ছবির রবিকে বাঙালির একান্ত প্রয়োজন
সুশোভন অধিকারী
আবার এসে গেল বাঙালির আদরের পঁচিশে বৈশাখ, প্রাণের পঁচিশে বৈশাখ, গানের পঁচিশে বৈশাখ। আরো কত রকমের পঁচিশে বৈশাখ! দু’টি সংখ্যায় গাঁথা বাংলা বছরের প্রথম মাসের এই তারিখটা বাঙালিকে যেন বেহুঁশ করে রেখেছে। সে এক অবশেসনের মতো। আবার উল্টোদিকও আছে। তাঁকে নিয়ে বাঙালির আধিখ্যতার (পড়ুন আদিখ্যেতা) শেষ নেই…এমনটা অনেকে মনে করেন। আজও বাঙালির সবকিছু নাকি গড়াতে গড়াতে শেষমেশ রবীন্দ্রনাথের রাতুল চরণে গিয়ে ঠেকে…এই রকম হাজার অভিযোগ এখন আকছার! হয়তো খানিকটা সত্যিও! তবে সেই সত্য বা তার বিপরীত দিকের মন্থনে কী উঠে আসে তাও ভেবে দেখা দরকার।
সে যাই হোক, এত কথা থাক, এই গৌরচন্দ্রিকায় কাজ নেই। বরং সরাসরি সাদামাঠা ভাবে দেখি, রবি ঠাকুরের কাছে আমরা কী পেয়েছি, তিনি আমাদের কী দিয়েছেন! তাঁর কাছে পাওয়া সেই প্রাপ্তির লিস্টিও নেহাত কম নয়। তিনি আমাদের ভাষাকে সহজ করেছেন, সাহিত্যকে সজীব করেছেন, বিশ্বের দরজায় তাকে পৌঁছে দিয়েছেন, চল্লিশ বছর বয়সে অন্য গোত্রের এক স্কুলের ভাবনা ভেবেছেন, ভবিষ্যতে যা বিশ্বভারতী নামে এক আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চার আসর হয়ে উঠেছে। আর বাংলা গানকে তিনি এমন ভাবে নির্মাণ করেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর আশি বছর পরে আজও আমাদের মনের যে-কোনো অনুভবের প্রকাশে সেই গানের ওপরেই ভরসা। সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় প্রেমে বিরহে প্রয়াণে পূজায়…সবখানে বাঙালি আজও কারণে অকারণে রবি ঠাকুরের সেই গীতবিতানের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হতেই পারে, এ বেশ বাড়াবাড়ি, ওই শুভ্রকেশ বৃদ্ধ ছাড়া আর কি কেউ নেই? কেউ কি ছিল না? কেউই ছিল না সে যেমন ঠিক নয়, তেমনি ওঁর মতো কেউ ছিল না…সেও তো ঠিক!
তবে এতো কথা এখানে নাই বলা হল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য গান নাটক সবকিছু যদি একপাশে সরিয়ে রাখি, তা হলেও আরেকটা বিষয় রবীন্দ্রনাথের বাকি সৃজনশীল ভুবনের সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দিতে পারে, সে হলো তাঁর চিত্রকলা। রবি ঠাকুরের শেষ বেলাকার ফসল। জীবনের প্রান্তে পৌঁছে তাঁর সাহিত্য গান সব রইল পড়ে, প্রায় সত্তর ছুঁয়ে যাওয়া বয়সে তিনি ছবির জগতে হুড়মুড় করে ঢুকে কী একটা হৈ হৈ কাণ্ড বাধিয়ে বসলেন! এখন প্রশ্ন উঠবে, তাঁর ছবি আঁকার জগৎটাকে এত বড় করে ধরা হচ্ছে কেন? কী এমন মাহাত্ম্য ফুটে আছে সেখানে? ভারতীয় চিত্রকলার বহমান ইতিহাসে এর আদৌ কোন জায়গা আছে? তিনি তো কোনোদিন ছবি আঁকা নিয়ে চর্চাও করেননি। তবে শেষবেলায় কী এমন ঘটলো যে, তাঁর চিত্রকলাকে এমন সমাদরের সঙ্গে উঁচু আসন দেবার চেষ্টা? একজন বিশ্বখ্যাত কবি বলেই তাঁর চিত্রকলা নিয়ে এমন মাতামাতি?
