‘আমরাও আর সে জাতি নই’
সুমন চট্টোপাধ্যায়
নেতাজির জন্মদিন থেকে শুরু হয়েছে, তারপর আর থামছে না। মাইকে তারস্বরে দেশপ্রেমের গান। বাংলা গানের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কখনও লতা কখনও মহম্মদ রফি সাহেবও ঢুকে পড়ছেন।
‘যো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি যারা ইয়াদ কর কুর্বানি।’ কিংবা ‘ফির কব আওগি…’।
সত্যি বলতে কি আমার মন্দ লাগে না, বলিউডি হুক্কাহুয়ার চেয়ে তো ঢের ভালো। কেবল যদি লাউডস্পিকারের ভল্যুমটা একটু কম হতো!
জানি হবে না, অনুরোধ করা মানে ভষ্মে ঘি ঢালা।
বরং হিতে বিপরীত হতে পারে, চারটে খিস্তিও খেয়ে যেতে পারি।
এ এমন দিন যখন চোখ-কান-বিবেক সব ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে গায়ের জ্বালা সহ্য করাটাই দস্তুর, সেটাই বুদ্ধিমত্তা, সেটাই আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়। অনেকে বলছে করোনা যে আমাদের দেশে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারল না তার একটা বড় কারণ নাকি ‘হার্ড ইমিউনিটি’। সত্যি, ভেড়ার পালের সঙ্গে আমাদের অত্যাশ্চর্য মিল, রাখাল-বালক দূরে কোথাও লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, এই সম্ভাবনাটুকুই আমাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
এমন একটা সময়ে রবি ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল, মুকুন্দ দাসের স্বদেশ-গানের কলি কানে এসে পৌঁছলে, কেন জানি না, আমার ভীরু বক্ষপুটে দুরু-দুরু আওয়াজ শুরু হয়ে যায়, স্বর্গভ্রষ্ট হওয়ার মোচড় দেওয়া বেদনা মনটাকে বিবশ করে তোলে, গৌরবের ইতিহাসের উত্তরাধিকারী বলার যোগ্যতা আমরা যে খুইয়ে ফলেছি, সেই অপরাধবোধ বিষবৎ গ্লানির দলার মতো খাদ্যনালীতে আটকে থাকে। নতুন করে মর্মোদ্ধার করতে পারি পুরোনো হাহুতাশের- গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা, কাবেরী, যমুনা ওই/ বহিয়া চলেছে আগের মতো, কইরে আগের মানুষ কই?’
কিংবা,’ আছে আকাশ সে ইন্দ্র নাই, কৈলাসে যোগীন্দ্র নাই/ নাই তার কোলে সেই ধ্যানী-ঋষি, আমরাও আর সে জাতি নই।’ আমরা দেখতে পূর্বজদের মতোই, ব্যস ওইটুকুই।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি স্বদেশি গানের ভক্ত। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সকাল ৬টায় রেডিওতে বেজে ওঠা ‘বন্দে মাতরম, সুজলাং, সুফলাং’ শুনতে শুনতে আমার ঘুম ভাঙত। এত কঠিন সব সংস্কৃত শব্দের অর্থ বোঝার বয়স তখনও হয়নি, তবু মন্ত্রোচ্চারণের শুদ্ধতা-মাখা সুর শিশু মনেও দোলা দিত। সেই অনুরাগ, আসক্তি এই বুড়ো বয়সেও আমার একই রকম আছে, এক ছটাকও কমেনি। পরে বড় হয়ে কলেজে উঠে আঁতেল বন্ধুদের মুখে এই গান আর তার রচয়িতার অনেক নিন্দামন্দ শুনেছি, শুনেছি বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কথা, আমি এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। কলেজকালে একবার বেদম চটে গিয়ে আমার এক বঙ্কিম-সমালোচক বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘বেশি নয়, বঙ্কিমের সমতুল বাংলা গদ্য আগে চারটে লাইন লিখে দেখা, তারপর তোর কথা শুনব মন দিয়ে।’
নিজেদের মনীষীদের ছিদ্রান্বেষণ করে এক শ্রেণির বঙ্গসন্তান রমন-সুখ পেয়ে থাকেন, তাঁদের সেই নৈর্ব্যক্তিক, নির্মোহ বিশ্লেষণটাই নাকি প্রগতির পথ প্রশস্ত করে, বাকি সব ফালতু, পাতে দেওয়ার মতোই নয়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, সময়ের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্কিম তাঁর সম্রাটের আসনে বসে আছেন স্ব-মহিমায় আর তাঁর সমালোচকদের বৈদগ্ধ নিক্ষেপিত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
যতদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছি, আমাদের বাৎসরিক উৎসবে একজন গায়কের নাম বদলানো হোত না, তিনি থাকবেনই। সবিতাব্রত দত্ত।
মাঝারি গড়ন, টকটকে ফর্সা রং, পেটানো চেহারা, শৌখিন মানুষ, ল্যান্সডাউন মার্কেটে বাজার করতেও বের হতেন লুঙ্গির ওপর ঘিয়ে রঙের সিল্কের পাঞ্জাবি চড়িয়ে। চোখ বন্ধ করে তন্ময় হয়ে গাইতেন, গলা এত উঁচুতে তুলতে পারতেন মনে হতো প্রেক্ষাগৃহের ছাদ ফুঁড়ে তা আকাশে পৌঁছে যাচ্ছে। তিনি কন্ঠ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হতো অন্য রকমের পরিবেশ, গোটা হল গমগম করত, কোনও কোনও গানে আমার তো লোমকূপ খাড়া হয়ে উঠত। গানের ভিতর দিয়ে দেশমাতৃকার এমন সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, নাভিতল থেকে উঠে আসা বন্দনা আমি আর কারও গলায় শুনিনি।
উৎসব শেষে সবিতাব্রত চলে যেতেন, কলেজ ক্যান্টিনে থেকে যেত তাঁর গাওয়া গানগুলির রেশ। কোরাসে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গাওয়া হতো দিনের পর দিন। আমাদের সিনিযর অরুণাভ ঘোষের গানের গলাটা ছিল ভারী মিষ্টি, সে সোলো গাইত অনেকগুলো। তার মধ্যে একটা গানের সুর এখনও আমার কানে বাজে—স্বদেশ স্বদেশ করছ কারে, এ দেশ তোদের নয়/ এই যমুনা, গঙ্গা নদী, ইহা তোমার হোত যদি/ পরের পণ্যে গোরা সৈন্যে জাহাজ কেন বয়!
