সুমন চট্টোপাধ্যায়
ক্রমাগত অপমান সহ্য করতে না-পেরে ২০০৫-এর অক্টোবরে স্টার আনন্দ থেকে ইস্তফাই দিয়ে দিলাম। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি রাগের মাথায় কোনও সিদ্ধান্ত নিতে নেই, নিলে পস্তাতে হয়। কিন্তু রাগ যখন মাথায় ওঠে এসব হিতোপদেশ মাথায় থাকে না। ছেড়েছিলাম বলে আমার কোনও মনস্তাপ নেই, তবে এ কথা স্বীকার করতেও কুণ্ঠা নেই, আমার নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবনে দুর্যোগ আর অনিশ্চয়তার সেই শুরু। সতেরো বছর পরেও আমি যার থেকে মুক্তি পাইনি। আর কখনও পাবো বলেও আশা করি না।
কলকাতার দুই তরুণ কম্পিউটার ব্যবসায়ী তখন একটি বাংলা নিউজ চ্যানেল করার কথা ভাবছিল, আমার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে আমি এক কথায় রাজি হয়ে যাই। অপর্ণা সেন তখন সবে ‘সানন্দার’ সম্পাদনা ছেড়েছেন, তাঁকে নিয়ে আসি। স্টার আনন্দ থেকে জনা ষাটেক সহকর্মী গণ-ইস্তফা দিয়ে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। শহর-জুড়ে আমার আর অপর্ণা সেনের হোর্ডিং দৃশ্যমান হয়। ক্যাচলাইন ‘আমরা ছাড়া খবর হয় না।’
চ্যানেলের নাম হল কলকাতা টিভি। এই নামটি যাতে আমাদের না দেওয়া হয় সে জন্য সরকার বাড়ি কম চেষ্টা করেনি। একে তো কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে আমার বিরুদ্ধে চিঠি লেখা হয়, অন্যদিকে এই যুক্তি খাড়া করা হয় যে শহরের নামে চ্যানেলের নামকরণ করা উচিত নয়। আমার কপাল ভালো, সে সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। দিল্লি উড়ে গিয়ে আমি তাঁকে বোঝালাম, নিউ দিল্লি টেলিভিশন (সংক্ষেপে যার নাম এন ডি টিভি) যদি থাকতে পারে তাহলে কলকাতার নামে চ্যানেল থাকলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়। প্রিয়দা আমার যুক্তি মানলেন, বিভাগীয় সচিব যিনি ‘সরকারি’ চাপে গড়িমসি করছিলেন, তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দিলেন চ্যানেলের নাম কলকাতা টিভি-ই হবে।
কলকাতা টিভি-র মতো এত ঢাকঢোল পিটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আর কোনও চ্যানেলের সূচনা হয়নি। তেজেন মজুমদার চ্যানেলের সিগনেচার টিউনটি সৃষ্টি করলেন, সোহাগ সেনকে ধরে বেঁধে আনা হল ক্যামেরার সামনে যারা থাকবে তাদের উচ্চারণ শেখাতে। সবার ওপরে অপর্ণা সেন তো রইলেনই। আমার নিজের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল ছয় মাসের মধ্যে চ্যানেলটিকে এক নম্বরে নিয়ে যাব। যদিও সে সুযোগ আমি পাইনি বা আমাকে পেতে দেওয়া হয়নি। চ্যানেলের মালিকগুলো যে আসলে বাটপার গোড়ার দিকে আমি তা বুঝতেই পারিনি। ২০০৬-এর গ্রীষ্মে অকস্মাৎ একদিন দেখলাম ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি, নাঙ্গা ফকির, ডাইনে বাঁয়ে কেউ নেই।
কলকাতা পুরসভার ভোট ছিল স্টার আনন্দের সামনে প্রথম বড় ইভেন্ট। কলকাতা টিভিতে পেলাম আরও বড় ঘটনা, ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন। আনন্দবাজার ছাড়ার পর থেকেই বুদ্ধবাবুর সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, স্টার আনন্দে থাকাকীল তেমন উপায়ও ছিল না, কলকাতা টিভি-তে এসে আবার সম্পর্কের পালে নতুন হাওয়া লাগল। এতদিন যেখানে কাজ করেছি সেখানে ভোট এলেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে তেমনটা লেখাই রেওয়াজ ছিল। এমনকী যে কেন্দ্রে কংগ্রেস অথবা তৃণমূল কংগ্রেস লাখ দুয়েক ভোটে হারবে সেখানেও। কলকাতা টিভিতে এসেই প্রথম স্বাধীনভাবে ভোট কভার করার স্বাধীনতা পেলাম, মিটিং ডেকে সব সহকর্মীকে বলে দিলাম আমরা কারও পক্ষে নই, বিপক্ষেও নই। যা হচ্ছে বা যা হতে পারে বলে মনে হচ্ছে আমরা সেটাই দেখাব। এখানে অভীক সরকারের অপমানের কোনও অবকাশ ছিল না। ফলে কভারেজের রথে আমিই সারথি হলাম।