এর উত্তর পেতে ছবির ইতিহাসের দিকে একটু তাকাতে হবে। আমরা জানি প্রাচ্য ও পশ্চিমের শিল্পভাবনায় একটা বেসিক ফারাক, মূলগত ভিন্নতা আছে। অন্তত সেই পর্বে ছিল। প্রাচ্যশিল্প প্রকৃতির হুবহু অনুসরণের পথে হাঁটেনি, সে তার ভেতরের প্রাণছন্দ প্রকাশের চেষ্টা করেছে। রং-রেখা-আকারের সঙ্কেতে প্রকৃতিকে ধরার চেষ্টা হয়েছে, যা কিছুটা আলঙ্কারিক বিমূর্ততার কাছাকাছি। আলোছায়া ঘেরা চোখে দেখা বাস্তবের জগৎ থেকে তার অবস্থান অনেকটা দূরে। আরো খোলসা করে বললে, আমাদের শিল্পে সাদৃশ্য কথাটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুন্দর চোখের বর্ণনায় পদ্মপলাশ লোচনের কথা আমাদের দেশে প্রচলিত। সে কোনো নির্দিষ্ট সরোবরের পদ্মের পাপড়ির সঙ্গে আয়ত চোখের মিলের কথা বলা হচ্ছে না, সামগ্রিকভাবে পাপড়ির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করা হচ্ছে। অন্যদিকে যদি ভেনাসের মূর্তির দিকে তাকাই, দেখব সেই সৌন্দর্যের আদর্শ কিছু আলাদা — তা রচিত হয়েছে মানবশরীরের শ্রেষ্ঠতম অংশগুলির সম্মিলনে।
এ তো গেল পূর্ব-পশ্চিমের কলাশিল্পে বিভেদের গোড়ার কথা। এবারে একটু সামনের দিকে তাকানো যাক। ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশদের শাসনে আমাদের দেশে কয়েকটি আর্টস্কুল তৈরি হয়েছে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টের ছায়ায় যার মধ্যে কলকাতার আর্টস্কুল অন্যতম। এই শিল্প শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশ্য হল রিয়েলিস্টিক আদর্শের শিক্ষায় ছাত্রদের দীক্ষিত করে তোলা। শুরুতে সে কাজ ঠিকঠাক এগোলেও ই.বি. হ্যাভেল কলকাতার আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে একটু বাধ সাধলেন। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, অবন ঠাকুরের আর্ট কলেজে যোগদান ইত্যাদি জরুরি ঘটনা ঘটে এই পর্বে ১৯০৫ নাগাদ। হ্যাভেল পূর্ব-পশ্চিমের শিল্পগত ফারাকটা উপলব্ধি করে ভারতীয় শিল্পকে যেন এগিয়ে রাখছিলেন। স্বভাবতই ব্রিটিশরাজের সেটা পছন্দ হয়নি, ইতিমধ্যে হ্যাভেল অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ফিরে যেতে হয়, আর্ট কলেজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অবনীন্দ্রনাথ। বাংলার শিল্পকলায় সে এক টার্নিং পয়েন্ট। এর কিছুকাল আগে অবনীন্দ্রের নেতৃত্বে বাংলা-কলমের ছবির সূচনা তথা ভারতীয় শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। অজন্তা, মোগল ও মিনিয়েচার ছবির সংশ্লেষে ছবিতে দেখা দিয়েছে নতুন দিক। কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কী? খেয়াল করলে দেখি এই মুহূর্তে চিত্রকলা প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনারও দিকবদল ঘটেছে, রবি বর্মার ছবির প্রশংসা ছেড়ে তিনি এখন উৎসাহিত করছেন অবন ঠাকুরের দলকে। যদিও অচিরেই তিনি বুঝেছেন এইটাই চিত্রকলার একমাত্র পথ হতে পারে না।আর এখান থেকে রবীন্দ্রনাথের নতুন চিত্রচিন্তা শুরু।