- August 17th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৫)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
খারিজি মাদ্রাসার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, তার আগেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অন্য একটি বিষয়ে দু’পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে আসতে হয়েছিল। সংগঠিত সন্ত্রাস রুখতে আইন প্রনয়ণ। প্রিভেনশান অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট, সংক্ষেপে যার নাম হয়েছিল ‘পোকা।’
আইন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, রাজ্য মন্ত্রিসভা সেটা অনুমোদন করেছিল, বিধানসভায় পাশ হয়েছিল কিনা এতদিন পরে আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে সিপিএমের শরিককুল একযোগে হুক্কাহুয়া করে উঠেছিল, দলীয় সহকর্মীরাও মুখ্যমন্ত্রীকে নিরস্ত করতে তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘পোকা’ চালু করলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পোটা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন অর্থহীন হয়ে পড়বে, অতএব ক্ষ্যামা দাও।
আবার সেই প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তার মাঝখানে বলি প্রদত্ত সদিচ্ছা সম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত ‘পোকা’ আইনের খসড়াটি আমি তখন বেশ মন দিয়ে পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল কেন্দ্রের ‘পোটা’-র (প্রিভেনশন অব টেররিজম অর্ডিনান্স) সঙ্গে রাজ্যের এই আইনের ফারাক বিস্তর। ‘পোটা’ ছিল আক্ষরিক অর্থেই দানবীয় আইন, কেন না সেখানে বিনা বিচারে অভিযুক্তকে বন্দি করে রাখার ব্যবস্থা ছিল। বুদ্ধবাবুর ‘পোকা’-য় তা ছিল না। এই আইনের মূল লক্ষ্য ছিল অপহরণ, হাইজ্যাকিং এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থান।
অভিযুক্তকে ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত রাখার কথা ছিল না। তবু শেষ রক্ষা হয়নি এই প্রগতিশীল রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের কথা শুনলেই যাদের তলপেটে ব্যথা শুরু হয় তাদের জন্য।
কেন্দ্র যখন সন্ত্রাস দমনে আইন করছেই তখন আপনার আগ বাড়িয়ে রাজ্যের জন্য পৃথক আইন করার কী প্রয়োজন? কথায় কথায় মুখ্যমন্ত্রীকে একবার জিজ্ঞেস করে বসেছিলাম। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই জবাব দিলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের অধিকারভুক্ত বিষয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দাদাগিরি আমরা মানতে যাব কেন? আরে বাবা কেন্দ্রের ভয়ঙ্কর আইন মানা যাবে না বলেই তো রাজ্যের আইন আনতে চাইছি। যা অনেক বেশি মানবিক এবং সময়ের পক্ষে যথোপযুক্ত। সংগঠিত সন্ত্রাস যে প্রশাসনের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে এটা মানেন তো?’
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তাগিদের উৎসে ছিল এই উপলব্ধি যে, দেশে যে সব আইন চালু আছে তা দিয়ে এই নয়া সন্ত্রাসের মোকাবিলা অসম্ভব। অর্থাৎ রোগ যেমন দাওয়াই তেমনটিই হওয়া উচিত। এর সঙ্গে যে মানবাধিকারের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত কিংবা সন্ত্রাসীরও নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার সুযোগ পাওয়া উচিত, বুদ্ধবাবু মনে করতেন, এই সব বিষয় নিয়ে সেমিনার-আলোচনা সভা জমে উঠতে পারে, রাজ্য প্রশাসনের কাছে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সব প্রশ্ন তুলনায় অতি গৌন। একা বুদ্ধবাবু ভাবলে কী হবে নিজের দল আর বামফ্রন্টের শরিককুল, সব্বাই তাঁর সুরে সুর মেলালে তবে না! সেটা হওয়ারই জো ছিল না। ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস। ম্যানের জায়গায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বসান। আর ‘গড’-টা যে কে তা তো আপনারা সবাই জানেন।
