27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

সাবধান, ও প্রিয়র লোক

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

রাজনৈতিক নেতাদের সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার ইতিহাস সম্ভবত পেশার সূচনা থেকেই। সময় বদল হওয়ার সঙ্গে তার ধরন-ধারণ বদলেছে মাত্র। আনন্দবাজারে কাজ করার সময় শুনেছিলাম, কংগ্রেসের সভাপতি (তখন বলা হতো রাষ্ট্রপতি) থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বসু কাগজের কাছ থেকে এমন নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করতেন। তখনকার সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, দীর্ঘদিন কারাবন্দি থেকেছেন, ফলে তাঁদের চরিত্রের তেজও কিছু কম ছিল না। শুনেছি, এক রাতে দু’টো-আড়াইটে নাগাদ বার্তা সম্পাদকের টেলিফোন ঝনঝন করে বেজে ওঠে। কাগজ ততক্ষণে ছাপা শুরু হয়ে গিয়েছে, সেই ভদ্রলোকও টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফোনের আওয়াজে তাঁর ঘুম তো ভাঙলই মেজাজটাও বেজায় বিগড়ে গেল। তারপর দু’জনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তা এই রকম।
হ্যালো এত রাতে কী ব্যাপার, কে কথা বলছেন?
আমি সুভাষ চন্দ্র বসু বলছি, ওয়ারধা থেকে।

কোন সুভাষচন্দ্র? আমি তো ডজন খানেক সুভাষচন্দ্রকে চিনি।
আমি রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু বলছি। সত্যেনবাবু (সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সেকালের যশস্বী সাংবাদিক) আমার বক্তৃতার যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তার একটা জায়গায় একটু সংশোধন করতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বার্তা সম্পাদক বুঝলেন সমস্যা খুবই জটিল। সবার আগে স্টপ প্রেস করতে হবে, তারপর বক্তৃতাটি এনে কোথায় সংশোধন করতে হবে তা বুঝে নিতে হবে, তারপর আবার নতুন করে পাতা করতে হবে, সবশেষে ছাপা। সমস্যা এড়াতে ইচ্ছে করেই তিনি সুভাষচন্দ্রকে না চেনার ভান করলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে আমি ঠিক বুঝলাম না এখনও।

ওপার থেকে জবাব এল, আমি রাষ্ট্রপতি বলছি। তখন কংগ্রেসের সভাপতিকে রাষ্ট্রপতিই বলা হতো।

ক্লাইম্যাক্সটা এল ঠিক এরপরেই। বার্তা সম্পাদক নির্দ্বিধায় সুভাষচন্দ্রকে বললেন, ‘আপনি যে দেশের রাষ্ট্রপতি আমি তার নাগরিকত্ব অস্বীকার করি।’ বলেই তিনি দুম করে ফোনটা রেখে দিলেন। আমার অনুমান বার্তা সম্পাদক মহাশয় নির্ঘাৎ গান্ধীর ভক্ত ছিলেন, সুভাষচন্দ্রকে পছন্দ করতেন না।

