27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

বিষন্ন মধুর স্মৃতি

Must read

দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়

তরুণ মজুমদারের মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু আজ সারাদিন কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে কেটে গেল। বারবার মনে পড়ছিল তাঁর নম্র, মর্যদাপূর্ণ কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গী এবং কথার মধ্যে স্নিগ্ধ হাস্যরসের পরশ। সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত ও গোত্রহীন এই পরিচালক একদিন বাংলা ও মুম্বইতে রাজত্ব করেছেন, সাতের দশকে হৃষীকেশ মুখার্জি-বাসু চট্টোপাধ্যায়েরা মধ্যবর্তী চলচ্চিত্রের ব্রান্ড নির্মাণের অনেক আগে তিনি বাংলায় এই ঘরানার ছবি করেছেন এবং সফল হয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যকরণ এবং অলঙ্কারশাস্ত্র দুটিতেই তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে বাণিজ্যিক ছবির বাদশাহ ভি শান্তারাম তাঁর চিত্রনাট্য শুনে অভিভূত হয়ে তাঁকে ছবি বানাবার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে সংসার সীমান্তের মতো ধাক্কা দেওয়া ছবি করতেও তিনি ততটাই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ঠগিনীর মতো ডার্ক হিউমারের সিনেমা বাংলায় আর হয়েছে কি না জানি না, আর এ ছবি পুরোপুরি তাঁর চরিত্রের বিপরীত। হয়তো প্রকৃত শিল্পী এমনই হয়ে থাকেন।

কর্মজীবনে অনেক গুণীজনের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু তনুবাবুর মতো এমন মধুর ব্যক্তিত্ব আর দেখিনি। তিনি অনায়াসে মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। তাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি দেখা এক অভিজ্ঞতা, আমি বলতাম সিনেমার মাস্টারক্লাস। প্রতিটি ছবি দেখে, হল থেকে বেরিয়ে, শট বাই শট বিশ্লেষণ করে পরিচালকের মনের গহনে ঢোকার চেষ্টা করতেন। পরিণত বয়সে তাঁকে কোনও ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ করে দিলে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হতো। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস তাঁকে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকার থেকেই দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। 

অতীতমুখিতা তরুণ মজুমদারের চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা একাধারে তাঁর শক্তি এবং দুর্বলতা। নিউ থিয়েটার্সের সিনেমা সারাজীবন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে এ কথা তিনি আমাকে বারবার বলেছেন। এই জন্যই এক ধরনের ফিল গুড ফর্মূলার বাইরে তিনি বেরোতে পারেননি এবং সৃজনের শেষ কয়েক দশক নিয়মিত ভাবে দুর্বল ও পুনরাবৃত্তিমূলক ছবি করে শক্তিক্ষয় করেছেন। কালের অমোঘ বিচারে তাঁর সিনেমা কতটা বেঁচে থাকবে জানি না, কিন্তু সিনেমাপাড়া দিয়ে-র লেখক তরুণ মজুমদার চিরজীবী হবেন, এতে আমার কণামাত্র সংশয় নেই। 

তনুবাবুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল সাড়ে তিন বছর আগে, দু’হাজার উনিশের জানুয়ারি মাসে, মৃণাল সেনের শেষযাত্রায়। দেশপ্রিয় পার্কের পাশে কিছুটা পথ আমরা একসঙ্গে চলেছিলাম। তাঁর সেদিনের ব্যথিত মুখ ও শূন্য, পথভোলা দৃষ্টি আজ আষাঢ়ের রাক্ষসীবেলাকে বেদনামলিন করে দিয়ে গেল।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article