এ কাজ করতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলাম একজনের কাছ থেকেই, হুগলির গুন্ডা সি পি এম নেতা অনিল বসু। আমাদের আরামবাগের রিপোর্টার ভিডিও সহ এমন একটি রিপোর্ট পাঠাল যেটা দেখানোর পরে তিনি প্রবল অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই চ্যানেলের মালিক আমায় ফোন করে অনুরোধ করলেন স্টোরিটা যেন আর দেখানো না হয়। আমি সেইমতো নির্দেশ দিলেও কোনও কারণে তা সবার কাছে পৌঁছয়নি। সন্ধের প্রাইমটাইমে আবার দেখানো হল সেই খবর। অনিলবাবু মালিককে তেড়ে গাল দিলেন, মালিক গায়ের ঝাল ঝাড়ল আমার ওপর। আমি অনিলবাবুকে ফোন করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিলাম। পরে জানতে পারলাম অনিলবাবু আসলে চ্যানেল মালিকদের সবচেয়ে বড় মুরুব্বি, হুগলিতে ওদের কারখানার জন্য বিশাল জমি পাইয়ে দিয়েছেন, ব্যাঙ্ক লোনের জন্য চেয়ারম্যানদের কাছে উমেদারি করেছেন, বলতে গেলে এদের অভিভাবক। অতএব তাঁর প্রত্যাশা ছিল কলকাতা টিভি আর যাই হোক তাঁর বিরোধিতা করবে না। মালিকের মুখরক্ষার স্বার্থে এইটুকু সমঝোতা আমাকে করতেই হয়েছিল যদিও অনিলবাবুর প্রকৃত স্বরূপ আমার অজানা ছিল না।
ভোট এলে নির্বাচন কমিশনকে এখন যে মূর্তিতে দেখা যায়, তার সূচনা হয়েছিল ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটেই। দেড় মাস ধরে পাঁচ দফায় ভোট, গোটা প্রক্রিয়াটি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর চাদরে মোড়া। ভোট শুরুর অনেক আগে থেকেই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হল, হাজার হাজার ভুয়ো ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হল ভোটার তালিকা থেকে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসা ইস্তক বিরোধীরা ভাঙা রেকর্ডের মতো যে সব অভিযোগ তুলে বাজার গরম করত, অর্থাৎ ভোটার তালিকা থেকে বিরোধী ভোটার বাদ দেওয়া, সায়েন্টিফিক রিগিং, সন্ত্রাস, ২০০৬-এর ভোটে এমন একটি অভিযোগ তোলার অবকাশ নির্বাচন কমিশন দিল না। এর আগে দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টি এন শেষন যখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটে কড়াকড়ি করা শুরু করেছিলেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাঁকে ‘পাগলা কুকুর’ বলে গাল পেড়েছিলেন। কিন্তু ২০০৬-এ যখন তার চেয়েও অনেক বেশি কড়া ডোজ শুরু হলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন। কিছুটা প্রকৃতিগত কারণে বেশিরভাগটা আত্মবিশ্বাসের জোরে। কথায় কথায় আমাকে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের জন্য আমরা ভোটে জিতি না, ওদের জন্য হারবও না। ওরা ওদের কাজ করছে করুক, আমরা আমাদের কাজ করব।’
বুদ্ধবাবুর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার অনেক কারণ ছিল। প্রথমত বিরোধী শিবিরের ছন্নছাড়া অবস্থা। পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটে দুই কংগ্রেসের নড়বড়ে জোটও সিপিএমের শীরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এ বার জোটের কোনও বালাই ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এনডিএ জোটে, কংগ্রেস ইউপিএ-তে। দু’বছর আগে ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র মমতা জিতেছিলেন, আর কেউ নয়। বলা যেতে পারে মমতার দলের তখন চরম দুঃসময়, যদিও আজকের সি পি এমের মতো এতটা সঙ্গীন নয়। প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও শাসক গোষ্ঠী নির্বাচনে কার্যত ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারছে, এটাও একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেরই অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশন একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করে দিলেও বিরোধীরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জায়গাতেই ছিল না। ফলে বামফ্রন্টের জয়ের রাস্তাটা মসৃণ হয়ে গিয়েছিল ভোটদান পর্ব শুরু হওয়ার আগেই। (চলবে)