আনন্দবাজার বরাবর ছিল গান্ধীবাদী। গান্ধীর প্যাঁচে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়েও ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। সেটাই হয়ে দাঁড়াল টার্নিং পয়েন্ট। মহাজাতি সদনের উদ্বোধনে এসে রবীন্দ্রনাথ ‘দেশনায়ক’ বলে সম্বোধন করলেন সুভাষচন্দ্রকে, আনন্দবাজারও বাঙালির এই অসম্মানে সম্পাদকীয় অবস্থান আমূল বদলে ফেলল। হলো সুভাষবাদী। হলো বাংলা ও বাঙালির মুখপত্র।কাগজের নীতি বদলালেও গান্ধীবাদী বনাম সুভাষবাদীদের লড়াই কি বন্ধ হয়েছিল? এ লড়াই কি তদানীন্তন সাংবাদিকদের মধ্যেও ছিল না? 
কাট টু ১৯৮৩। আমি সবে আনন্দবাজারের রিপোর্টিং বিভাগে ঠাঁই পেয়েছি। কিছুদিন পরেই মনে হতে শুরু করল এ তো দেখছি প্রদেশ কংগ্রেস অফিসের এক্সটেনশন! সিনিয়র রিপোর্টারদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ঘোষিত ভাবেই কংগ্রেসি গোষ্ঠী রাজনীতির সঙ্গে আগাপাশতলা সম্পৃক্ত। একটি বরকত শিবির অন্যটি প্রণবের। বরকতের ভক্তদলের সর্বদা যুদ্ধং দেহি মেজাজ, চেঁচিয়ে কথা বলে, কথায় কথায় প্রণববাবুর মুণ্ডুপাত করে। তুলনায় প্রণব শিবির ভদ্র-সভ্য, গালাগাল গায়ে মাখে না, প্রতিপক্ষ শিবির খোঁচা দিতে চাইলে একটু মুচকি হেসে এড়িয়ে যায়। কাগজের কর্তৃপক্ষ সব জানে অথচ কোনও পক্ষকেই নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে না, বরং প্রয়োজনে তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করে। কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন মদত থাকায় রিপোর্টারদের গোষ্ঠী-কোন্দল প্রদেশ কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মতোই বে-আব্রু হয় খুল্লাম খুল্লা চেহারায়।
চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে তখনই প্রথম বুঝেছিলাম ‘নেতার লোক’ হওয়ার মানেটা কী!

আমি সবে রিপোর্টারি শুরু করেছি, এক প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ছাড়া কোনও দলের কোনও নেতাকেই চিনি না। কলেজ-জীবন থেকে প্রিয়বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়, তাঁর সম্পাদিত দক্ষিণী বার্তা কাগজে বেনামে সামান্য লেখালেখি করেছি এই পর্যন্ত। তাছাড়া প্রিয়বাবু তখন সবে মাথা মুড়িয়ে, বিদ্রোহে ফুলস্টপ দিয়ে ইন্দিরা কংগ্রেসে ঢুকেছেন, দলের অন্দরে তিনি একবারে অপাংক্তেয়। তাঁর ভাগ্যে নাটকীয় পরিবর্তন আসে ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরে। অব্যবহিত পরের লোকসভা ভোটে তিনি হাওড়া থেকে জেতেন, রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর বৃহস্পতি চকিতে তুঙ্গে ওঠে। কাকতালীয় ভাবে একই সময় আমাকেও বদলি করা হয় আনন্দবাজারের দিল্লি ব্যুরোয়।

অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই, দিল্লির মতো অপরিচিত, রেগিস্থানি শহরে গোড়ার দিকে প্রিয়বাবুই ছিলেন আমার অন্ধের যষ্টি। আর কাউকে চিনি না, এমনকী পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাকি যে ১৫ জন লোকসভায় গিয়েছিলেন তাঁদের কারও সঙ্গেও তেমন পরিচয় নেই। তাছাড়া রাজনীতিক হিসেবে প্রিয়বাবুর জাতটাই ছিল আলাদা, তাঁর উজ্জ্বল অতীতের কারণে রাজধানী শহরটাকে তিনি হাতের তালুর রেখার মতো চিনতেন, সর্বত্র সবার কাছে অবাধ তাঁর প্রবেশাধিকার। ফলে তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে সর্বদাই কোনও না কোনও খবর থাকত আর আমি সেটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে কেটে পড়তাম। তারপর প্রিয়বাবু একে একে কেন্দ্রে মন্ত্রী হলেন, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হলেন, খবর আসতে থাকল প্লাবনের মতো। প্রিয়বাবুর সঙ্গে আমার গোপন সমঝোতা ছিল এক্সক্লুসিভ খবর তিনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেবেন না। দিতেনও না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের আসল জোরটা ছিল এখানেই। আর সেটাই হয়ে উঠল কাগজের ভিতরে-বাইরে অনেকের তীব্র অসূয়া আর গাত্রদাহের কারণ। সর্বত্র রটিয়ে দেওয়া হলো আমি ‘প্রিয়র লোক’, সাধু সাবধান।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article