শুভেন্দু দেবনাথ
“দেখছি শহর তলিয়ে যাচ্ছে
নোংরা আমায় ভয় দেখাচ্ছে
সগ্রি এঁটোর পাহাড় হচ্ছে কলকাতা
পেচ্ছাপেই শহর ভাসছে
ডিজেল ধোঁয়ায় মানুষ কাশছে
যক্ষ্মা আমায় ভয় দেখাচ্ছে কলকাতা
ধাপার মাঠের গন্ধ নিয়ে
চলছি তোমার রাস্তা দিয়ে
নর্দমাতে সাঁতার দিচ্ছে কলকাতা”
বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে এই বাউন্ডুলে জীবন কাটানো কম দিন তো হল না। এই চল্লিশেও সেই বাউন্ডুলেপনার বিরাম নেই। ১৯-২০বার বাড়ি থেকে পালানোর জীবনে কম দেখা আর ঘোরা তো হল না। ক্লাস এইটে অঙ্ক পরীক্ষায় ফেল করে পালিয়ে জেলে-মাঝিদের নৌকোয় ইলিশ ধরা থেকে ভিমবেটকা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া হয়ে আন্দামান, কন্যাকুমারী আর বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে থেকেই জীবন কেটে গেছে। মানুষ দেখার পাগলামি আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
মানুষও তো কম দেখলাম না জীবনে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রতিবারই মানুষ আমাকে অবাক করেছে। এই করোনাকালে যখন কাজ করতে নামলাম, সত্যি বলতে কী মানুষের ব্যবহারে বারবার মনে হচ্ছিল কী দরকার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর। বারবার অপমানিত হতে হতে আমরা যারা কাজ করতে নেমেছিলাম তাদের আত্মবিশ্বাসও তলানিতে এসে ঠেকেছিল। রোজ রাতে মনে হত, কালই শেষ, আর নয়, অনেক হয়েছে। কিন্তু এই করতে করতেই এপ্রিল মাস কেটে গিয়ে ক্রমে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহও কেটে গেল। আমার অভিমান অথবা রাগ নিজের জায়গায় রয়ে গেল আর কাজ চলতে লাগল নিজের মতোই।
সারা কলকাতা জুড়ে কাজ করলেও লোকবল কম থাকায় উত্তর কলকাতা আর দমদমকেই আমরা প্রাধান্য বেশি দিয়েছিলাম। সেই সময়ই আমার পাশের পাড়া অর্থাৎ দমদম প্রাইভেট রোডের এক বাড়িতে আমাদের ছুটে যেতে হয় একদিন রাত ১০টা নাগাদ। স্বামী-স্ত্রী এবং মেয়ে, তিন জনের এক নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। ২১-২২ বছরের মেয়েটি খানিক মানসিক ভারসাম্যহীন। প্রৌঢ় স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কোভিড পজিটিভ। ভদ্রমহিলার অবস্থা উদ্বেগজনক, হাসপাতালে যাবেন না তিনি। অতএব বাড়িতেই তার চিকিৎসা শুরু হয়। অক্সিজেন সিলিন্ডার-সহ বাড়িতেই সব ব্যবস্থা করি আমি। শুধু ভদ্রলোকটি রান্না করতে না পারায়, আমিই খাবার দিয়ে আসি দু’বেলা। এবং দু’বেলাই ভদ্রমহিলাকে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গা-হাত-পা স্পঞ্জ করে দেওয়া আমার ঘাড়ে এসেই বর্তায়।
পুরো দমদম রোড এলাকায় পরিবারটির কৃপণ হিসেবে যথেষ্ট সুনাম। এই বাজারেও দুর্গাপুজোর চাঁদা হিসেবে তারা মাত্র ১০০ টাকাই দিয়ে থাকেন। অথচ অবস্থা যথেষ্ট স্বচ্ছল। গাড়ি, ফ্ল্যাট সবই আছে তাদের। দিন তিনেক ধরে দু’বেলাই ভদ্রমহিলার সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাই। এর মধ্যেই একদিন ১২ মে রাত ১০টা নাগাদ খাওয়াতে যাই। খাওয়াতে খাওয়াতেই ফোন আসে। ওয়েস্ট বেঙ্গল কোভিড এইড নেটওয়ার্ক বা সংক্ষেপে ডব্লিউবিক্যান নামে আমাদের হোয়াটঅ্যাপ রেসকিউ গ্রুপে আমার টিমের একটি মেয়ের বাড়িতে খুব বিপদ। মেয়েটির বাড়ি ইছাপুরে। মেয়েটাকে বাদ দিলে তার বাড়িতে চার জনেরই কোভিড হয়েছে। মেয়েটির পিসির অবস্থা ক্রিটিকাল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭৪। যত দ্রুত সম্ভব ভর্তি করতে হবে হাসপাতালে। আমাদের গ্রুপের ছেলে-মেয়েরাই দৌড়ঝাঁপ করে নৈহাটি সরকারি হাসপাতালে বেড জোগাড় করে। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে যাওয়ার কেউ নেই। খানিকটা ভয়ই পেয়ে যাই কথা বলতে বলতে। কী ভাবে সম্ভব! গ্রুপের প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে পুরো পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে, সঙ্গে যাবে কে?