পারলে একবার ২০০১-এর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখুন, না পারলে মনে করার চেষ্টা করুন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের কদর্য চেহারাটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। সে বছর ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক শহর তা দেখেছিল। বিস্ময় আর ভীতিতে বিহ্বল হয়ে নিউ ইয়র্কবাসী দেখল দু’টি যাত্রীবাহী বিমান একের পর এক এসে ধাক্কা মারল শহরের সবচেয়ে গর্বের ইমারত টুইন টাওয়ারে। আকাশে তৈরি হল আগুনের বিশাল গোলা। তারপর হুড়মুড় করে ভাঙতে ভাঙতে মাটিতে মিশে গেল টুইন টাওয়ার। কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হল। অচিরেই দুনিয়া জানতে পারল এমন অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড লুকিয়ে আছে আফগানিস্থানের দুর্গমতম তোড়াবোড়ার গুহায়। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা, নিষ্পাপ মুখ, ঝোলা দাড়ি, হাতে ছড়ি। সেদিন থেকেই যীশু খ্রীষ্ট আর মহম্মদের পরেই দ্যুলোক-ভূলোক-গোলকে সবচেয়ে পরিচিত নামটি হয়ে দাঁড়াল ওসামা বিন লাদেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাঘাত শুরু করল আমেরিকা, সূচনা হল বিশ বছর যুদ্ধের।
ঠিক তিন মাস পরেই পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা আক্রমণ হানল নয়াদিল্লিতে ভারতের সংসদ ভবনে। ভিতরে চলছে জমজমাট অধিবেশন, বাইরে গুলির লড়াই সংসদ ভবনের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের। যে পরিমাণ বিস্ফোরক সঙ্গে নিয়ে সেদিন তারা এসেছিল ভিতরে ঢুকে তার কিয়দাংশ ব্যবহার করতে পারলে হয়তো টুইন টাওয়ারের হালই হতো সংসদ ভবনের। হয়নি যে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জান বাজি রেখে লড়াই করা নিরাপত্তারক্ষীদের। সেদিন এক লহমায় ঘুচে গিয়েছিল সরকার আর বিরোধীদের দূরত্ব। এই হাড় হিম করা ঘটনার পরে সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যে অসাধারণ ভাষণটি দিয়েছিলেন এত বছর পরেও তার অংশ বিশেষ আমার স্মরণে আছে। বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘এই ঘটনার পরে কে আমায় প্রথম টেলিফোন করেছিলেন জানেন? সনিয়া গান্ধী। যে দেশে বিপদের মুহূর্তে বিরোধী নেত্রীর প্রথমেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা মনে পড়ে, তাঁর কুশল জানতে তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, হাজার সন্ত্রাসী এসেও সে দেশের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই আত্মাটির নাম গণতন্ত্র, যার ভাগ্যবান প্রহরী হিসেবে আমরা প্রত্যহ এখানে জমায়েত হই।’
আড়ে-বহরে কোনও তুলনাই চলবে না। তবে ওই একই বছরে সংগঠিত সন্ত্রাসের প্রথম ছায়াপাত হয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গেও। সে বছর ২৫ জুলাই বিধাননগরের বাড়ি থেকে সংস্থার জুতো তৈরির কারখানায় যাওয়ার পথে হঠাৎ অপহৃত হন খাদিম কর্তা পার্থ রায়বর্মন। অচিরেই স্পষ্ট হয়ে যায় এত বড় একটা কাণ্ড স্থানীয় দুষ্কৃতীরা একা ঘটায়নি, এদের পিছনে মদত আছে সীমানার ওপারের ষড়যন্ত্রীদের। টানা বেশ কয়েক দিন রোমহর্ষক নাটক চলার পরে পার্থবাবুকে মুক্তি দেওয়া হয় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনও একটি গ্রাম থেকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ২০০২-এর জানুয়ারিতে হঠাৎ জওহরলাল নেহরু রোডের আমেরিকান সেন্টারে হল জঙ্গি-হানা। রাজ্যবাসীর মনে এই আশঙ্কা ঊঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল, তাহলে কি মুম্বইয়ের মতো কলকাতাও হয়ে উঠছে সন্ত্রাসীদের পছন্দের ঠিকানা? এরই মাঝে অপহৃত হলেন শহরের এক পরিচিত বাঙালি কর্পোরেট কর্তা। মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পরেও কলকাতার মিডিয়া জানতে পারেনি তাদের অলক্ষ্যে এই শহরেই খাদিম-২ হয়ে গিয়েছে। পোকা শেষ পর্যন্ত হুল ফোটাতে পারুক আর না পারুক মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়ন ও দাওয়াই দু’টোই যে সঠিক ছিল তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে কি? (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

