এর চেহারাটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা। বলা বাহুল্য, সফরের প্রতিটি ধাপ ছিল পূর্বনির্ধারিত। প্রতি পদক্ষেপে সংবাদিকদের চলতে হয়েছে আগে থেকে মাপজোক করে নির্দিষ্ট হয়ে থাকা পথে। গন্তব্য তালিকায় ছিল মঠ, মন্দির, স্কুল, দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প এবং কিছু কিছু পর্যটনকেন্দ্র।
সফর শেষে একটা বিষয় পরিষ্কার। পায়ের নীচের মাটি শক্ত করতে ক্রমশই ধর্মের আঙিনায় ঢুকে পড়ছে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি। অনুগামী নাগরিক তৈরির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বিশ্বাসের এক নতুন ঘরানা। গত এক দশকের শাসনকালে চিনা জনজীবনের সমস্ত প্রেক্ষিতেই নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চেয়েছেন জাই। কেন্দ্র থেকে উপান্ত―বিরাট দেশের সর্বত্র। ব্যতিক্রম নয় ধর্মবিশ্বাস। বিশেষ করে তিব্বতের ‘চৈনিকীকরণে’ তা অন্যতম হাতিয়ার। তিব্বতিদের তিনটি জিনিস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং দলাই লামার প্রতি আনুগত্য।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের যে ভাবে তিব্বত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাতে বেজিংয়ের আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তিব্বত নিয়ে বিশ্ব-জনমত ক্রমশ তাদের দিকে ঝুঁকছে। তিব্বতের অধিকারের সপক্ষে যাঁরা, তাঁরা অবশ্য অভিযোগ করছেন, বিনা কারণে ধরপাকড়, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, দম বন্ধ করা নিরাপত্তা আর সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতির মূল ধারায় যোগ দেওয়ার জন্য চাপ একই ভাবে বজায় রেখেছে চিন। বাইরের অতিথিদের সামনে সেই পর্দা ফাঁস হওয়ার কোনও সুযোগ স্বাভাবিক ভাবেই ছিল না। বরং লাসার কাছে মডেল গ্রাম বাজিতে সাবেকি পোশাকে সাজা বাসিন্দারা সাংবাদিকদের বলেছেন, কী ভাবে জাই সরকারের দারিদ্র দূরীকরণ অভিযান তাঁদের জীবনটাই বদলে দিয়েছে। ২০১৯ সালে চিন সরকারের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, ‘ঝকঝকে, আনকোরা এক সমাজবাদী তিব্বতের জন্ম হয়েছে।’ বাজি গ্রামের এক বছর পঁচিশের যুবকের মূল্যায়ন, সময় বদলেছে, তাই এখন আর ধর্মবিশ্বাসের আধ্যাত্মিক অবলম্বন জীবনে অপরিহার্য নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মের মাধ্যমে তিব্বতিদের নিয়ন্ত্রণ একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল। বহুদিন ধরে একটু একটু করে একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে জাই সরকার। যার মূল লক্ষ্য ১৯৫৯ সাল থেকে নির্বাসনে থাকা দলাই লামার প্রতিপত্তিতে ফাটল ধরানো এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য তৈরি। নরমে গরমে তিব্বতিদের ক্রমশ চৈনিকীকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়া এখনও জারি। তিব্বতের ঘরে ঘরে, স্কুল-কলেজ-অফিসে, এমনকী মন্দিরের দেওয়ালেও এখন জাই জিনপিংয়ের ছবি। ঠিক এক সময় যেমন দলাই লামার ছবি থাকত। একেবারে ছোট থেকেই তিব্বতিদের মনে জাই এবং তাঁর দলের প্রতি আনুগত্য গেঁথে দিতে চেষ্টার কোনও কসুর করছে না বেজিং। নির্বাসনে থাকা স্বঘোষিত সরকারের সঙ্গে টক্কর দিতে তিব্বত জুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যার উদ্দেশ্য তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের একটা ‘ঘরোয়া সংস্করণ’ তৈরি করা। অর্থাৎ, কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের ধাঁচায় ধর্মের মূল ভাবনাগুলোকে ঢেলে সাজা।
লাসার কাছে তৈরি হয়েছে টিবেটান বুদ্ধিস্ট কলেজ। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি, আইন, কম্পিউটার সায়েন্স, চিনা ও তিব্বতি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছে ৯০০-র ওপর পড়ুয়া। তার মধ্যে রয়েছে সাত থেকে এগারো বছর বয়সী আট জন ভিক্ষু, যারা অবতার বা ‘জীবন্ত বুদ্ধ’ বলে স্বীকৃত। ক্লাসের দেওয়ালে জাইয়ের ছবির পাশে চিনের তিব্বত দখলের চক আর্ট। রাখঢাক না করেই কলেজের দণ্ডমুণ্ডের এক কর্তা স্বীকার করে নিয়েছেন, ধর্মীয় বিষয় আশয়ের চেয়ে দলীয় নেতৃত্বের কথারই এখানে গুরুত্ব বেশি।
একদিকে একেবারে ভিতর থেকে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মকে বদলে দিতে চাইছে চিন। সমান্তরালে চলছে দলাই লামাকে নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি। পরম্পরা অনুযায়ী তিব্বতিদের সর্বোচ্চ জাতীয় নেতা হিসেবে যে মর্যাদার তিনি অধিকারী, তার মূলে আঘাত করতে চাইছে চিন। বহু বছর ধরেই নিষিদ্ধ তাঁর ছবি, ছাপার অক্ষরে বা টিভির পর্দায় তাঁর উল্লেখ। গ্রামে গ্রামে, এমনকী মঠের ভিতরেও রয়েছে নজরদারি। একদিকে দলাইয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনার পাশাপাশি তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পাঞ্চেন লামাকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে, যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে দলাই লামার কোনও গুরুত্বই না থাকে।
কিন্তু এই মুহূর্তে তার চেয়েও বড় সর্বোচ্চ পদের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। ছিয়াশি পূর্ণ করতে চলেছেন বর্তমান দলাই লামা। তাঁর পর ওই পদে কে বসবেন, ঐতিহ্য অনুযায়ী তা ঠিক করেন মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসীরা। কিন্তু বেজিং ইতিমধ্যেই দাবি করেছে, সরকার অনুমোদিত প্রার্থীদের মধ্যে থেকেই পরবর্তী দলাই লামাকে বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ, বর্তমান দলাই লামার ক্ষেত্রে না পারলেও অন্তত তাঁর উত্তরসূরিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পুরো প্রস্তুতি সেরে রাখছে চিন।