সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘তখন’ আর ‘এখন’-এর দ্বন্দ্ব চিরন্তন। কেউ মনে করে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ আর বর্তমানটা নিছকই ইমিটেশন গয়না। বিপক্ষ দল ফুঁসে উঠে বলে, কবে পরমান্ন খেয়েছ, আজ হাতের আঙুলে তার গন্ধ শুঁকে কী লাভ! অতীতের সব ভালো ছিল আর বর্তমানের সবটুকু খারাপ, এ কথা উন্মাদ ছাড়া আর কেউ বলবে না। ঠিক যেমন উল্টো কথাটাও বলা নিরর্থক যে বর্তমানের সবটুকু ভালো আর অতীতের সবটুকু খারাপ। তবু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই বিতর্ক চলতেই থাকবে, থামবে না। তর্কপ্রিয় বাঙালির কাছে তখন বনাম এখন বিষয় হিসেবে খুবই চিত্তাকর্ষক।
আমি কোনও দিন চরমপন্থী ছিলাম না, আজও নই। ফলে এ জাতীয় বিতর্কে আমার তেমন রুচি নেই। বহমান সময়ের ভালো-মন্দের বিচার করার যোগ্যতাও আমার নেই। মা কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন, দুগ্গাপুজোকে কেন্দ্রে রেখে আমি সেই বিবর্তনের কথা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে বলতে পারি। কোন মা-র প্রতি আপনার পক্ষপাত, সেটা একান্ত ভাবেই আপনার নিজস্ব পছন্দ আর অভিরুচির ব্যাপার।
সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়, দুগ্গাপুজোও বদলেছে। আগামী দিনে সম্ভবত আরও বদলাবে।
প্রতিমার কথা দিয়েই শুরু করা যাক। আমাদের ছেলেবেলায়, মানে অর্ধ-শতক আগেও মায়ের প্রতিমা হত হয় একচালা নয়তো বড় জোর দুগ্গাকে মাঝখানে রেখে অল্প ব্যবধানে পুত্র-কন্যাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া। অসুরকে দেখতে লাগত অসুরের মতোই, সিংহের দংশনে তার রক্তাক্ত হাত দেখে মনে হত বেশ হয়েছে, ব্যাটা মা দুগ্গার সঙ্গে লড়তে যাওয়া?
প্রতিমা গড়ার সাবেকি ঐতিহ্য সম্পূর্ণ উবে গিয়েছে তা নয়, বাড়ির পুজোয়, কতক বারোয়ারিতেও তা সযত্নে রক্ষিত হচ্ছে।
কিন্তু যে সব পুজো নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ, মিডিয়া ম্যানিয়া, সুনামির মতো জনস্রোত, পুরস্কার জেতার কাঁটো কি লড়াই, সেখানে প্রতিমা নিয়েই অভিনব সব পরীক্ষা-নীরিক্ষা। এই সব মণ্ডপে প্রতিমা দেখছি না শিল্পকর্ম, সেই ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। কোনও মণ্ডপে দুগ্গাকে যদি বা অতিকষ্টে চিহ্নিত করা গেল, কার্তিক-গণেশ বাবাজীবনদের খুঁজেই পাওয়া গেল না। তখন প্রতিমা গড়া হত কেবলই কুমোর পাড়ায়। তাদেরই ছিল এ ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার। ঠাকুরবাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে, জনপ্রিয় গানের এই কলিতে ভেসে উঠত মাটির তাল থেকে মূর্তি হওয়ার চিত্রকল্প। এখন কুমোররা সব কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তা নয়, পুজোর মরসুমে নামী-অনামী শিল্পী বা চিত্রকরেরা এখন কুমোরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ফলে দুটো ঘটনা ঘটছে একসঙ্গে। আগে প্রতিমার খ্যাতির কারণ হতেন পাল বংশীয় কুম্ভকারেরা, যেমন রমেশ পাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপাল ইত্যাদি। তার চেয়েও বড় কথা থিমের নেশায় মজতে যাওয়ার অনিবার্য ফল হিসেবে পুজোটা পর্যবসিত হচ্ছে নেহাতই অজুহাতে। আসল পুজো হচ্ছে নিত্য-নতুন থিমের। অতি-ব্যস্ত জনপদের মাঝখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বুর্জ খলিফার রেপ্লিকা বানানোর বুকের পাটা নিজের যৌবনে ফাটা কেষ্টরও ছিল না। এরপরে কোনও দিন শুনব নিউ ইয়র্কে ধূলিসাৎ হওয়া টুইন টাওয়ার ফের মাথা গজিয়েছে কলকাতার অন্য কোথাও অন্য কোনও খানে।
