সুমন চট্টোপাধ্যায়
২০১৬। সে বছর অনাবাসী বাঙালিদের সম্মেলন হয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর সান্টা ক্লারায়। যেদিকে তাকাই, আইটি-জায়ান্টদের বড় বড় অফিস, তথ্যপ্রযুক্তি নগরী। সেই শেষবার আমার এনএবিসি-তে যাওয়া। পুরোটাই আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সত্যম রায়চৌধুরীর সৌজন্যে। সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যলয়ের চ্যান্সেলর, অনেক দিন যাবৎ এই উৎসবের পৃষ্ঠপোষক।
সত্যম তখন ‘আজকাল’ কাগজের মালিক। ওই কাগজ আমার সাংবাদিকতার জন্মলগ্নের সূতিকা-গৃহ, তার প্রতি আমার দুর্বলতা অমলিন। সত্যম জানাল, এনএবিসি-র মঞ্চে ওরা দু’জন কৃতী বঙ্গসন্তানকে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমজন বন্ধন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর ঘোষ, দ্বিতীয়জন এই অধম। বড্ড লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি, এই পুরস্কারটির নাম শুনলেই কেমন যেন মনে হয় বেলা শেষ, সূর্যাস্ত হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। তার বছর চারেক আগে কলকাতার রোটারি সদনে রোটারিয়ানদের পক্ষ থেকে আমাকে একই সম্মান জানানো হয়েছিল। আমি মনে করি, জীবনে আমি এমন স্মরণীয় কোনও কাজ করিনি যার জন্য কোনও পুরস্কার প্রাপ্য হতে পারে। তবু ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ তা বিনম্র ভাবে স্বীকার করতে খুব একটা খারাপ লাগে না।
উপহার প্রদানের পরে নিয়মমাফিক আমাকে দু’চারটে কথা বলতে বলা হল। মিনিট চারেকের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় কিছুটা আবেগ-তাড়িত হয়েই আমি যা বলেছিলাম তার সারাৎসারটি এখানে তুলে দিচ্ছি একটি বিশেষ কারণ রয়েছে বলে। সান্টা ক্লারার মঞ্চে আমার হাতে এই পুরস্কার তুলে দিয়েছিল সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য।
আমি বলেছিলাম, “সত্যম রায়চৌধুরী আমায় যদি এই পুরস্কার কলকাতায় দিত, আমি গ্রহণ করতাম না। কিন্তু ও যখন বলল, এনএবিসিতে দেবে আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কেন জানেন, এখানে এতজন সফল বাঙালির মাঝখানে এলে আমি বেশ চাঙ্গা বোধ করি, বুঝতে পারি জগৎসভায় বাঙালি এখনও নিজের উজ্জ্বলতায় ভাস্বর হয়ে আছে। আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি, সবটাই ব্যর্থতার নয়।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমি পশ্চিমবঙ্গ নামক এমন এক ভূখণ্ড থেকে এসেছি যেখানে মন ভালো করে দেওয়ার মতো কিছু হচ্ছে না, এমন কিছু যা আপনাদের সামনে সগর্বে তুলে ধরতে পারি। নিজের সাংবাদিক জীবনের সূচনাটা যেহেতু আমার আজকালে হয়েছিল তাই এই সম্মান আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। আমি ভাবছি আমাদের নিরানন্দভূমির সঙ্গে আপনাদের আশাব্যঞ্জক সাফল্যের মধ্যে সুদৃঢ় সেতুবন্ধন হলে বড় ভালো হয়। সে কাজে সাংবাদিক হিসেবে আমাদের যদি কোনও ভূমিকা থাকে আমরা তা সাগ্রহে পালন করব।”
বঙ্গ-সম্মেলনের পরে কয়েকটা দিন সান ফ্রান্সিসকো আর লস অ্যাঞ্জেলেসে কাটিয়ে বেশ তরতাজা হয়েই ফিরলাম কলকাতায়। অফিস জয়েন করে দেখি সহকর্মীদের মুখগুলো থমথমে, নবান্ন নাকি ‘এই সময়’ কাগজে হঠাৎ সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে, সান্টা ক্লারায় আমার ভাষণের কারণে। ততদিনে কাগজে সরকারি বিজ্ঞাপন হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার ধাতস্থ হয়ে গিয়েছে। তবু মনে হল, সান্টা ক্লারায় আমি কী এমন বলেছি যে সরকারকে এমন প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হল? যদি বলেও থাকি সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার সঙ্গে আমার কাগজের সম্পর্ক কোথায়?