কলেজে পড়তে পড়তেই আমি যাওয়া শুরু করলাম নেতাজি ভবনে। ইতিহাস অনার্স ক্লাসে সুগত বসু আমার এক বছরের সিনিয়র কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে সেই ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে একদিন আমিও বসু পরিবারের সদস্যই হয়ে গেলাম। সুগতদের বাড়ি ‘বসুন্ধরা’ হয়ে উঠল আমার দ্বিতীয় বাসস্থান। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোয় একদিন আমাকে অবৈতনিক কোষাধ্যক্ষের পদে বসানো হল, ছাত্রাবস্থাতেই নেতাজি ভবন হয়ে উঠল আমার কর্মস্থল।
প্রথম যেদিন নেতাজি ভবনে পা দিয়েছিলাম, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ঢুকতেই বাঁদিকে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, তিনটি, তাদের গায়ে লেখা ইত্তেফাক, ইতমাদ, কুর্বানি। একটু এগোলেই সেই ঐতিহাসিক গাড়ি, ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির যেটা চালিয়ে নেতাজিকে গোপনে কলকাতা থেকে গোমো পৌঁছে দিয়েছিলেন। উপরে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, আরও ওপরে নেতাজির শোয়ার ঘর, অন্তর্ধান হওয়ার আগে যেখানে পুলিশের নজরবন্দি অবস্থায় তিনি অন্তর্ধানের গোপন পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর শয্যা ঠিক সে ভাবেই পাতা আছে, ঘরের জিনিসপত্রগুলোর একটিও এখান থেকে ওখান করা হয়নি। এই ঘর থেকে পা টিপে টিপে বাড়ির একেবারে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে তিনি নীচে নেমেছিলেন। সেই চরণ-চিহ্ন মেঝতে খোদাই করে রাখা আছে দর্শনার্থীদের বোঝার জন্য। আজ এত যুগ পরেও চোখ বুজলে সব কিছু ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বসু পরিবার আর নেতাজি ভবনের সৌজন্যে আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজির অনেক সম্মাননীয় সহযোদ্ধাকে খুবই কাছ থেকে দেখার, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। দেখেছি লাল কেল্লার ঐতিহাসিক বিচারের দুই মহারথীকে, যাঁদের হয়ে সওয়াল করতে নেহরু স্বয়ং গায়ে কালো শামলা চড়িয়ে আদালতকক্ষে উপস্থিত হয়েছিলেন- প্রেম সায়গল ও জি এস ধিলোঁ। দেখেছি রানি অব ঝান্সি রেজিমেন্টের সর্বাধিনায়িকা লক্ষ্মী সায়গলকে। বসু বাড়ির খাওয়ার টেবিলে বসে গল্প করেছি সেই আবিদ হাসানের সঙ্গে যিনি নেতাজির দুঃসাহসিক সাবমেরিন যাত্রায় তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন। তাঁদের কাছে শোনা আজাদ হিন্দ বাহিনীর নানা কাহিনি আমার স্মৃতির খাতায় অন্যতম সঞ্চয়।
গান দিয়ে শুরু করেছিলাম, গান দিয়েই শেষ করি। নেতাজি ভবনে যাওয়ার পরেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর রক্তে দোলা দেওয়া সেই গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই, গুনগুন করে গাইতেও শিখি। বাহিনীর সঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল রাম সিং, নেতাজি ভবনে তাঁর গান শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল আমার। তখনই প্রথম জানতে পারি ১৯৫০ সালে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সাত বছর আগে আজাদ হিন্দ ফৌজ এই গানের আদলে ও সুরে হিন্দুস্থানিতে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করেছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন আবিদ আলি। আজাদ হিন্দ ফৌজের অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার পরে সব অনুষ্ঠানে নিয়ম করে গাওয়া হত এই গান। অভিশপ্ত বিমানে ওঠার আগের সভাতেও সুভাষচন্দ্র এই গান শুনে গিয়েছিলেন।
শুভ সুখ চয়নকি বরখা বরষে
ভারত ভাগ হ্যায় জাগা
পাঞ্জাব, সিন্ধ, গুজরাট, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ
চঞ্চল সাগর, বিন্ধ্য, হিমালয়, নীলা যমুনা গঙ্গা
তেরে নিত গুণ গায়ে, তুঝসে জীবন পায়ে
হর তন পায়ে আশা
সূরয বন কর জগ পর চমকে
ভারত নাম সুহাগা
জয় হো, জয় হো, জয় হো, জয় হো…