- August 17th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৪)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমার থমথমে চোখ-মুখ দেখে বুদ্ধদেববাবু বুঝতে পারলেন কোথাও একটা বড় কিছু গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে। ডিসক্রিশন ইজ দ্য বেটার পার্ট অব ভেলর, বুঝেও তাই তিনি মন্তব্য করলেন না।
২০০৪ সালের অগস্ট মাসে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে ২১ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি মুম্বই পাড়ি দিই স্টার নিউজের অফিসে প্রশিক্ষণ নিতে। এই বিচ্ছেদ বড় বেদনাদায়ক ছিল নানা কারণে যার অবতারণা আর এখানে করছি না। কেবল এইটুকু বলে রাখি, আনন্দবাজারের দৈনিক প্রচার সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হয়েছিল একই কাজে আমি আর আনন্দ পাচ্ছি না, নতুন কিছু করতে পারলে ভালো হয়। তখনই প্রথম মনে হয় নিজেই একটা কাগজ করলে কেমন হয়!
আমি বরাবরই বেহদ্দ বোকা, লোক চিনতে অপারগ, আমার এই ইচ্ছের কথা কয়েক জন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলাম। কলকাতায় কয়েক জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমি এ নিয়ে কথাবার্তা বলি, অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায় নতুন কাগজের জন্য পুঁজি পাওয়া অসম্ভব, ফলে নতুন কাগজ করার চিন্তাটাই আমি মাথা থেকে বের করে দিই। কিন্তু ততদিনে আমার যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। যে সহকর্মীদের আমি বিশ্বাস করেছিলাম, যাদের কেউ কেউ আমার জন্যই চাকরি অথবা প্রমোশন পেয়েছিল, তাদের কয়েক জন রাজার কানে বিষ ঢেলে জানিয়ে দিল, আমি গদ্দারি করতে চলেছি। একটা বড় দল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আনন্দবাজার ছেড়ে। রাজা কর্ণেন পশ্যতি, হঠাৎ আমি লক্ষ্য করতে শুরু করলাম সম্পাদক কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে যে উষ্ণ সম্পর্কটুকু ছিল তাতে শীতের আস্তরণ পড়ছে, মোটের ওপর রাতারাতি আমি তাঁর চোখে পার্সোনা নন গ্রাটা হয়ে গিয়েছি। আর ঠিক সেই সময়েই স্থির হল আনন্দবাজার আর স্টার নিউজের যৌথ উদ্যোগে একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি হবে। সরকার বাড়ির দমবন্ধ করা আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেতে আমি নিজে থেকেই চেয়ে নিলাম এই নতুন চ্যানেল পরিচালনার দায়িত্ব। এক ঢিলে দু’পাখি মারলাম আমরা দু’জনেই। আমার চাকরিটা রইল, সাদা বাড়ি থেকে নিষ্কৃতিও পেলাম। অভীকবাবুরও দু’টি মনোবাসনাই পূর্ণ হল, আমি আনন্দবাজার থেকে বিদেয় হলাম, নতুন চ্যানেলের জন্য মোটামুটি যোগ্য এক সেনাপতিকেও পাওয়া গেল।
এত বিস্তারে আমার নিজের কথা বললাম একটাই কারণে। সেটা হল এই প্রেক্ষাপটটি জানা না থাকলে আমি পরে যা বলতে চলেছি তা হয়তো বোধগম্য নাও হতে পারে।
অমানুষিক পরিশ্রম করে, রাতের পর রাত মেঝেতে খবরের কাগজ পেতে শুয়ে থেকে আমরা ২০০৫ এর গোড়ার দিকে নতুন চ্যানেল বাজারে নামিয়ে দিলাম। নাম দেওয়া হল স্টার আনন্দ। এই নামকরণটিও ছিল আমারই। অভীকবাবু জানতে চাইলে তাঁকে আমি এই নামটির কথাই বলেছিলাম। চ্যানেল চালু হওয়ার পরে আমি এক অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলাম। কাগজে কলমে আমার সম্পাদক ছিলেন উদয় শঙ্কর, আমি আর উদয় দু’জনেই সরকারদের চাকর। উদয় চাইত কোনও বড় ঘটনা ঘটলে আমি তার সঞ্চালনা করি আর অভীকবাবু চাইতেন আমি যেন কিছুতেই ক্যামেরার সামনে না আসি। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে বেশ কয়েকবার আমি উদয়কে ফোন করে বলেছি, অভীকবাবুর সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে একটা স্পষ্ট গাইড লাইন নিয়ে নিতে। নিউজ টেলিভিশনের সবচেয়ে সফল স্থপতি উদয়ের ইগোও প্রচণ্ড, যেমন জেদি তেমনি গোঁয়াড়। আমি নিজের সমস্যার কথা বললেই ওর স্টান্ডার্ড জবাব ছিল, ‘হোয়াই শুড আই কল হিম? আই অ্যাম দ্য এডিটর অব দ্য চ্যানেল।’
আই অ্যাম নট ডিসপিউটিং দ্যাট। ইন মাই পজিশন হু উড ইউ লিসন টু?
