- August 16th, 2022
রামরাজ্যে অসন্তোষ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমাদের এই রামরাজ্যে প্রজাগণ বড়ই শান্তি আর তুরীয় আনন্দের মধ্যে কাল-যাপন করিতেছেন, তাহাদের কারও কোনও সমস্যা নাই, কোনও ঘরে বেকারি নাই, খাদ্যাভাব নাই, বিনি পয়সার চিকিৎসায় সর্ববিধ রোগ রাজমহল পাহাড়ের উত্তরে ভাগলবা হইয়াছে, ইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলিতেছে সরস্বতীর নিত্য আরাধনা, চতুর্দিকে নিত্যনতুন কল-কারখানা তৈরি হইতেছে, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করিতে করিতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভারতবর্ষের মধ্যে সবচাইতে অগ্রসর রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ আত্মপ্রকাশ করিয়াছে সেই কবে, সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে কেরল আজ অনেক পিছনে, দুর্জনেও কহিতেছে কলকাতার লন্ডন, দীঘার গোয়া আর হিমালয়ের তরাই অঞ্চল সুইৎজারল্যান্ডে রূপান্তরিত হওয়া এখন শুধু কয়েক প্রহরের অপেক্ষা। অনতিকালের মধ্যেই মার্কিন মুলুকের পঞ্চাশটি স্টেটের যে কোনও একটির সঙ্গে পাল্লা দিতে চলেছে সুজলা, সুফলা, শস্য-শামলা, রূপ-রসের সুষমা মণ্ডিত, দুগ্ধবতী, স্বাস্থ্যবতী, স্বয়ং ভগবতী আমাদের এই সুন্দরী বাংলা।
এমন অনুকূল সমীরণে রাজ্যের কয়েকটি জেলার মানুষের আরও শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বাহাদুর একটি মহতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। উপস্থিত পাঁচটি জেলাকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করিয়া মোট বারোটি জেলায় পরিণত করা। ইহাকে কেন্দ্র করিয়াই সেই সব স্থানে কারা যেন অযথা কোলাহল শুরু করিয়াছে, কোথাও পুরবাসীগণ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছেন তো কোথাও ‘মানছি না মানব না’ হুক্কারব আবার কর্ণগোচর হইতেছে আমাদের এই রামরাজ্য বামমুক্ত হওয়ার পরে, এই প্রথম। হঠাৎ উথলিয়া উঠিতেছে আহত, বিক্ষুব্ধ এবং বেয়াদপ প্রজাদিগের ঠুনকো আবেগ। ইহারা মূর্খ, কেন না এরা বিস্মৃত হইয়াছে রামরাজ্যে দু’টি জিনিসই নিষিদ্ধ — প্রতিবাদ আর আবেগ। সরকার বাহাদুরের কর্ণকুহরে এই আবেগ প্রতিধ্বনিত হইলে যে কী প্রলয় কাণ্ড বাধিয়া যাইবে তাহারই আশঙ্কায় নিদ্রা ছুটিয়াছে রামরাজ্যবাসীর। সরকার বাহাদুর যেমন প্রজার দুয়ারে উপস্থিত হইয়া লক্ষ্মীর ভাণ্ডার খুলিয়া দিতে পারে তেমনি অবাধ্যজনকে সবক শেখাতেও যে কালবিলম্ব করিবে না, এই সহজ সত্যটুকু তো প্রতিবাদীজনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাই হওয়ার কথা। নাগপুরের নির্দেশে এইসব খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদ হইতেছে সরকার বাহাদুরের এমনতরো প্রচার শুরু হইল বলে! শুরু হইল বলে রামরাজ্যের অকল্যাণকারীদের বাপ-বাপান্ত।