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ছবির নতুন ধারাকে তাঁর ‘রবিকা’ কি প্রথম থেকেই গ্রহণ করেছিলেন? জোড়াসাঁকোয় বিচিত্র-সভা শুরু হওয়ার কিছু পরে রবীন্দ্রনাথকে জাপান পাড়ি দিতে হয়। সেখান থেকে অজস্র চিঠি এসেছে কলকাতায়। দক্ষিণের বারান্দার সেই বিখ্যাত তিন শিল্পী-ভ্রাতার কাছেও অনেক চিঠি। কী ছিল সেই চিঠিতে? সদ্য সূচিত হওয়া বিচিত্র আর্ট-স্কুল নিয়ে খবরাখবর? জরুরি খবর নিশ্চয়, তবে ‘আমি ভালো আছি’ আর ‘তুমি কেমন আছো’-র সাধারণ শব্দের আদানপ্রদানে সে সীমাবদ্ধ নয়। বরং আশ্চর্য হয়ে দেখি প্রিয় ‘রবিকা’ চিঠিতে তাঁদের রীতিমতো বকুনি দিয়েছেন। কিন্তু কেন এই বকুনি? এর সঙ্গত কারণ আছে বৈকি।
দেশে থাকতে বাংলা-কলমের ছবি ঘিরে রবীন্দ্রনাথের মনে যে দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে উঠেছিল, জাপান ও আমেরিকায় অজস্র ছবি দেখে মনের সেই উজিয়ে ওঠা ভাবনার সমর্থন পেলেন যেন। প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করলেন শিল্পকলার সঙ্গে অতীতচারিতা, পুরাণ আর কল্পনার আকাশ থেকে অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যদের মাটিতে নেমে আসতে হবে। সময়ের সঙ্গে যোগ ছিন্ন করে শিল্পকলা বেশিদিন সচল থাকতে পারে না। সজীব বর্তমানের সঙ্গেই যে শিল্পের নাড়ির সম্পর্ক — তা যেন জাপানের মতো দেশে গিয়ে স্পষ্ট অনুভব করলেন। সেই চিঠিপত্রের দু’এক টুকরো দেখলে বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথ কেন এত বকুনি দিয়েছিলেন, আর অবনেরা এমন বকুনি ডিসার্ভ করতেন কি না! এক নজর দেখে নেওয়া যাক…
‘টাইক্কানের (প্রখ্যাত জাপানী শিল্পী) ছবি যখন প্রথম দেখলুম, আশ্চর্য হয়ে গেলুম! তাতে না আছে বাহুল্য, না আছে শৌখিনতা। তাতে যেমন একটা জোর আছে, তেমনি সংযম।….এর মধ্যে ছোটোখাটো কিম্বা জবরজঙ্গ কিছুই নেই; যেমন উদার, তেমনি গভীর, তেমনি আয়াসহীন। নৈপুণ্যের কথা একেবারে মনেই হয় না।’ আবার অন্যত্র…‘আমাদের নব্যবঙ্গের চিত্রকলায় আরেকটু জোর সাহস এবং বৃহত্ব দরকার আছে এই কথা আমার বারবার মনে হয়েছে। আমরা অত্যন্ত বেশি ছোটোখাটোর দিকে ঝোঁক দিয়েছি।’ অবশেষে আরো কঠিন স্বরে…
‘জাপানে যতই ঘুরলুম, দেখলুম, ক্রমাগত এইটেই বারবার মনে হল যে আমার সঙ্গে তোমাদের আসা খুবই উচিত ছিল। আমাদের দেশের আর্টের পুণর্জীবন-সঞ্চারের জন্য এখানকার সজীব আর্টের সংস্রব যে কত দরকার সে তোমরা দক্ষিণের বারান্দায় বসে কখনোই বুঝতে পারবে না। আমাদের দেশে আর্টের হাওয়া বয় নি, সমাজের জীবনের সঙ্গে আর্টের কোনো নাড়ির যোগ নেই — ওটা একটা উপরি জিনিস, হলেও হয়, না হলেও হয়।…এদের সমস্ত জীবনটা এই আর্টের মধ্যে দিয়ে কথা কচ্ছে। এখানে এলে তোমাদের চোখের উপর থেকে একটা মস্ত পর্দা খুলে যেত, তোমাদের অন্তর্যামিনী কলাসরস্বতী তাঁর যথার্থ নৈবেদ্য পেতে পারতেন। এখানে এসে আমি প্রথম বুঝতে পারলুম যে, তোমাদের আর্ট ষোলো আনা সত্য হতে পারেনি।’