সুমন চট্টোপাধ্যায়
হোয়াটস অ্যাপ এক মস্ত খুড়োর কল, কে ফোন করছে আপনি দেখতে পারবেন, ডিসপ্লে পিকচারে তার চাঁদ বদনটি আপনাকে পুলকিত করলেও করতে পারে, কোথা থেকে করছে আপনি বুঝতে পারবেননি। শত ব্যস্ততার মধ্যে মার্ক জুকারবার্গ এখনও চাঁদে বা মঙ্গলে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি, নইলে বোধহয় সেখান থেকেও হোয়াটস অ্যাপ কল করা যেত।
ভনিতা থাক। দিন কয়েক আগে সকালের ঘুম ভাঙল এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হোয়াটস অ্যাপ কলে। সে জানে বেশি সকালে ফোন করলে আমি কাঁচা দেব, তবুও করেছে। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, আশঙ্কা হল হয়ত কোনও বিপদ-আপদ হয়েছে। তারপর যে কথোপকথন হল হুবহু তা তুলে দিচ্ছি।
হ্যাঁ বল, এত সকালে কোত্থেকে?
লাস ভেগাস।
যথোপযুক্ত একটি চার-অক্ষর ঠোঁটের গোড়ায় এসে গিয়েছে, হজম করে নিলাম বন্ধুবরের উত্তেজিত গলা শুনে। “ আচ্ছা সুমন’দা এই বঙ্গ সম্মেলনে তুমি আগে বছর-বছর আসতে না? কেন আসতে? কী করতে আসতে? ‘
ঘুম থেকে উঠিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কৈফিয়তের পর কৈফিয়ত তলব। মটকা গরম হয়ে গেল। ‘তাতে তোর বাপের কী রে?’
সে তুমি যত ইচ্ছে গাল দাও, এমন একটা জঘন্য সম্মেলন কী ভাবে তোমাকে আকৃষ্ট করত সেটা জানতেই ফোন করা। তুমি ভাবতে পারবে না ব্যাপারটা কতটা বাজে। চারদিকে অব্যবস্থা, কেউ কারও কথা শোনে না, এটা ভদ্রলোকের ব্যাপারই নয়।
তা হলে তুই এতটা উজিয়ে লাস ভেগাসে মারাতে গেছিস কেন? তোর কী এমন রাজকার্য আছে সেখানে?
আরে অমিত’দা এসেছেন না! আর কিছুক্ষণ পরেই একটা বিজনেস মিট করবেন। সেটা শুরু করে দিয়েই আমি ফুটে যাব। লন্ডনে গিয়ে উইম্বলডন দেখব।
অমিত’দা মানে কোন অমিত’দা? অমিতাভ বচ্চন নাকি?
চ্যাংড়ামি মেরো না, অমিত’দা মানে ডাঃ অমিত মিত্র।
ফোনটা রেখে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম। যে ভদ্রলোক শরীর খারাপের কারণে মাত্র এক বছর আগে বিধানসভা ভোটে লড়লেন না, ছয় মাসের জন্য অর্থমন্ত্রী হয়ে বাড়িতে বসে আগাগোড়া কাজ করে তারপরে হঠাৎ অন্তরালে চলে গেলেন, সেই তিনিই গোলার্ধের অপরপ্রান্তে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন? মার্কিন মুলুক অমিতবাবুর কাছে কোনও ওয়ান্ডারল্যান্ড নয়, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গবেষণা করেছেন, ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন, ইস্ট কোস্ট অথবা ওয়েস্ট কোস্ট তাঁর চষা ক্ষেত। পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই বয়স, লাস ভেগাসের মতো প্রমোদ নগরীর কথা শুনে তাঁর আদৌ উত্তেজিত হওয়ার কথা নয়, তিনি সুরা-রসে বঞ্চিত, ধূমপান করেন না, হোটেলের ক্যাসিনোর মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটে যাবেন, ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবেনও না। ডাঃ অমিত মিত্র তাহলে লাস ভেগাসে কী করছেন?