“মেনে নিয়ে নিয়ে দিনগুলো গেলো মেনে নিতে
সঞ্চয়গুলো গুনে গুনে বেঁধে নিতে
গেঁথে নিতে শুধু কৃপণের বরষিতে এঁদো পুকুরের পুটিঁমাছ
ধান নিয়ে গেলো বম্বেটে বর্গিতে,
গানে গানে বুলবুলিটাকে দোষ দিতে
ফিরলে না তুমি কোনদিন সম্বিতে নিভে গেলো উনুনের আঁচ”
খাওয়াতে খাওয়াতেই খেয়াল হয় ভদ্রমহিলা খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছেন। যতবার ফোন আসছে জিজ্ঞাসা করছেন ‘বাবা মেয়েটির কিছু ব্যবস্থা করতে পারলে? টাকা পয়সার অভাব মেয়েটির?’ তাঁকে অভয় দিই ব্যবস্থা হবে, চিন্তা করবেন না। এর মধ্যেই আমাদের গ্রুপের একটি ছেলেই সব ব্যবস্থা করে দেয়।
ভদ্রমহিলার খাওয়াও প্রায় শেষ। মুখ ধুইয়ে মুছিয়ে দিচ্ছি, হঠাৎই ভদ্রমহিলা বলে ওঠেন, তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো। গলার স্বরে কী যেন একটা ছিল তাঁর। তিনি আবারও বলেন, তোমরা যা করছো তা হয়তো আমার নিজের ছেলে থাকলেও করত না। আমি তোমাকে ভালোবেসে কিছু দিতে চাই। তাঁকে হেসে প্রায় উড়িয়ে দিয়ে বলি, মাসিমা, কিছু পাওয়ার জন্য এসব করছি না আমরা। আমাকে কিছু দিতে হবে না। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন তাহলেই হবে।
আমার হাত চেপে ধরেন ভদ্রমহিলা। আমার মেয়েটাকে তো দেখছই। ওর যা অবস্থা, তাতে কোনওদিন বিয়ে হবে কি না কে জানে। থমকাই, কে জানে আমাকে আবার জামাই করার কথা ভাবছেন না তো? ঘরে ইতিমধ্যেই একটা বাচ্চা এবং বউ আছে আমার। এর আগে চম্বলেও মান সিংয়ের নাতি প্রায় ঘর জামাই করে ফেলেছিল আমাকে! ভদ্রমহিলা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে যান। বলেন, না না তোমাকে বিয়ের কথা বলছি না। আসলে মেয়ের বিয়ে দেব বলে কিছু গয়না বানিয়ে রেখেছি। আমার তো ছেলে নেই কোনও। একটা সোনার হার গড়িয়েছিলাম জামাইয়ের জন্য, আমি তোমাকে সেটা দিতে চাই।
চমকে তাকাই মহিলার মুখের দিকে। একটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। যে পরিবারটির সারা এলাকায় শুধু কৃপণ নয়, হাড় কৃপণ বলে বদনাম, তিনি আমাকে একটা দামি সোনার হার উপহার দিতে চান। অদ্ভুত একটা বিষন্নতা আমাকে স্থবির করে দেয়। ‘নেবে না’? ভদ্রমহিলার কথায় সম্বিত ফেরে। তাঁকে বলি, আমার এসব কিছুই চাই না মাসিমা। আমি তো গয়নাগাটি পরি না। বরং আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। দু’বছর ধরে তো মায়ের কাছে যাইনি। ফলে সুক্তোও খাওয়া হয়নি। আপনি না হয় সুস্থ হয়ে উঠে একদিন আমাকে সুক্তো খাইয়ে দেবেন। কেঁদে ফেলেন ভদ্রমহিলা। আমার মাথায় হাত দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করেন।
