- August 16th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-২)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
এই একটি ঘটনাকে উপেক্ষা করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার সুসম্পর্কের ইতিবৃত্ত শুরু করা অসম্ভব। ঘটনাটির কথা আমি আগেও বলেছি, ছাপার অক্ষরে বইতে গ্রথিতও আছে (শিয়রে সুমন, সঙ্গে শুভাশিস মৈত্র, প্রকাশক ধানসিঁড়ি)। তবু অধিকন্তু নঃ দোষায়!
সঠিক দিনক্ষণ এতদিন পরে স্মরণে নেই, ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছুকাল পরেই। আমি মর্নিং ডিউটিতে বেরিয়েছি, ছেলেকে ইস্কুলের দরজায় নামিয়ে দেওয়ার। শত ব্যস্ততার মধ্যেও কলকাতায় থাকলে এই কাজটিতে আমি কখনও ফাঁকি দিইনি, প্রথমে মেয়ে তারপরে ছেলের ক্ষেত্রে। স্বামী হিসেবে নির্ঘাত আমি দশে গোল্লা পাব, তার চেয়ে কমও পেতে পারি কিন্তু বাবা হিসেবে সবচয়ে কৃপণ পরীক্ষককেও আমায় ফুল মার্কস দিতে হবে। হবেই।
ছেলের সঙ্গে খুনসুটির মধ্যে হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। প্রথম যুগের নোকিয়া কোম্পানির মোবাইল, থান ইটের মতো চেহারা এবং ভারী।
‘আমি বুদ্ধদেব বলছি।’ দৃঢ় অথচ আন্তরিক কণ্ঠস্বর। আমি ভাবতে শুরু করলাম এ কোন বুদ্ধদেব। ‘কিছু মনে করবেন না, আমি কম করেও জনা তিনেক বুদ্ধদেবকে চিনি, আপনি তাদের মধ্যে কোনজন, নাকি তাদের বাইরে আমি ঠিক ঠাওর করতে পারছি না।’
‘আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছি।’
প্রথমেই মনে এল স্বপ্না প্রিন্টার্সের মালিকের কথা। তিনিও বুদ্ধদেব এবং ভট্টাচার্য। কিন্তু তাঁর গলা তো এ রকম নয়! আমার অস্বস্তি আর বিভ্রান্তি দু’টোই চরমে।
‘আমি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছি, এ বার চিনতে পারছেন?’
ভাগ্যিস আমি নিজে গাড়ি চালাচ্ছিলাম না, চালালে সেই মুহূর্তে একটা বিচ্ছিরি দুর্ঘটনা ঘটতই ঘটত। এটা ছিল তখনও পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ফোন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোন করলেও সম্ভবত আমি এতটা অবাক হতাম না। অহি কখনও নকুলকে ফোন করে নাকি? পাগল না লোকদল?
প্রথম বলেই মিডলস্টাম্প ছিটকে গেলে ব্যাটসম্যানের মুখের চেহারাটা যেমন দেখায় সেই মুহূর্তে আমাকে নিশ্চয় তেমনই দেখাচ্ছিল। ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি আমাকে ফোন করবেন, তাও এত সকালে, আমার মোবাইল নম্বরে, আমি ভাবতেই পারিনি। তাই আমার একটু ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।’
ওপার থেকে ক্ষণিকের চাপা হাসির আওয়াজ। তার পরেই কোনও রকম গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই একেবারে কাজের কথায়। ‘একটি সেনসিটিভ বিষয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে ফোন করেছি। আপনাদের কাগজে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় কেএলও অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে যা লিখে চলেছেন তাতে আমাদের একটু অসুবিধে হচ্ছে। লেখা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, সেটা আপনাদের স্বাধীনতা। কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আপনি এলে সামনা সামনি বিষয়টি আমি ব্যাখ্যা করতে পারি।’
‘কবে কোথায় যাব বলুন!’
‘আজই আসুন, বিকেল চারটেয়, রাইটার্সে।’
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের গোপন আস্তানায় গিয়ে তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছি।নাম শুনলে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে এমন জঙ্গি নেতা গুলবদিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে দেখা করেছি পেশোয়ারে, করাচির ক্লিফ্টন এলাকায় ভুট্টো পরিবারের প্রাসাদে গিয়ে দর্শন পেয়েছি বিবি বেনজির ভুট্টোর, আরকানস-র লিটল রকে ১৯৯৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভোটের জনসভায় গিয়ে বিল ক্লিন্টনের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছি। এ সবেও রোমাঞ্চ ছিল, যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। তবু প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট থেকে রাইটার্স, এই আধা কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার সময় শরীরে-মনে ভিন ধরনের একটা শিহরণ খেলে গেল। মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সকাশে আমি! ভাবা যায়!