অকল্যাণকারীরা জানিতে উৎসুক যে জেলার বুকে ছুরি চালানো হইতেছে তাহার নাগরিকের কি এ বিষয়ে কিছুই বলার থাকিতে পারে না? সংবিধান সরকারকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়াছে বলিয়াই কি যখন খুশি, যেমন খুশি তা প্রয়োগ করিতে হইবে? একটি জেলা যে কেবল প্রশাসনিক মানচিত্রে চিহ্ণিত ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়, তার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কার, পরম্পরা আবেগ থাকিতে পারে এবং জেলাবাসী সে সব সগৌরবে তা নিজেদের অন্তঃস্থলে অতি যত্নে ধারণ ও লালন করতে পারেন, এর কি কোনও মূল্যই নাই? সরকার বাহাদুরকে সব কথা জানিতে হইবে না কিন্তু জেলাবাসীর আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা করার আগে যাঁরা এ সবের খোঁজ খবর রাখে তাদের সঙ্গে আগাম পরামর্শ তো করাই যায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হইয়াছে তাও অনেককাল হইয়া গেল, শাসকের জমিদার-সুলভ মনোভাবে কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। শাসক ভুলিয়া যায় নির্বাচনে তাকে জয়যুক্ত করা হইয়াছে জনতা-জনার্দনের সেবা করার জন্য, শাসককে সেবা করার কোনও দায়ই নেই নাগরিকের। ভোটের সঙ্গে রাজ্যের জমির ইজারা পাঁচ বছরের জন্য তার হাতে সমর্পিত হয়নি এই বোধ অন্তর্হিত হলেই শাসক এমন কাজ করে বসে প্রজাকূল যা কিছুতেই মানিতে পারে না। সাম্প্রতিক জেলা-বিভাজন নিয়ে সংশ্লিষ্ট নাগরিকেরা যে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছেন তাহা অবশ্যই সংবেদনহীন সরকার বাহাদুরের কৃতকর্মের ফল।
গতকাল এই স্তম্ভে শান্তিপুরবাসীর অশান্তির কারণ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হইয়াছে, এ ক্ষণে বাঁকুড়া ও মুর্শিদাবাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। তাহাদের জেলা বিভাজনের প্রতিবাদে বাঁকুড়াবাসী চোয়াল শক্ত করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ হইতেছেন, নিজেদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করিয়াছেন, তৈরি হইয়াছে ফেসবুকের প্রতিবাদী পেজ যেখানে স্থানীয় বুলিতে প্রাণ ঢেলে গান গাইতে দেখা যাচ্ছে এক প্রান্তিক মানুষকে, দেখা যাচ্ছে অনেক তির্যক মন্তব্য, যে কোনও মূল্যে জেলা বিভাজন রুখিয়া দিবার সোচ্চার প্রত্যয় শোনা যাইতেছে বাঁকুড়াবাসীর কণ্ঠে। সেখানে এক প্রস্ত গোলমাল ক্রমেই অনিবার্য হইয়া উঠিতেছে।
তুলনায় মুর্শিদাবাদের ত্রিখণ্ডিত হওয়া নিয়ে প্রতিবাদ এখনও সে ভাবে সংগঠিত হয় নাই, অচিরে হইতে পারে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। কাগজে কলমে মুর্শিদাবাদ নামটি অবলুপ্ত হয় নাই তবে বিভাজনের পরে তাহার বিবর্ণ চেহারাটি দাঁড়াবে প্রতিপদের আকাশে চাঁদের ফালির মতো সরু সুতার ন্যায়। ভারতবাসী, মায় বিদেশেও পশ্চিমবঙ্গের পরিচিতি যে কয়টি নামের জন্য, তার একটি সুন্দরবন হলে অন্যটি অবশ্যই মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদকুলি খানের নাম বহন করা এই জেলার পায়ে পায়ে ইতিহাস, কোম্পানি আমল শুরু হইবার পূর্বে মুর্শিদাবাদই ছিল বঙ্গদেশের রাজধানী। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার তখতও ছিল এইখানে। এই জেলার পলাশিতেই মীরজাফরের সহায়তায় রবার্ট ক্লাইভ উড়াইয়াছিলেন ইউনিয়ান জ্যাক। এ বার এক স্বদেশি, স্বজাতি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে গৌরবহানি হইতে চলিয়াছে মুর্শিদাবাদের, ইতিহাসের এমন লাঞ্ছনা স্মরণকালে বঙ্গবাসী অন্যত্র কোথাও দেখিয়াছে কি?


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

