সুমন চট্টোপাধ্যায়
২০০১-এ তাঁকে নিয়ে সিপিএমের অন্দরে একটা কী হয়, কী হয় ভাব ছিল। হাজার হোক জ্যোতি বসুর জুতোয় পা গলিয়েছেন, মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তাঁর বিকল্প হিসেবে মানবে নাকি সিদ্ধান্তটি বুমেরাং হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো ছিলই। পাঁচ বছর পরে ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে সেই মানুষটিই উঠে এলেন মুখ্যমন্ত্রী পদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মুখ হিসেবে। মিডিয়া যার নাম দিল ‘ব্র্যান্ড-বুদ্ধ’।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের টেক্কা দিতে আমি এমন একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম যা তার আগে বা পরে কোনও বাংলা চ্যানেল করতে পারেনি। আমার আমন্ত্রণে দুই বিশিষ্ট ভোট বিশেষজ্ঞ কলকাতায় এলেন, প্রায় পক্ষকাল থাকলেন, অংশ নিলেন নির্বাচনী বিশ্লেষণে- যোগেন্দ্র যাদব আর মহেশ রঙ্গরাজন।
আমি যখন দিল্লিতে কর্মরত, মহেশের বাবা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি তখন অন্ধ্রপ্রদেশের কোনও একটি দৈনিকের দিল্লি চিফ অব ব্যুরো। সাদা খদ্দরের জামা প্যান্ট পরতেন, ষোলো আনা কংগ্রেসি। তাঁর একটি মারুতি গাড়ি ছিল, নিজেই চালাতেন। কংগ্রেস অফিসে যাওয়ার সময় আমিও তাতে সওয়ার হতাম। মহেশ তখন বিদেশে গবেষণা করে, ছেলেকে নিয়ে বাবার বিশেষ গর্ব ছিল। তারপর একদিন মহেশ দেশে ফিরল, যোগ দিল কলকাতার টেলিগ্রাফের দিল্লি ব্যুরোয়। রিপোর্টার হিসেবে নয়, সম্পাদকীয় পাতার সদস্য হয়ে। ধীরে ধীরে রাজনীতি আর ভোট বিশেষজ্ঞ হিসেবে মহেশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল। চ্যানেলে-চ্যানেলে আলোচনাসভায় ডাক পড়তে শুরু করল তার। যেমন সুন্দর কণ্ঠস্বর, তেমনি স্পষ্ট উচ্চারণ, তেমনি চমৎকার বিশ্লেষণী ক্ষমতা। অনেক দিন হল মহেশকে আর মিডিয়ায় দেখা যায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে লেখাপড়ার জগতের বাসিন্দা। দিল্লি থাকতেই মহেশকে একবার গল্পোচ্ছলে বলেছিলাম, আমি যদি কখনও টেলিভিশন করি তোমাকে ডাকবই। তার অনেক বছর পরে কলকাতা টিভি এনে দিল সেই সুযোগ। মহেশ এক কথায় রাজি হয়ে চলে এল কলকাতায়।
যোগেন্দ্র যাদবের পরিচিতি নিষ্প্রয়োজন। কেননা সে এমনিতেই ‘ফেমাস ফর বিয়িং ফেমাস’। আমার চার দশকের সাংবাদিক জীবনে দেখা সর্বোত্তম ভোট বিশেষজ্ঞ। হিন্দি, ইংরেজির সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাংলাও বলতে পারে। ওর সহধর্মিনীও বাঙালি। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে যোগেন অনেক কাল হল পুরো সময়ের রাজনীতিক। প্রথমে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ‘আপ’-এ যোগ দিয়েছিল, বেশি দিন টিকতে পারেনি। তারপর থেকে যোগেন প্রধানত উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, কেন্দ্রের কৃষি-বিল বিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ। অকাট্য যুক্তি আর তর্কাতীত তথ্য দিয়ে যোগেন যে কোনও বিষয় বিশ্লেষণ করে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনা ছাড়া উপায় থাকে না। যতদূর মনে পড়ে মহেশ আর যোগেনকে নিয়ে আমি গোটা সাতেক অনুষ্ঠান করেছিলাম, ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওর একটা সেট ভাড়া করে শুটিং হয়েছিল। মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয় এই সব অনুষ্ঠানের একটা ভিডিয়ো কপি কেন নিজের কাছে রেখে দিলাম না। আরও আক্ষেপ হয় এ কথা ভেবে যে মহেশ আর যোগেনকে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে বলে মালিকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রাখা হয়নি, বস্তুত একটি টাকাও নয়। এরপরে বহুকাল আমি চোরের মতো এই দুই প্রিয় বন্ধুকে এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়েছি।
