Wednesday, October 30, 2024

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৯)

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

পার্থ ভট্টাচার্য বাজে কথা বলার মানুষ ছিলেন না। তবু কখনও সখনও কোনও একটা খবর শুনলে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, এ অসম্ভব, হতেই পারে না। আমার বাধো বাধো ভাব দেখে পার্থবাবু বললেন, ‘বুঝতে পারছি বিশ্বাস করতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু আজ বাদে কাল যখন খবরটা ফাঁস হয়ে যাবে আমাকে দোষ দিও না।’

খবর তো নয় সাক্ষাৎ ভূমিকম্প যেন। জুতো বিক্রি করা বাঙালি কোম্পানির মুক্তিপণের টাকার একটা অংশ দুবাই, রাওয়ালপিন্ডি ঘুরে নিউইয়র্কে আটার কাছে পৌঁছেছিল। আটা কে? ছিনতাই করা প্রথম যে যাত্রিবাহী বিমানটি টুইন টাওয়ারের একটি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল তার পাইলটের নাম ছিল আটা। মিশরের যুবা, বয়স ৩৩, আত্মঘাতী আল কায়দা জেহাদি। তার মানে অপহরণ রহস্য আর একটু অনাবৃত হলে বোঝা গেল আসিফ-আফতাব গ্যাং স্বদেশি দুষ্কৃতী হলেও পাকিস্তানি ও আফগান জেহাদিদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। অপরাধের এমন হাড় হিম করা ব্যাপ্তি তার আগে কলকাতা শোনেনি। সেই কারণেই খবরটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল।

এই আন্তর্জাতিক সংযোগের গোড়াতে পৌঁছতে হলে আমাদের একবার দিল্লির তিহার জেলে ঢুঁ মারতে হবে। নব্বইয়ের দশকে একটা সময় এক ত্রিমূর্তি কাকতালীয় ভাবে একসঙ্গে এখানে বন্দি ছিল। ১৯৯৪ সালে আসিফ রেজা খান দিল্লিতে গ্রেপ্তার হয় বিস্ফোরক সমেত, টাডা বন্দি হিসেবে তার ঠিকানা হয় তিহার। খুনের চেষ্টার অপরাধে ১৯৯৫-এর জুলাইয়ে দিল্লিতেই আফতাব আনসারিও ধরা পড়ে তিহারে যায়। এদের দু’জন পৌঁছনোর আগে থেকেই তিহারে উপস্থিত ছিল ওমর শেখ, আদতে পাকিস্তানি হলেও তার ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, দিল্লির কনট প্লেস এলাকা থেকে দু’জন ইংরেজ ট্যুরিস্টকে অপহরণের ঘটনায় সে গ্রেপ্তার হয়। টাডার সঙ্গে তার বিরুদ্ধে লাগু হয় বিদেশি আইনও। এখানেই ত্রিমূর্তির মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তিন জনেরই মনে হয় একে অন্যের কাজে লাগতে পারে।

পার্থবাবু বলেছিলেন, ‘জেলের ভিতরে এদের তিন জন যে রোজ দেখা সাক্ষাৎ করত তা নয়। সে ব্যাপারে তারা সতর্ক ছিল। তাদের কথাবার্তা হতো বাসে, জেল থেকে আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার সময়, আদালতে অপেক্ষারত অবস্থায়। মুক্তির পরে জামিনের শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আফতাব দুবাই পালিয়ে যায়, সেখান থেকে করাচিতে সে নিয়মিত যাতায়াত করত। ২০০২-এর জানুয়ারিতে আমেরিকান সেন্টারে সন্ত্রাসী হানার পরে আনসারি রীতিমতো আস্ফালন করে দায়িত্ব স্বীকার করে। ঠিক তার পরের দিনই দুবাই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দেয়। দিল্লি, গুজরাত ঘুরে তাকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরে গত প্রায় বিশ বছর যাবৎ আফতাবের ঠিকানা প্রেসিডেন্সি জেলের হাই সিকিওরিটি সেল। কিছুকাল পরে মুক্তি পায় আসিফ রেজা খান, সে এদেশেই থেকে যায় আফতাবের ফ্রন্ট-ম্যান হিসেবে কাজ করবে বলে। সেই তৈরি করে অপহরণ চক্র। আর ওমর শেখ?

