- August 13th, 2022
ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড
সুমন চট্টোপাধ্যায়
অখ্যাত পাড়ার পুজোর দু’কড়ির মাতব্বর থেকে বিচারকের সম্মাননীয় পদে প্রোমোশন পেতে আমাকে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। খুব সম্ভবত ঘটনাটি ঘটে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। দিল্লির পাট হঠাৎ চুকিয়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আমি বার্তা বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পরে।
কলকাতার পুজোগুলিকে নিয়ে জমজমাট প্রতিযোগিতা শুরু করার ভাবনাটি প্রথম ভেবেছিল এশিয়ান পেইন্টস সংস্থা। পরপর কয়েক বছর তারা একাই ময়দানে ছড়ি ঘুরিয়েছিল। খবরের কাগজে তারা ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন দিত, অসংখ্য পুজো কমিটি ফর্ম ফিল-আপ করে নাম পাঠাত। এশিয়ান পেইন্টস পুরস্কার পাওয়া পুজো কমিটির কাছে বেশ ঘ্যাম ব্যাপার ছিল। তারা আবার তাদের মতো করে পুরস্কারের ঢাক পেটাত। পুরস্কৃত পুজোগুলির মণ্ডপে ভিড় উপচে পড়ত। গোড়ার দিকে এশিয়ান পেইন্টস পুরস্কার ছিল পুজোর পুলিৎজার।
তারপর বাজারের নিজস্ব নিয়মে যেটা অনিবার্য, সেটাই ঘটতে শুরু করল। এশিয়ান পেইন্টসের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আরও অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা পুজোর প্রতিযোগিতা আয়োজনে নেমে পড়ল। প্রথমে এল স্নোসেম, এটিও রঙের কোম্পানি, সদর কার্যালয় মুম্বইতে। এশিয়ান পেইন্টস একার মুরোদে যা করত, স্নোসেম সে পথে হাঁটল না অনেক ভাবনা চিন্তা করেই। তারা গাঁটছড়া বাঁধল আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। সঙ্গে আনন্দবাজার থাকলে বাংলা বাজারে অন্য কোনও দোসরের প্রয়োজন থাকে না। পরিচিতি ও প্রচার একই সঙ্গে হয়ে যায়।
কান টানলে মাথা আসে, আমার কাগজের হয়ে আমিও জড়িয়ে পড়লাম প্রতিযোগিতার আয়োজনে। বিচারকমণ্ডলীর যে তালিকা তৈরি হল, তাতে আনন্দবাজারের প্রতিনিধি হলাম আমি। বাকিদের কেউ সাহিত্যিক, কেউ খেলোয়াড়, কেউ নৃত্যশিল্পী অথবা টালিগঞ্জের অভিনেতা। কী আশ্চর্য! সহ বিচারকদের একজনের নামও এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। মুকুল রায়ের মতো আমারও ডিমেনশিয়া হল নাকি?