কথা হলো মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের লাগোয়া অ্যান্টি চেম্বারে বসে। নিরাভরণ ঘর, দু’পাশের দেওয়াল লাগোয়া সারি সারি সোফা। মুখ্যমন্ত্রীর বসার চেয়ারটি সেই সোফাগুলির দিকে মুখ করে। কেএলও জঙ্গিদের নিয়ে সমস্যাটা কী ও কেন, প্রায় মিনিট পনেরো ধরে বুদ্ধবাবু তা ব্যাখ্যা করলেন, তথ্য আর পরিসংখ্যান দিয়ে। রীতিমতো গোপনীয় সব তথ্য, এক্কেবারে ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন। শত্রু ও সমালোচক বলে চিহ্নিত একজন কাগজওয়ালাকে মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ এতটা বিশ্বাস করে বসলেন কেন, তাও প্রথম সাক্ষাতে, আমার মাথায় ঢুকল না। আমার তরফে বিশ্বাসভঙ্গ করার কোনও প্রশ্ন ছিল না, করিওনি। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কী কথা হলো, খোদ সম্পাদককেও বিশদে জানাইনি। কেবল রঘু’দাকে ডেকে অনুরোধ করলাম কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ রিপোর্টে এড়িয়ে যেতে।
রাইটার্স থেকে অফিসে ফেরার সময় মনে হল, এই ভদ্রলোক একেবারে অন্য রকম, অন্য গোত্রের রাজনীতিক। আমার তরফে সেদিনই লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট, পরে ধীরে ধীরে যা ঊষ্ণ সম্পর্কে পর্যবসিত হল। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামির সেই সূত্রপাত।
শুধু কি আমি একা? আমার সাক্ষাতের বেশ কিছুদিন পরে সিমা আর্ট গ্যালারিতে একটি বড় প্রদর্শনী ছিল। সেটি উদ্বোধন করার আমন্ত্রণ বুদ্ধবাবু এক কথায় স্বীকার করে নিলেন। ঠিক হল, উদ্বোধন-পর্ব চুকে গেলে, গ্যালারির কোনও একটি ঘরে অভীক সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা যেন রেগন-গোর্বাচেভ সামিট। আমি অফিসেই থেকে গেলাম, সরকার-সরকার মোলাকাতে নিজেকে আদার ব্যাপারী মনে করে।
তার আগে বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে আমার সম্পাদকের কখনও দেখা হয়নি। অভীকবাবু দেখা করতে উৎসুক তেমনটিও আমার মনে হয়নি কখনও। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে সম্পাদকের ভালো পরিচয় ছিল, নিয়মিত যোগাযোগ ছিল অনিল বিশ্বাস কিংবা অশোক মিত্রের সঙ্গে। সিমা আর্ট গ্যালারিতে দু’জনের প্রথম সাক্ষাতের ঘটকালিটা যেহেতু আমি করেছিলাম তাই কিছুটা নৈতিক দায় তো ছিলই। আমার ভয় ছিল নিজের সম্পাদককে নিয়েই, কখন যে তিনি কী বলে বসবেন তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। এমন অনেক অস্বস্তিকর ঘটনা আমার সামনে হয়েছিল বলেই আমি কিঞ্চিৎ নার্ভাস ছিলাম। কে জানে হয়তো মুখ্যমন্ত্রীকে উনি মুখের ওপরে বলে বসবেন, ‘সবার আগে আপনাদের উচিত হবে দলের নামটা বদল করা। দেখতেই তো পাচ্ছেন গোটা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিজম এখন অচল আধুলি!’
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমার অফিসের ঘরে সম্পাদকের ফোন এল। কথায় ফেনিল উচ্ছ্বাস আর অনর্গল প্রশংসা। ভাবখানা এমন যেন দেং শিয়াও পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কোনও কিছু পছন্দ হলে উচ্ছ্বসিত অতিকথন ছিল অভীকবাবুর স্বভাব। কয়েক মিনিট তাঁর মুখে বুদ্ধ-স্তুতি শোনার পরে আমি বললাম, ‘আগে দেখুন ভদ্রলোক কতটা কী করতে পারেন, তার আগেই রায় দেওয়াটা ঠিক হবে না।’
সম্পাদক বেদম রেগে গেলেন। ‘তুমি কিস্যু বোঝ না, দিস ম্যান ইজ বেঙ্গলস লাস্ট হোপ’।
আমি চুপ মেরে গেলাম। কেন? না ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট।’ (চলবে)

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