…অর্থাৎ তাঁর চোখে তখন বেঙ্গল স্কুলের ছবির দুর্বলতা একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অবন-গগনদের পাশাপাশি হতাশ রবীন্দ্রনাথ কন্যা মীরাকে আরো সাংঘাতিক কথা লিখেছিলেন…‘চিত্রবিদ্যা তো আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হত, তাহলে একবার দেখাতুম কি করতে পারতুম।’ রবীন্দ্রনাথের এই বাক্যবন্ধ থেকেই শুরু হয় ছবির জগতে তাঁর আসা কতখানি জরুরি হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, বাংলা তথা ভারতীয় শিল্পের নিরিখে বেঙ্গল-স্কুলের অবদান অনস্বীকার্য। অবন ঠাকুর তখন শক্ত হাতে হাল না-ধরলে রবি বর্মা-ঘরানার ছবিই ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার মাপকাঠি হয়ে উঠত। আর রবি বর্মার ছবিতে কেবল বিষয় ও শরীরী অবয়ব দেশীয়, কিন্তু প্রকাশের পদ্ধতি, আঙ্গিক-উপকরণের যাবতীয় উপাদান পাশ্চাত্যের ছায়ায় আবৃত। সেখান থেকে অবনীন্দ্রনাথই আমাদের দৃষ্টিকে সরিয়েছেন, চালিত করেছেন দেশীয় পথে। তবে নিজের কাজে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অভিমুখে বাঁক নিতে নিতে এগিয়ে গেলেও, শিষ্যেরা আটকে পড়েছিলেন আবর্তের ঘেরাটোপে। সেখান থেকে একসময় সরে দাঁড়িয়েছেন যামিনী রায়, অন্যদিকে নন্দলালকে এনে কলাভবনের ভার দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তলিয়ে দেখলে, সেখান থেকেই প্রকৃত আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের প্রকাশ ঘটেছে। এই মুক্ত পরিবেশে নতুন আবহে নন্দলালের পাশাপাশি উঠে এসেছেন বিনোদবিহারী, রামকিঙ্করের মতো শিল্পী ও ভাস্কর। একই সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কন্যা মীরাকে লেখা চিঠির সেই শব্দমালাকে নির্মম সত্যি করে তুলেছেন। মনের ভিতরে জমে থাকা দৃঢ় সংকল্পকে তীব্র জেহাদের এক ঝটকায় টেনে বাইরে এনেছেন।
ছবির ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদে সিক্ত স্বদেশ-বিদেশের তোয়াক্কা করেননি। বরং ওপরের সেই খোলসটাকে টেনে ছিঁড়ে বলে উঠেছেন, ‘ভারতীয় অজন্তীয় ওসব কিছু না। ভিতরের থেকে এলো তো এলো, না এলো তো এলো না। চেয়ে দেখো, ছবিটা ছবি হয়েছে কিনা।’ ছবির এই রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির একান্ত প্রয়োজন, তীব্র ভাবে দরকার আধুনিক শিল্পধারার সেই চিত্রীকে — যাঁর মুঠোয় ধরা বিশ্বশিল্পের সোনার চাবিকাঠি। এই চাবি আমরা তাঁর হাত থেকেই নিয়েছি। আজ তাঁর একশো-ষাটতম জন্মবর্ষে দাঁড়িয়ে বাঙালিকে স্বীকার করতেই হবে ছবির রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কত অমোঘ, কী অবশ্যম্ভাবী। যিনি ব্যক্তিজীবনে অদম্য চিত্রকরের পাশাপাশি ভাবনা ও আদর্শে এক আধুনিক শিল্পনিকেতন গড়েছেন, দেশের সামনে যা মশাল হাতে অগ্রপথিকের ভূমিকা নিয়েছে।
(লেখক শান্তিনিকেতন কলাভবনের প্রাক্তন কিউরেটর, আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত।)