27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

এক টুকরো উপলব্ধি

Must read

এক টুকরো উপলব্ধি

সুমন চট্টোপাধ্যায়

তেষট্টি পূর্ণ করে ফেললাম। তিন কুড়ির ওপরে আরও তিন। নিজের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকে। সত্যিই কি আমার এত আয়ু প্রাপ্য ছিল? আমার মা ঊনষাটে চলে গিয়েছিলেন, আমি তার চেয়েও চার বছর বেশি বেঁচে ফেললাম।

বিস্মিত লাগে কেননা আমি সাবধানী, হিসেবী, সংযত, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের ধারই ধারিনি কখনও, আজকের পরে যে একটা আগামীকাল আছে কোনওদিন মাথাতেই আসেনি। মায়ের পেট থেকে বের হওয়া ইস্তক আমি বখাটে, মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। খুব ছেলেবেলাতেই আমার বেয়াড়া চালচলন দেখে বাবা বলতেন, বাকি সবাই যা করবে আমার গুণধর পুত্রটি চলবে ঠিক তার বিপরীতে। ধরা যাক একটি প্রশস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে একটা নর্দমা চলে গিয়েছে। সুমন ভুলেও রাস্তা দিয়ে হাঁটবে না, ও যাবে নর্দমার ওপর দিয়েই। বাবা একটুও ভুল বলেননি। রাস্তার বদলে নর্দমায় আকৃষ্ট হয় যে আহাম্মক তাকে কী বলা উচিত? উত্তর আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম, যার যেমন খুশি ভেবে নিতে পারেন, আমি সবটাই নতমস্তকে মেনে নেব। মাইরি বলছি।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে কত উচিত কথাই তো বাবা বলেছিলেন, এক কান দিয়ে শুনে তৎক্ষনাৎ আর এক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। আজ এতকাল পরে গানের শেষে সমে এসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার জন্য আমার মনস্তাপ হয় না কি? অবশ্যই হয়।

যেমন আমি সাংবাদিক হই বাবা তার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। বাবার স্থির বিশ্বাস ছিল এটা অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিতের পেশা, লেখাপড়া শিখে এই পেশায় নাম লেখানো হবে অর্বাচীনের কাজ। বাবা মনে করতেন যে পেশায় মানুষের প্রতিদ্বন্দী টিকটিক করে বেজে চলা ঘড়ি, অবসর বলে কোনও বস্তুই নেই, আছে শুধু অঘটন নিয়ে অর্থহীন মুহূর্ত্তের উত্তেজনা আর মালিকের জো-হুজুরি করা সেটা ভদ্দরলোকের ছেলের বিবেচ্যই হতে পারে না। বাবার কথায় It is a soul-killing job.

স্বভাব বেয়াদপ আমি বাবার হিতোপদেশ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনিনি। বয়স কম, রক্ত গরম, বেশ গোঁসাই হয়েছিল বরং। তারপর যত দিন যেতে থাকল, বুঝতে শুরু করলাম পিতৃদেবের পর্যবেক্ষণ একেবারে অব্যর্থ ছিল। ভাল ডিগ্রি আছে কিন্তু পেটে বিদ্যে নেই, নেই সাধারণজ্ঞানটুকুও। বাংলা যদিবা পাতে দেওয়ার মতো হয় ইংরেজিতে বেশিরভাগই এক একজন শেক্সপীয়ার। রাজনীতির বাইরে এত অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত আর কোনও পেশায় আছে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে বাংলা সাংবাদিকতায়, খবরের কাগজে তবু কানার মধ্যে ঝাপসাদের সন্ধান পাওয়া যায়, টেলিভিশনে তো ক’অক্ষর গোমাংসদেরই বোলবোলা। হকিকৎ মরমে প্রবেশ করল যখন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আত্মা চলে গিয়েছে লাশকাটা ঘরে। তবু বলব আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন সাংবাদিকতায় আসি তখনও খবর করে সমাজ-বদলের স্বপ্ন দেখা সম্ভব ছিল, পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ পিছনে তাকিয়ে তাই গভীর মনস্তাপ হয়, সাংবাদিক বলে নিজের পরিচয় দিতে লজ্জার চেয়েও বেশি ঘৃণা বোধ হয়। অবসাদে যখন মুহ্যমান হয়ে পড়ি, বাবার কথাগুলো মাইকের আওয়াজের মতো কানের দু’পাশে বাজতে শুরু করে, মনে হয় ধরণী দ্বিধা হও! তখন মনে হয় আবার নতুন করে জীবন শুরু করার একটা সুযোগ পেলে বেশ হত!

কিন্তু সে কী আর হয় রে পাগলা? তবু শাপমোচনের কোনও চেষ্টাই যে করিনা তা নয়। অনেক দিন হয়ে গেল আমি আর বাংলা কাগজ পড়ি না, বাংলা টেলিভিশন দেখার তো কোনও প্রশ্নই নেই। আমার মুখে কথাগুলো ভূতের মুখে রাম-নামের মতো শোনাবে জানি, তবু সত্যটা হল, না পড়ে না দেখে আমি দিব্য আছি, ছিটেফোঁটা অভাববোধও নেই আর। যখন বর্জন করা উচিত ছিল তখন তাকে গ্রহন করেছি। এখন এই পাপ-স্খালনের নিভৃত চেষ্টাতেই আমার নির্মল আনন্দ। বাপ কা বেটা তো বুড়ো বয়সেও হওয়ার চেষ্টা করা যায়, কী বলেন আপনারা?

আপনাদের নববর্ষ ভালো কাটুক।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article