Wednesday, October 30, 2024

বিবর্তনের বিস্ময় খুদে বহুকোষী

Must read

নিজস্ব প্রতিবেদন: সাইবেরিয়ার বরফে জমে ২৪ হাজার বছর। তবু তারা যে শুধু বেঁচেবর্তে আছে, তা নয়। উষ্ণতার মাত্রা বাড়তেই নিজস্ব কায়দায় শুরু করে দিয়েছে বংশবিস্তার। সাই-ফাই ছবির প্লটকে হার মানানো বাস্তব বিস্ময়ের নাম ডেলয়েড রোটিফার।

অতি খুদে এই বহুকোষী প্রাণীর উপস্থিতি অণুবীক্ষণ ছাড়া ধরা যায় না। অথচ তাদের ঝুলিতে রেকর্ডের ছড়াছড়ি। জীববিজ্ঞানীদের চোখে তারা ‘বিবর্তনের কেলেঙ্কারি’―সাড়ে তিন কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা, তাও আবার যৌনতা বেবাক বিসর্জন দিয়ে! তার সঙ্গে রয়েছে যে কোনও পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। দিনের পর দিন উপোস থাকা, ভয়ানক খরা,

অক্সিজেনের অভাব, তাপমাত্রার চূড়ান্ত তারতম্য, এমনকী বিকিরণেও কাবু না হওয়া। কিন্তু এ বার যে নতুন রেকর্ড তারা গড়েছে, তাতে রীতিমতো উল্লসিত বিজ্ঞানীরা। তাঁদের সামনে এখন গবেষণার নতুন দিগন্ত।
পোকার মতো এই অমেরুদণ্ডীরা সবাই স্ত্রীজাতীয়, পুরুষ নেই। থাকে মিষ্টি জলের হ্রদ-পুকুর-নদীনালায় অথবা স্যাঁতসেঁতে কোনও জায়গায়, যেমন শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের গায়ে, ভিজে গাছের গুঁড়িতে কিংবা মাটিতে। রুশ বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি তাদের হদিস পেয়েছেন সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্ট বা চিরতুষারাবৃত অঞ্চলে, হিমায়িত অবস্থায়। রেডিয়োকার্বন পরীক্ষায় ধরা পড়েছে নমুনাগুলির বয়স প্রায় ২৪ হাজার বছর। এতদিন পর্যন্ত জানা ছিল, হিমায়িত অবস্থায় এক দশক পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে ডেলয়েড রোটিফার। এ বারের আবিষ্কার তাবৎ হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে।

উত্তর মেরুর কাছাকাছি সাইবেরীয় অঞ্চল থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, বিজ্ঞানীদের অনুমান, সেই ধরনের রোটিফাররা থাকত বিশাল ও রোমশ প্রাণীদের থাবার নীচের দিকে, যেমন রোমশ গন্ডার, যারা এখন বিলুপ্ত। অথচ, এত বছর ধরে বরফের মধ্যে জমে থাকা অবস্থায় শুধু যে এই বহুকোষীরা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, তা নয়, এখনও তারা প্রজননক্ষম। এমন সাংঘাতিক আয়ুর রহস্য কী?

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে একেবারে নির্বিকল্প সমাধিতে চলে যায় রোটিফাররা, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ক্রিপ্টোবায়োসিস। সব রকম কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়, প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায় বিপাক ক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে ‘লুকোনো জীবন’ কিংবা ‘জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থা’ বলে বর্ণনা করেছেন। ঠিক কী উপায়ে এমন আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে এই অণুজীবরা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এ নিয়ে গবেষণার এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। পরীক্ষাগারে কখনওই এত দীর্ঘ সময় ধরে নমুনা সংরক্ষণ করে রেখে পর্যবেক্ষণ চালানো সম্ভব ছিল না। অথচ, প্রকৃতির খেয়ালে তা সম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিমায়িত অবস্থায় রোটিফারদের হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকার রহস্য বা বহু যুগ আগের প্রজাতিগুলির সঙ্গে আজকের প্রজাতির কী তফাত, সে সম্পর্কে জানার এমন সুযোগ তাই আর আসবে না।

এখনও পর্যন্ত ডেলয়েড রোটিফারদের নিয়ে যতদূর গবেষণা হয়েছে, তার ভিত্তিতে জানা গিয়েছে, এদের দৈর্ঘ্য মোটামুটি ০.১ থেকে ০.৫ মিলিমিটার। ওই খুদে শরীরেই রয়েছে মুখ থেকে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত সম্পূর্ণ পরিপাকততন্ত্র। এরা চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে পারে এবং পার্থেনোজেনেসিস পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে। অর্থাৎ, স্ত্রীজাতীয় অণুজীবটি নিজেই নিজের ক্লোন তৈরি করে ফেলে, সঙ্গমের প্রয়োজন হয় না। এদের টিকে থাকার ক্ষমতা এবং প্রজননের অভ্যাস অণুজীব বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রায় ধাঁধার মতোই। তাই সাইবেরিয়ার আবিষ্কার নিয়ে তাঁদের উৎসাহের অন্ত নেই। ২৪ হাজার বছর আগের নমুনার সঙ্গে আজকের রোটিফারদের জিন মিলিয়ে দেখলে হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। বিবর্তনের ধারায় কেন কিছু কিছু প্রাণী যৌন জনন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তারও সূত্র পাওয়া যেতে পারে।

রাশিয়ার যে বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা চালাচ্ছেন, তাঁদের ধারণা, রোটিফারদের দীর্ঘ সময় হিমায়িত অবস্থায় বেঁচে থাকার রহস্য সমাধান হলে দরকারি কিছু কৌশল শিখে নিতে পারবে মানুষও। ক্রায়ো-প্রিজার্ভেশন, অর্থাৎ অতিনিম্ন তাপমাত্রায় জীবদেহের কোষ, কলা, অঙ্গ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে রাখার ক্ষেত্রে এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article