রুমাল চেপে নাকে মুখে
বাঁচতে চাইছি কপাল ঠুকে
মৃত্যু আমায় ডাক পাঠাচ্ছে কলকাতা
লরির ধাক্কা বাসের গুঁতো
ভাঙা পথে হাঁটার ছুতো
হাঁটছি তোমার জাহান্নামে কলকাতা
অবাক হওয়ার তখনও বোধকরি অনেক বাকি। ভদ্রমহিলার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। প্রায় ১১টা বাজে, সুনসান রাস্তাঘাট। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাইভেট রোডের মোড়ে আসি। দেখা হয়ে যায় এক পরিচিত ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে। দেখা হলেই তিনি জড়িয়ে ধরেন আমাকে। সেদিনও জড়িয়ে ধরতে গেলে আটকাই। কোভিড রোগী ঘেঁটে আসছি, এখন না জড়ানোই ভালো। হঠাৎ তাঁর নিজের হাতের ব্যাগটা খুলে একটা বোতল বার করেন। আমার হাতে সটান ধরিয়ে দিয়ে বলেন, চাকরি-বাকরি তো লাটে তুলে দিয়ে সমাজসেবা করছিস, রাত নেই দিন নেই ছুটছিস। শরীরও তো একটু বিশ্রাম চায় নাকি। নে ধর এটা রোজ অল্প অল্প করে খাবি। তাকিয়ে দেখি একটা রেডওয়াইনের বোতল। আমাকে অবাক করে বোতলটি হাতে দিয়ে হনহন করে ছাতাকলের দিকে চলে যান তিনি। এই সময়েই আমাকে চমকে দিয়ে প্রায় গা ঘেঁষে ব্রেক কষে এক অটোওয়ালা। মুখ বাড়িয়ে অল্পবয়সী ড্রাইভার বলেন, কী মতিঝিল যাবেন তো দাদা?
একেই ঘোর কাটেনি তারপর এই অটোওয়ালা। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি করে জানলে আমি মতিঝিল যাব? অটোওয়ালা বলে রোজই তো দেখছি দাদা তোমরা দৌড়চ্ছো। ফোনে কথা বলার সময় বুঝতে পারছি। চলো পৌঁছে দিই। তাকে বলি, না না এই তো সামনেই হেঁটে চলে যাব। সে নাছোড়, নিয়ে সে আমাকে যাবেই। অগত্যা বসি অটোতে। মতিঝিল গেটে নেমে পয়সা দিতে যাই, অটোওয়ালা হেসে বলে, দাদা গাড়ি চালাই বলে কী আমরা মানুষ নই? যখনই দরকার পড়বে যত রাতই হোক, ফোন করবে বা স্ট্যান্ডে চলে আসবে, পৌঁছে দেব। টাকা লাগবে না। রেখে দাও তোমাদের অনেক কাজে লাগবে এখন টাকা পয়সা। আমরাও আছি তোমাদের দলে। বলেই পিকআপ বাড়িয়ে চোখের নিমেষে চলে যায় নাগেরবাজারের উদ্দেশ্যে।
চোখ চিকচিক করে ওঠে। এই ক’দিনে তো কম অভিজ্ঞতা হলো না। রোজই যেন জীবনটাকে নতুন নতুন করে চিনছি। কত যে রূপ চোখের সামনে মুহূর্মূহূ বদলে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সব আশা শেষ হয়ে যায়নি তাহলে।
“সমাজসেবী নাকি প্রফেশনাল ভাঁড়
হটাৎ ট্রাফিক আটকে দেয়া
রাজার মত ষাঁড়
তিন শতকের শহর আস্ত গোলকধাঁধা
এখানে পড়েছি আমি সাতটি পাকে বাঁধা
তিন শতকের শহর আস্ত গোলকধাঁধা
এখানে পড়েছি আমি আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা”।