ঘটনাচক্রে সে মুক্তি পায় ভিআইপি হিসেবে। ছিনতাই হওয়া ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস বিমানের যাত্রীদের বাঁচাতে এদেশে বন্দি যে তিন জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসীকে মুক্তি দিয়ে ভারত সরকার জামাই আদর করে বিশেষ বিমান চড়িয়ে কান্দাহারে পৌঁছে দিয়েছিল, এই ওমর শেখ তাদেরই অন্যতম। শুধু এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, পাকিস্তানি জেহাদিদের কাছে ওমরের গুরুত্ব ছিল কতখানি।

বিলেতে বড় হওয়া, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসের ছাত্র ওমর জেহাদি হয়ে যায় লন্ডনে থাকতেই। পাকিস্তানে গিয়ে সে ধীরে ধীরে জইশ-ই-মহম্মদের নেতা মৌলানা মাসুদ আজহারের দক্ষিণ হস্ত হয়ে ওঠে।

কান্দাহারগামী বিমানে ওমরের সঙ্গে তার গুরু মাসুদ আজহারও ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দাদের খবর কান্দাহারে পৌঁছনোর পরে সে আল কায়দার দিকে ঝুঁকে পড়ে, বেশ কয়েকবার দেখা করে তালিবান নেতা মোল্লা ওমরের সঙ্গে। কলকাতার মুক্তিপণের টাকার একটা অংশ ওমরই নিউ ইয়র্কে পাঠায় মহম্মদ আটার অসংখ্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কোনও একটিতে। ভারতীয় মুদ্রায় ৪৭ লাখ টাকা। মুক্তিপণের টাকা দুবাই হয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে পৌঁছেছে আফতাবের পাঠানো ই-মেইল ইনটারসেপ্ট করে। গোয়েন্দারা তা জানতে পারে। যেমন একটি ই-মেইলে আসিফ রেজা খানকে আফতাব লিখছে, ‘ভাই ম্যায়নে তো এক লাখ ডলার শেখ ওমর কো দে দিয়া হ্যায়।’ এ কথা জানার পরে এফবিআই নেমে পড়ে তাদের মতো করে তদন্ত করতে। ততদিনে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, মহম্মদ আটার নাম তখন এফবিআইয়ের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ওই ছিনতাই হওয়া বিমানে যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কিন নাগরিক, তাঁর তত্ত্ব-তালাশও তখন জরুরি হয়ে উঠেছিল।

দিন গেলে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে খাদিম কর্তার অপহরণ সম্পর্কে সীমানার ওপারের জেহাদিরা কেবল ওয়াকিবহাল ছিল না, অস্ত্র সংগ্রহ, গাড়ি কেনা, ইত্যাদি আনুষঙ্গিক বিষয়ে তারা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। পুলিশের কাছে দেওয়া সংশ্লিষ্ট জঙ্গিদের আলাদা আলাদা করে দেওয়া জবানবন্দি পাশাপাশি রাখলে সেই বৃহত্তর ছবিটাই ফুটে ওঠে।

যেমন আসিফ পুলিশের কাছে কবুল করেছিল পার্থ রায়বর্মন-সহ এ দেশের আরও বেশ কয়েক জন বিত্তশালীকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০০১-এর গোড়াতেই। তারপর সে প্রথমে বাংলাদেশে যায়, সেখানে একটি ছাত্র সংগঠনকে ১৫ হাজার টাকা দেয়। তারপর মহম্মদ খালিক নাম নিয়ে জালি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সে পৌঁছয় করাচিতে। বিমানবন্দর থেকেই জনাকয়েক আইএসআই এজেন্ট তাকে সোজা ওমরের বাড়িতে নিয়ে যায়। লস্কর-ই-তৈবার নেতা আজম চিমার সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়। পাকিস্তানি জঙ্গিদের মধ্যে কারা কারা অপহরণের দলে থাকবে, কী কী কাজ হবে তাদের আসিফের এই সফরেই তা চূড়ান্ত হয়।

