26 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

চোঙা প্যান্ট? গেট আউট

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

ছেলেবেলায় আমাদের যে অনেক নতুন জামা-কাপড়ের প্রাপ্তিযোগ হতো মোটেই তা নয়। আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনযাপন, তদোপরি গৃহকর্তা টু-পাইস ফাদার-মাদার, সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং-এ বিশ্বাসী। এতটাই সিম্পল যে হাড়-কৃপণ বললেও অত্যুক্তি হবে না। যৎসামান্য খরচে একটা শার্ট আর একটা হাফ-প্যান্ট। তাও আবার রেডিমেড নয়, কাপড় কিনে দর্জির কাছে মাপ দিয়ে বানানো। এই ঝক্কিটুকু পোহাতে হতো মাকে।

আমি জীবনে প্রথম ফুল-প্যান্ট পরি ক্লাস ইলেভেনে উঠে, তাও আবার ইস্কুলের নিয়মানুসারে খাকি রঙা। এইচএমটি কোম্পানির একটি হাতঘড়ি উপহার পাই কলেজে প্রবেশের পরে। কলকাতা পুলিশের সাবেক কনস্টেবলকুল যে ধরনের হাফ প্যান্ট পরতেন, আমারগুলোও ছিল এক্কেবারে সেই রকম। কোমর থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, এতটাই ঢলঢলে যে আমার শীর্ণ-পদযুগল ওই মস্ত বড় খোলের মধ্যে প্রায় অদৃশ্যই থাকত। বন্ধুবান্ধবদের কেউ এমন কনস্টেবলি হাফপ্যান্ট পড়ত না, তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হতো সাক্ষাৎ ক্যালানে মদন। দু-চার জন সুযোগ বুঝে প্যাঁকও দিত। অসহায় আমি বিনা প্রতিবাদে তা হজম করতাম। কার আদেশ শিরোধার্য করতে গিয়ে আমার এমন অবর্ণনীয় দুর্দশা সেটা তো আর জনসমক্ষে কবুল করার কোনও প্রশ্ন ছিল না। আমি রাগে ফুঁসতাম আর মনে মনে হিসেব করতাম বাপের হোটেলে নিখরচার আবাসিক থাকার দিন ফুরোবে কবে, কবেই বা আমি অন্যের পছন্দ-অপছন্দের শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারব।

দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম একবারই। তার পরিণতি এতটাই মর্মান্তিক হয়েছিল যে আজ এত বছর পরেও সে কথা মনে পড়লে কেমন যেন একটা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা হয়। সেই আমার অভাগিনী মায়ের জন্য।
আমরা তখন ঝাড়গ্রামে থাকি। সেভেন না এইট, কোন ক্লাসে তা আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে কোনও একটা কারণে সেবার পুজোর ছুটিতে আমাদের ঠাকুর্দার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। ঝাড়গ্রামেই রয়েছি। বাড়ি থেকে দর্জির দোকানে যাওয়ার পথে করুণ মুখে বারবারে মাকে অনুরোধ করলাম এবারের হাফ প্যান্টটা আড়ে-বহরে যেন একটু ছোট হয়, না হলে বন্ধুদের কাছে আর ইজ্জতই থাকে না। আমার লাগাতার পীড়াপীড়িতে কাজ হল, দর্জিকে আমি আদেশ দেওয়ার সময় মা কোনও বাধা দিলেন না, নিরুত্তর রইলেন। আমি ধরে নিলাম মৌনং সম্মতি লক্ষ্মণং।

দিন সাতেক পরে সেই হাফপ্যান্ট নিয়ে মা বাড়িতে ঢুকলেন সন্ধ্যা নামার অনেক পরে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় বলে প্রথমেই বাবার নজর পড়ল আমার ওই সাধের পরিধেয়টির ওপর। তারপরেই শুরু হয়ে গেল গগন-বিদারি চিৎকার, রাতের নৈঃশব্দ খানখান করে। গোটা দোষটা গিয়ে পড়ল মায়ের ওপর, কেন তিনি ছেলেকে চালিয়াত তৈরি করতে চোঙা প্যান্ট বানিয়ে এনেছেন। এমন অসভ্যতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো দুঃসাহসই বা মায়ের হল কী করে। মা জবাবে একটি কথাও বললেন না, আমার হাফপ্যান্টটা বগলদাবা করে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। ফিরলেন ঘণ্টা দুয়েক পরে, নিঝুম রাতে। মায়ের হেনস্থা দেখে বুক ফেটে যাচ্ছিল আমার, সম্ভবত দিদিরও, তবু বাবার কথার প্রতিবাদ করার সাহসটুকু তখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি আমরা। সেটা পেরেছি আরও বছর কয়েক বাদে।

সেদিন রাতে মায়ের মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করানো গেল না। পরে আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হলে মা জানালেন, তিনি প্রথমে গিয়েছিলেন দর্জির দোকানে। সেখানে তালা ঝুলছে দেখে, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে বের করেন দর্জির আস্তানা। হতভম্ব দর্জিকে বলে আসেন প্রয়োজনে ভিতরে অন্য কাপড় লাগিয়ে প্যান্টটা আড়ে-বহরে বড় করতে হবে। হয়েও ছিল তাই।

হয়নি শুধু একটি কাজ। ওই হাফপ্যান্ট আমি আর ছুঁয়েই দেখিনি। ওইটুকুই ছিল আমার কৈশোরের গান্ধীগিরি।

(ছবি প্রতীকী)

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article