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, কবি সখেদে লিখেছিলেন। এখন পুজো এলে শহরের সর্বাঙ্গ বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে, আগে এটা ছিল না। বামে তাকান অথবা দক্ষিণে, সামনে অথবা পিছনে, পথে যেতে যেতে এমন অভিমন্যু দশায় মনে হবে ক্লস্ট্রোফোবিয়া হচ্ছে, মুখ তো কোন ছাড়, এক টুকরো আকাশও যেন চোখে পড়ছে না। সেদিন শুনছিলাম চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিশিষ্ট্য শল্যচিকিৎসক ও তার্কিক কুণাল সরকার পুজোর সময় এমন দানবিক বিজ্ঞাপনের উৎপাতের নাম দিয়েছেন ‘কমার্শিয়াল কার্বঙ্কল’। বড় ভালো লাগলো শুনে।
তখনের সঙ্গে এখনের সবচেয়ে বড় ফারাকটি গড়ে দিয়েছে পুজোর বাণিজ্যিকীকরণ। পুজো হয়ে গিয়েছে পণ্য, অসংখ্য মানুষের নজর কাড়তে সুযোগ বুঝে যে যার ব্র্যান্ড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হরেকরকমবা বাণিজ্যিক সংস্থা। এমন বাণিজ্যিক বুদ্ধি তখনের পুজো কর্মকর্তাদের ছিল না। সওদাগরি হাটে পুজোকেও যে বেচা যায়, বা বেচা উচিত, এই বোধটাই তখন অনুপস্থিত ছিল। আর এখন সব কিছুতেই, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি মায় পুজোতেও পণ্যায়ন। এই যে এত পুজোর স্পর্ধিত বৈভব, টাকার গরম, তার উৎসে রয়েছে বাণিজ্যিক ধনভাণ্ডার। জানতে ইচ্ছে করে এ সব পুজোয় পাড়ার ছেলেরা কি রশিদ বই হাতে চাঁদা তুলতে বের হয়, তার কি আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে?
বহু বছর ধরে আগমনীর পদধ্বনি শোনা মাত্র বাটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে একটাই স্লোগান লেখা থাকত — ‘ পুজোয় চাই নতুন জুতো’। কিন্তু শুধুই কি নতুন জুতো, নতুন জামা-কাপড় নয়? নতুন গল্প-উপন্যাস-কবিতা নয়? নতুন গান নয়? নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া নয়? পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে নতুন করে আড্ডা দেওয়া নয়? নতুন মেয়ে সেজেগুজে পাড়ায় ঢুকলে ঝাড়ি মারা নয়? যত চাইব, তালিকা তত বেশি লম্বা হয়ে একটি বার্তাই দেবে বারবার, পুজো মানে পুরোনো জিনিসই নতুন করে পাওয়া আর সেই পাওয়ার আনন্দে মশগুল হয়ে থাকা কয়েকটি দিন, যে যার মতো করে।
অন্যভাবে উৎকর্ষের সাধনার মরসুম বলতে ছিল বাঙালির পুজো। লেখক তার সেরা গপ্পো-উপন্যাস, কবি তার সেরা পদ্য, গায়ক তার সেরা গানটি জমিয়ে রাখত পুজোর আগে প্রকাশ করবে বলে। পুজো সংখ্যার দখল নিয়ে মায়ে-ঝিয়ে বচসা হত ঘরে ঘরে, কার পুজোর গানটা বেশি ভালো, হেমন্ত না মান্নার, লতার না সন্ধ্যার তা নিয়ে ফাটিয়ে তক্কো হত পাড়ার রকে রকে। পুজোর অর্থ ছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাস, অনাসৃষ্টির দীর্ঘশ্বাস নয়।
অনেক কাল হল এ সব পাট চুকে গিয়েছে। বাঙালির জীবনযাপনের অভিধান থেকে ‘উৎকর্ষ’ শব্দটি কবেই মুছে গিয়েছে, তার বদলি শব্দ হয়েছে ‘সাফল্য’, যেন তেন প্রকারেণ। সবাই সফল হতে চায়, ভালো হতে চায় কয়জনা?