আরও একটি প্রাক-নির্বাচনী অনুষ্ঠান শুরু করলাম, তার নাম দিলাম ‘বুদ্ধর বাংলা।’ নামকরণ নিয়ে বিরোধীদের তীব্র আপত্তি ছিল, আমি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। বুদ্ধদেবের প্রতি সে সময় আমার পক্ষপাত ছিল এতটাই অন্ধ। আমার সমর্থনের কারণে তাঁর বাড়তি কোনও লাভ হয়েছিল বলে মনে করি না। তবে আমার একটা তৃপ্তিবোধ ছিল, কায়মনোবাক্যে আমি চেয়েছিলাম বুদ্ধবাবু আবার মহাকরণে ফিরুন।
ভোটের আগে আমি দু-দু’বার মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, রাফাল-জোকোভিচের খেলার মতো জমেছিল সেগুলো। একজন সিপিএম নেতা ও মুখ্যমন্ত্রীকে যত রকম অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা সম্ভব তার একটিও আমি বাদ দিইনি। বেস লাইনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধবাবুও সব ক’টি বল আমার কোর্টে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এত দিনের সাংবাদিক জীবনে আমি কম লোকের সাক্ষাৎকার নিইনি, সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলে। বলের লাইনে পা নিয়ে এসে তিনি সর্বদা সোজা ব্যাটে খেলতেন, তাঁর স্টাম্প ছিটকে দেওয়া বড্ড কঠিন কাজ ছিল।
বামফ্রন্টই ফিরছে, সব ক’টি জনমত সমীক্ষায় তার ইঙ্গিত ছিল। আমাদের রিপোর্টারদের মূল্যায়নও ছিল তাই। বুদ্ধবাবু ফিরলেন তো বটেই, এমন হা হা রবে ফিরলেন যা কেউ প্রত্যাশা করেনি, একমাত্র বিমান বসু ছাড়া। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বিমানবাবু একেবারে অঙ্ক কষে সাংবাদিক বৈঠকে বলে দিতেন এ বার বামফ্রন্ট কত আসন পাবে। অঘোষিত উদ্দেশ্যটি ছিল যুদ্ধের ময়দানে নামার আগে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা। কিন্তু ২০০৬-এর ভোটের আগে তিনি অঙ্ক মিলিয়ে দিলেন অনেকখানি। ভোটের আগে তাঁর দাবি ছিল এ বার বামফ্রন্ট ১৯৮৭-র কাছাকাছি আসন পাবে। পেলও তাই। ‘৮৭তে পেয়েছিল ২৫১টি আসন, ২০০৬-এ পেল ২৩৫। এই সংখ্যাটি মুখ্যমন্ত্রীর অযথা আস্ফালনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেক পরে। পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটে সিপিএম খুইয়েছিল নিজস্ব একক গরিষ্ঠতা, এ বার তা ফিরে পেল। শুধু তাই নয়, ২০০১-এর তুলনায় বামফ্রন্ট জিতল ৩৬টি বেশি আসনে।
দল হিসেবে সিপিএম ব্যক্তির ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয় না, তাদের কাছে দলই সব, ব্যক্তি গৌণ। এমন হাস্যকর যুক্তির বিরোধিতা করে আমি অনেক লিখেছি, এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না। বস্তাপচা ধারণা আঁকড়ে রেখে আলিমুদ্দিনি বিপ্লবীরা যে ব্যাখ্যাই দিন, বামফ্রন্টের নেতৃত্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য না থাকলে ২০০৬-এ কিছুতেই তারা এমন চমকপ্রদ ফল করতে পারত না। বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান গণ-আস্থার ফলে বামফ্রন্ট লাভবান হয়েছিল, উল্টোটা নয়। সত্যটা হল পশ্চিমবঙ্গের কোনও ভোটে তার আগে বামফ্রন্টে নেতৃত্বের ভূমিকা এতটা নির্ণায়ক ছিল না যেটা বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে ওই একবারই সম্ভব হয়েছিল। তারপর থেকে অবশ্য নেতৃত্বই হয়ে গিয়েছে ভোটের একমাত্র নির্ণায়ক। ২০১১ থেকে উপর্যুপরি টানা তিনবার তৃণমূল কংগ্রেসের বাংলা দখল সম্ভব হয়েছে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। আবার মমতার সমকক্ষ কাউকে নেতৃত্বে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই বামফ্রন্ট গভীর গাড্ডা থেকে বের হতেই পারছে না। (চলবে)