রহস্যের কিনারা করতে দেরি হল না। জানতে পারলাম আমার জনাকয়েক ’শুভাকাঙ্ক্ষী’ বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে মাননীয়ার কানে বিষ ঢেলেছেন। বলেছেন আমার এতখানি স্পর্ধা যে আমি নাকি বিদেশে গিয়ে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যা মুখে আসে তাই বলেছি। আমাকে অতএব সমুচিত শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং ঝি-কে মেরে বৌকে সবক শেখাও। আমি ‘এই সময়’ সম্পাদনা করেছি সাড়ে সাত বছর, পুরোটাই তৃণমূলি জমানায়। তার মধ্যে অন্তত দশবার কাগজে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে এমনই সব তুচ্ছ বিষয়ের কারণে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খলনায়ক সাব্যস্ত হয়েছি আমিই। কোথায় কী বলেছি, কবে কখন কাকে হোয়াটসঅ্যাপে জোক ফরোয়ার্ড করেছি, কিংবা সরকার বিরোধী লেখা লিখেছি, সঙ্গে সঙ্গে পেটে লাথি, বিজ্ঞাপন বন্ধ। আমার ওপর সর্বক্ষণের নজরদারি, বিশেষ করে মাননীয়াকে ঘিরে থাকা উড়ু-কাতু-মদনাদের, রসিকতা করে আমি যাদের নাম দিয়েছি ‘প্রিটোরিয়ান গার্ড’। চামচারা এর মানে বোঝে না জানি, তাতে আমার কী!
দিনকয়েক আগে ইউটিউবে বিনোদ দুয়ার সঙ্গে ধ্রুব রাঠির একটি চমৎকার আলাপচারিতা শুনছিলাম। ঠান্ডা গলায় বিনোদ বোঝাচ্ছিলেন আজকের ভারতবর্ষে প্রধানত দু’ধরনের মিডিয়া তৈরি হয়েছে ‘সরকারি’ আর ‘দরবারি’। ফলে স্বাধীন মতপ্রকাশের জায়গাটা সঙ্কুচিত হতে হতে এখন সাচ্চা সাংবাদিকের ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউটিউব। প্রত্যয়ী বিনোদ বলছেন, ’সাংবাদিকতা করা বলতে আমি বুঝি ঝান্ডার রং না দেখে সরকারের বিরোধিতা করা, কোথায় কোথায় গলদ হয়ে যাচ্ছে শাসককে তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া।’ আমিও বিনোদের ইস্কুলেরই ছাত্র, অন্যায় আপস করতে করতে আমার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সিবিআই-কে ধন্যবাদ, তারা আমাকে বিদেশের হাজতে পাচার করে দিয়ে অন্তত এই একটা দৈনন্দিন বিষের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ‘সরকারি’ না হলে পশ্চিমবঙ্গে আজ মিডিয়াকে ঝাঁপ বন্ধ করতেই হবে। যে শাসক প্রতিপক্ষের এই দুর্বলতা ধরে ফলেছে সে তো চাইবেই হার মিসট্রেসের ভয়েস খুঁজতে, কলাটা-মুলোটা ধরিয়ে দিয়ে তাদের পক্ষে রাখতে। আর বেয়াদপি করলে? টুঁটি চেপে ধরবে।
আমি যখন ছিলাম ‘এই সময়’-এর বিজ্ঞাপনী আয়ের ৪০ শতাংশ আসত সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে। অন্যদের ক্ষেত্রে কখনও ৬০ শতাংশ, ৮০ শতাংশ কিংবা সম্পূর্ণই ১০০ শতাংশ। অন্যভাবে দেখলে এর অর্থ সরকারই এ রাজ্যে বেশিরভাগ মিডিয়ার বেতন দাতা। তার মানে অফিসের মনিবকে ততটা না মেনে চললেও চলতে পারে, সরকার নামক প্রবল পরাক্রমশালী মনিবকে উপেক্ষা করার কোনও উপায় নেই। করেছ কী মরেছ। সরকারের সঙ্গে মিডিয়ার ‘দাতা-গ্রহীতার’ সম্পর্ক কোন অতলে পৌঁছেছে আমি সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সে সব কথা এখানে লিখছি না, ভবিষ্যতে কখনও লিখব।
কয়েক দিন পরে সত্যম রায়চৌধুরী যখন বলল, আমার ভাষণের জন্য তাকে অনেক লোকের মাঝে মুখ ঝামটা খেতে হয়েছে আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল। রাজ্যের কোনও এক মন্ত্রীর বাড়ির শ্রাদ্ধবাসরে আমার শ্রাদ্ধ শুনতে হয়েছিল বেচারা সত্যমকে, তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আমাকে এভাবে তোল্লা দেওয়া না হয়।
এবার বুঝে নিন চটি-চাটা ব্রিগেডে আমার স্থান কতটা উঁচুতে। (শেষ)