মাই এডিটর। ভেরি সিম্পল।
স্টার আনন্দ চালু হওয়ার পরে প্রথম বড় রাজনৈতিক ঘটনাটি হল কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। হিন্দি স্টার নিউজকে অনুসরণ করে উদয়ের পরামর্শে আমরা চালু করলাম এক মজাদার অনুষ্ঠান। নাম দিলাম ‘বলুন কাউন্সিলর’। বাছাই করা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ডে হবে এই অনুষ্ঠান, সেই ওয়ার্ডের সব ক’জন প্রার্থীকে এক মঞ্চে হাজির করে তাঁদের প্রশ্ন করবে চ্যানেলের সঞ্চালক, মঞ্চের সামনে স্থানীয় লোকেদের বসার ব্যবস্থা থাকবে, তাঁরাও ইচ্ছে করলে প্রার্থীদের যে কাউকে প্রশ্ন করতে পারেন। প্রথম দু’টি অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে হওয়ার পরে তৃতীয় অনুষ্ঠানেই চূড়ান্ত গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল, সমর্থকদের মধ্যে মারপিট, চেয়ার ছোড়াছুড়ি। লাইভ অনুষ্ঠান, আমরা ক্যামেরা বন্ধ করছি না, সবাই দেখছে সামান্য পুর নির্বাচন নিয়ে দক্ষযজ্ঞ। তারপর আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে একই কাণ্ড হওয়ার পরে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের টেলিফোন এল আমার কাছে। ‘প্লিজ স্টপ দিস প্রোগ্রাম, ইট ইজ বিকামিং এ ল’ অ্যান্ড অর্ডার ইস্যু।’ আমি সবিনয়ে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখান করে জবাব দিলাম,‘আপনি যা বলছেন সেটা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। আমাদের নয়।’
এই সিরিজের শেষ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে, ক্যালকাটা ক্লাবের লনে। মুম্বই থেকে উদয় ফতোয়া জারি করল, এই অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা আমাকেই করতে হবে, না করলে ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনবে। অগত্যা আমিই গেলাম এবং সঞ্চালনা করলাম। মঞ্চ থেকে দেখি শ্রোতাদের মধ্যে অভীকবাবুও বসে আছেন। অনুষ্ঠান শেষে ক্লাবের সিঁড়িতে দেখা হল তাঁর সঙ্গে। সোজা কৈফিয়ৎ চাইলেন, ‘তুমি কেন সঞ্চালনা করলে? জুনিয়ারদের কাউকে দিয়ে করাতে পারতে।’ এবার আমার বেশ রাগ হল, ‘আমার বদলে আপনি বরং উদয়কে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করুন।’
কলকাতার পুর নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রত্যাশিত ভাবেই গরিষ্ঠতা পেল। আমার মনে হল আজ যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া যায় তাহলে সবাইকে টেক্কা দেওয়া যাবে। মুখ্যমন্ত্রী তখন রাইটার্সে, সেখানেই ফোন করে কাকুতি-মিনতি শুরু করে দিলাম। গোড়ায় সামান্য গড়িমসি করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হলেন। ঠিক হল সন্ধ্যা ঠিক ৬টায় আলিমুদ্দিনের লাইব্রেরি কক্ষে হবে সাক্ষাৎকার।
ক্যামেরা, আলো, অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে সহকর্মীরা চলে গেল অনেক আগেই। চ্যানেলের টিকারে লিখে দেওয়া হল, ‘সন্ধ্যা ৬টায় মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত সাক্ষাৎকার, নেবেন সুমন চট্টোপাধযায়। স্টার আনন্দের পুরোনো অফিস থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট গাড়িতে পাঁচ মিনিট। সেজেগুজে আমি পৌঁছে গেলাম যথাস্থানে। চেয়ারে বসতে না বসতেই অভীক সরকারের ফোন। ‘টিকারে এ সব কী দেখছি?’
আমি বুদ্ধবাবুর ইন্টারভিউ নেব। সে জন্যই আলিমুদ্দিনে এসেছি।
না তুমি নেবে না। অন্য কোনও জুনিয়রকে আসতে বলো।
মানে? আমিই ওঁকে ফোন করে অনেক সাধ্য-সাধনার পরে এই ইন্টারভিউ দিতে রাজি করিয়েছি। আমি না থাকলে উনি কিছু মনে করতে পারেন।
করলে করবেন। তুমি শীগগির জুনিয়ার কাউকে ডেকে নাও। বলেই ফোন কেটে দিলেন।
অপমানে আমি তখন থরথর করে কাঁপছি। নিজেকে সংযত করে অনেক ভেবেচিন্তে অফিসে সুমন দেকে ফোন করলাম। ‘এখনই আলিমুদ্দিনে চলে আয়। ইউ হ্যাভ ফাইভ মিনিটস।’ সুমন চট্টোপাধ্যায়ের বদলে সুমন দে। সুমন তো রইল।
হাঁফাতে হাঁফাতে সুমন যখন ঢুকল মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের হুটারের আওয়াজ তখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। বিশদে কিছু ভাঙলাম না, কেবল কী বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা উচিত, ওকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলাম, ওইটুকু সময়ে যতটা পারা যায়।
এবার প্রবেশ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। দেখেই বোঝা গেল বেশ ক্লান্ত। আমাকে বললেন, ‘আজ দয়া করে বেশি বাউন্সার দেবেন না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।’
মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারলাম না মালিকের বাউন্সার মাথায় খেয়ে আমি এমনিতেই ময়দানের বাইরে ছিটকে গিয়েছি। এইটুকু বললাম ইন্টারভিউ নেবে সুমন জুনিয়র।
মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ বুঝলেন ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তাঁর মুখ থেকে কেবল দু’টি শব্দ বের হল, ‘তাই নাকি!’ (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