স্নোসেম তাদের হয়ে মাঠে নেমে কাজ করার জন্য একটি বিজ্ঞাপন সংস্থাকে নিয়োগ করেছিল যার মাথায় ছিলেন গোপীনাথ ঘোষ, ইউনিভার্সাল গোপীদা। অতি সজ্জন, সদা হাসিমুখ এক অতি দক্ষ সংগঠক। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে গোপীদা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একদা রাজ্যের টেবিল টেনিস সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসরের পরে দীর্ঘদিন সুতানুটি পরিষদের হ্যাপা সামলেছেন। গোপীদার কথায় আমি না বলতে পারতাম না। ফলে তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে বেশ কয়েকবার আমায় সুতানুটি পরিষদের বিতর্ক সভায় যোগ দিতে হয়েছে। ২৪ ক্যারেটের ঘটি, গর্বিত উত্তর-কলকাত্তাইয়া গোপীদার ট্রেড-মার্ক ছিল তাঁর পোশাক। হাফ হাতা সাদা শার্ট, সাদা প্যান্টে গুঁজে পরা। কেন যেন তিনি সারাটা জীবন শুধু সাদা ইউনিফর্ম পরে গেলেন বলতে পারব না। তবে অন্য কোনও পোশাকে কেউ যে কখনও গোপীদাকে কখনও দেখেনি, এটা ছাতি ঠুকে বলতে পারি।
প্রতিযোগিতায় যোগদানের ইচ্ছা জানিয়ে শ’য়ে শ’য়ে আবেদনপত্র এল আনন্দবাজার দফতরে। তাদের মধ্যে প্রাথমিক ঝাড়াই-বাছাইয়ের দায়িত্ব ছিল গোপীদার টিমের। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা কলকাতার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ ছানবিন করল কয়েক দিন ধরে। শ’খানেক পুজোর ভিডিও রেকর্ডিং করল তারা। এ বার বাছাইয়ের দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ বিচারকদের। ওই ভিডিওগুলি দেখে গোটা পনেরো পুজোকে ফাইনাল লিস্টে তুলে আনা। ভিডিও দেখতে দেখতে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হল। বিচারকেরা একে একে কোনও না কোনও অজুহাত খাড়া করে গাত্রোত্থান করলেন, আমায় ঠায় বসে থাকতে হল শেষ পর্যন্ত ধর্মের ষাঁড় হয়ে।
এ বার মাঠে নামা। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ে এক নামজাদা হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে সব বিচারককে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হল। প্রথমে নৈশভোজ তারপরে বাসযাত্রা। এতদিন ছিলাম মাস মাইনের চাকর, হোটেলে ঢুকে নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হতে শুরু করল। বাসের বনেটে পুরস্কারের ব্যানার ঝোলানো, সামনে পুলিশের পাইলট কার মোটরবাইকে বসা বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরতলি, এই আমাদের রুট। রাস্তায় ভরা কোটালের বান দেখে ভয় হল এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এত বড় একটা বাস ঢুকবে কী করে? জজিয়তি করতে এসে শেষমেশ গণ-পিটুনিতে মরতে হবে না তো?
অভিজ্ঞতা হল ঠিক উল্টোটা। আমাদের বাস ওই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই চলল মাখনের মধ্যে ছুরি চলার মতো করে। যেখানেই যাই, পুজোর কর্মকর্তারা দলে দলে দৌড়ে এসে বাসের পথ মসৃণ করে দেন। তারপর এসকর্ট করে নিয়ে যায় মণ্ডপে। আমাদের দেখে কোনও প্যান্ডেলে শঙ্খধ্বনি আরম্ভ হয়, কোথাও মেয়েরা ফুল ছোড়ে, কোথাও আবার মাটির পাত্রে গলা ভেজানোর পানীয় এগিয়ে দেয়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আমার। একইসঙ্গে বুঝতে পারি পুরস্কারদাতারা হলেন পুজো কমিটির আদরের জামাই। এমন খাতির করো যাতে পুজোর ভুলত্রুটিগুলি চোখেই না পড়ে কিংবা পড়লেও ভুলে যায়। সত্যি কথা বলছি, পুজোর বিচারক হয়ে সে রাতে সর্বত্র যে আদর আপ্যায়ন পেয়েছি, বিয়ের দিন শ্বশুরবাড়িতেও তা পাইনি।
তারপরে আরও বেশ কয়েকবার আমি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি, এশিয়ান পেইন্টসের হয়েও। তবে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছিলাম ২০১০ সালে একদিনের সম্পাদক হিসেবে নিজের মতো বিচারকমণ্ডলী তৈরি করার স্বাধীনতা পেয়ে। প্রস্তাব দিলাম সোনাগাছির দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতিকে। তাঁরা সাগ্রহে লুফে নিলেন। চারজন মেয়েকে আমাদের অফিসে পাঠালেন নির্ধারিত সময়ে। পরের দিন কাগজের প্রথম পাতায় সেই মেয়েদের হাসিমুখ ছবি ছাপতে পেরে, তাদের পুজো নির্বাচনের বিশদ বর্ণনা দিয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, আর কখনও তা পেয়েছি কি? যাদের পল্লির মাটি না হলে মা দুগ্গার পুজোই করা যায় না, তাদের প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিয়ে আমি নিজেকেই ধন্য মনে করেছি।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