যেমন কুখ্যাত জঙ্গি আকিব আলি খান। ভোপালের এক গোপন আস্তানা থেকে সে বছর নভেম্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেরায় আকিব স্বীকার করে সে লস্করের সদস্য, একবার পাকিস্তানের বাহওয়ালপুরে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরেও সে যোগ দিয়েছিল। যেমন আসলাম মহম্মদ, আর এক লস্কর সদস্য, অপহরণের সময় পার্থবাবুর পায়ে সেই গুলি চালিয়ে ছিল। আফগানিস্তানের খোস্ত-এ প্রশিক্ষণ নিলেও তার মূল আনুগত্য হারকাত-উল-জেহাদি ইসলামের প্রতি।

প্রথমে খাদিম কর্তার অপহরণ, তারপরে আমেরিকান সেন্টারে হামলা, এই দুই ঘটনার পরে সিবিআইকে মাথায় রেখে দেশের ছ’টি রাজ্যের পুলিশ একযোগে তদন্তে নেমেছিল রহস্য উদ্ঘাটনে। তাতে একদিকে যেমন কুখ্যাত পাকিস্তানি জঙ্গির সন্ধান মিলেছিল অন্যদিকে তেমনি এমন সব অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল যা প্রশিক্ষণ পাওয়া পোক্ত জঙ্গি ছাড়া এলি-তেলি গুন্ডাদের দ্বারা ব্যবহার করাই অসম্ভব। যেমন আরও অনেক কিছুর সঙ্গে উদ্ধার হয়েছিল তিনটি এ কে ফিফটি সিক্স অ্যাসল্ট রাইফেল, ১৮ কিলো আর ডি এক্স, কুড়িটি আই ই ডি ডিটোনেটর ইত্যাদি। অপহরণ ও আক্রমণ দুই ভয়াবহ কাণ্ডে শেষ পর্যন্ত যারা গ্রেপ্তার হল তাদের মধ্যে অন্তত ছ’জন পাকিস্তানি জঙ্গি।

অপহরণ ও মুক্তি এই দুয়ের মাঝখানে উত্তেজনা যখন চরমে, কমিক রিলিফের মতো এল বাঙালি নর্তকীর গ্রেপ্তারের খবর। স্বাতী পাল। মুম্বই এবং দুবাইয়ের ডান্সবারে নাচত, সেই সুবাদে আনসারির সঙ্গে পরিচয়। পুলিশের অভিযোগ ছিল অপহরণ কাণ্ডের পরেও আনসারির সঙ্গে স্বাতীর যোগাযোগ ছিল। সিআইডি-র হেফাজতে সুন্দরী নর্তকীকে দেখে বেজায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল ভবানী ভবনে। সেদিন সিআইডি বিট কভার করা সহকর্মী সন্ধেবেলায় অফিসে ফিরলে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটিকে দেখতে পেলি?

অপহরণ ও মুক্তি এই দুয়ের মাঝখানে উত্তেজনা যখন চরমে, কমিক রিলিফের মতো এল বাঙালি নর্তকীর গ্রেপ্তারের খবর। স্বাতী পাল। মুম্বই এবং দুবাইয়ের ডান্সবারে নাচত, সেই সুবাদে আনসারির সঙ্গে পরিচয়। পুলিশের অভিযোগ ছিল অপহরণ কাণ্ডের পরেও আনসারির সঙ্গে স্বাতীর যোগাযোগ ছিল। সিআইডি-র হেফাজতে সুন্দরী নর্তকীকে দেখে বেজায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল ভবানী ভবনে। সেদিন সিআইডি বিট কভার করা সহকর্মী সন্ধেবেলায় অফিসে ফিরলে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটিকে দেখতে পেলি?

কী বলল?

‘চিনি দেওয়া চা, ফুঁ দিয়ে খা’। (চলবে)

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article