প্রতি বছর জুলাই মাসের গোড়ায় উত্তর আমেরিকা ও কানাডার কয়েক হাজার বঙ্গসন্তান আড়াই দিন ধরে নিজেদের পুনর্মিলন উৎসব করেন। গান-বাজনা শোনেন, নাটক দেখেন, কলকাতা থেকে শিল্পী, অভিনেতা ও বিবিধ প্রকার কলা-কুশলীকে উড়িয়ে নিয়ে যান। এই মোচ্ছবের মধ্যে একটা বিজনেস সামিট করা অর্থহীন, তবু অনেক বছর ধরে রেওয়াজটা চালু আছে। সে প্রসঙ্গে আসছি পরে।
গোটা রাজ্যের মতো এ রাজ্যের মন্ত্রিসভায় যে বস্তুটির নিদারুণ অভাব, তার নাম মেধা। জ্যোতি বসুর আমল থেকেই মেধার অভাব সরকার পরিচালনার একটা মস্ত বড় রোড-ব্লক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, বর্তমানেও সেই লজ্জার ট্র্যাডিশন চলছে সমানে, সত্যি কথা বলতে গেলে আরও অনেক অবনতিই হয়েছে।বিদেশের মাটিতে সসম্মানে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন, স্বচ্ছন্দে গড়গড় করে ইংরেজি বলবেন এমন একজনকে দূরবীন দিয়েও খুঁজে বের করা কঠিন।দলে অনেকেই আছেন (যেমন সৌগত রায়, মহুয়া মৈত্র, শশী পাঁজা, কাকলি ঘোষ দস্তিদার কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) তাঁরা কেউ সরকারে নেই। অতএব বিদেশে পাঠানোর প্রশ্ন এলে -বিশেষ করে শিল্প-অর্থনীতির সমাবেশে- সবেধন নীলমণি সেই অমিত মিত্র, তা তিনি মন্ত্রী থাকুন আর নাই থাকুন।সুশিক্ষিত, বিনয়ী, আপাদমস্তক সৎ এবং প্রশ্নাতীত ভাবে নেত্রী-অনুগত এই ভদ্রলোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেফেস্ট বেইট’ তা সে অমিতবাবুর কথায় সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মন ভিজুক আর নাই ভিজুক।
২০১১-র বিধানসভা ভোটে খড়দহে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তর বিরুদ্ধে অমিত মিত্রকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় চমক ছিল। অমিতবাবুর আগমনে আরও অনেকের সঙ্গে আমিও উৎসাহিত হয়েছিলাম তাঁর অতীতের দিকে তাকিয়ে। আমি দিল্লি থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমার ক্ষীণ ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। একবার কোনও এক কারণে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনই শুনেছিলাম তিনি সুব্রমনিয়ম স্বামীর প্রিয় ছাত্র ছিলেন। কথা বলতে বলতে মনে হয়েছিল তিনি আর্থিক সংস্কারের সোচ্চার সমর্থক। ‘পপুলিস্ট’ অর্থনীতিকে রীতিমতো অপছন্দ করেন। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সে তিনি দীর্ঘদিন সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল, দেশের তাবড় তাবড় শিল্পপতির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, সবাই জানত ডাঃ অমিত মিত্র পুঁজিবাদের সমর্থক, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করার পক্ষে। মানে অনেকটা রিফর্মিস্ট লিবারেল বুর্জোয়া। ২০১১-র ভোটের ঠিক আগে আমাকে দেওয়া এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মনমোহন সিং পরবর্তী জমানায় ভারতের অর্থনীতিতে যে বৈপ্লবিক রদবদল হয়েছে দুটি ইংরেজি শব্দ দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
টেকটনিক শিফট।’
ব্যাঘ্র-শাবক মূষিকে পর্যবসিত হলেন কলকাতার জল পেটে পড়ার পরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন বশীকরণ মন্ত্রে তাঁকে দলের আর পাঁচজনের মতো টিএমসি নেতা বানিয়ে দিলেন জানা নেই, চোখের সামনে দেখলাম ভদ্রলোকের রূপান্তর। বাংলায় এসে বাঙালিবাবু হবেন বলে তিনি ধুতি পাঞ্জাবি ধরলেন। শার্ট, প্যান্ট, সাফারি স্যুট সব ত্যাগ করলেন, সঙ্গে বিশ্বাস আর আদর্শকেও। ডাঃ জেকিল হয়ে গেলেন মিস্টার হাইড।
এমন অকল্পনীয় ‘মেটামরফসিস’-এর কারণ অমিতবাবুকে জিজ্ঞেস করার অবকাশ কখনও হয়নি, তবে হাত কচলাতে-কচলাতে বড় দিদিমণির মুখ ঝামটা সহ্য করতে দেখে, তাঁর সব হাঁ-তে হাঁ মেলানোর দৃশ্য দেখে বেশ কষ্ট পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের মতো শিল্প-বিমুখ, ঋণে জর্জরিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে ফিকি-র সেক্রেটারি জেনারেল হওয়া অনেক বেশি সম্মানের, তাসের দেশের চিড়েতন-হরতন না থেকে তিনি সেই দায়িত্বে ফিরে গেলেন না কেন? দুনিয়া জানে, অমিত মিত্রর স্পটলেস সততার কথা, কামাতে তিনি মন্ত্রী হননি, বরং মন্ত্রী হিসেবে যে হাস্যকর রকমের কম বেতন তিনি পেয়ে থাকেন তা দিয়ে চিনেবাদাম কেনার চেয়ে বেশি কিছু হয় না বলে, নিজের ব্যক্তিগত পুঁজি ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে তিনি দিন গুজরান করেন সকলের অলক্ষ্যে। পাছে লোকে কিছু ভাবে বলে তিনি অর্থমন্ত্রীর ঘরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পারতপক্ষে ঢুকতেও দিতেন না। বাকি মন্ত্রীদের ঘরে যাদের জন্য লাল কার্পেট বিছানো থাকত। নিজের বিচারবুদ্ধি, বিবেচনা প্রয়োগ করার ক্ষমতাই যেখানে সীমিত, কার্যত নেই বললেই চলে, সেখানে ক্ষমতা উপভোগের কোনও প্রশ্নই ছিল না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা-সম্মান করি, তবু আমার কাছে তিনি একজন ‘রিডল’ বড্ড রহস্যময়তায় মোড়া। তাঁকে দেখলে এখন আমার কেবল সেই প্রবচনটিই বারেবারে মনে পড়ে- খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে। (চলবে)