Wednesday, October 30, 2024

স্বপ্ন যখন সত্যি

Must read

স্বপ্ন যখন সত্যি

সুমন চট্টোপাধ্যায়

কয়েক বছর আগে বিবিসি-র ওয়েবসাইটে একটা মজার খবর পড়েছিলাম৷ বিলেতের বেশ কয়েকটি খামারে ইদানীং নাকি পুরোদমে জোঁকের চাষ শুরু হয়েছে৷ হাজারে হাজারে জোঁক কেবল যে সেদেশের ন্যাশনাল হেল্‌থ সার্ভিসেস-এর কাছে চালান হচ্ছে তা নয়, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে রমরম করে৷ বেচারি প্রাণীটির যত দুর্নামই থাক, নানাবিধ চিকিৎসায় নাকি রক্তচোষা জোঁকেরই প্রয়োজন হয়৷ যেমন টনসিলাইটিস বা অর্শ৷

কলকাতার কর্পোরেট হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমগুলিতে জোঁকের এমন কদর আছে কি না জানা নেই৷ সম্ভবত দরকারও নেই৷ কেননা সেখানে রোগীর রক্ত-চোষার কাজটি মানুষই দিব্যি করে থাকে নির্মম পেশাদারি দক্ষতায়৷ আম-আদমি এমন মনুষ্য-সুলভ দ্বি-পদ প্রাণীদের ডাক্তার বলে চেনে৷ কোন পেশার লোকজনকে মানুষ ইদানীং সবচেয়ে ঘেন্না করে, এই প্রশ্নটি নিয়ে সমীক্ষা হলে ডাক্তারবাবুরা যে তালিকার অগ্রভাগে থাকবেন, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ আছে কি?

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর কয়েক আগের ঘটনা, আমার এক নিকট আত্মীয় বিধাননগরের একটি নামজাদা বেসরকারি হাসপাতালে মামুলি একটি অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন৷ ভদ্রলোক নিজে ডাক্তার, কোল ইন্ডিয়ার বিবিধ খনিতে শ্রমিকের চিকিৎসা করেছেন সারা জীবন৷ অপারেশনের কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারবাবু আমার আত্মীয়কে বলেন, এটা কোল ইন্ডিয়ার কেস জানলে তিনি কিছুতেই এ অপারেশন করতেন না, জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দিতেন৷ কেন? না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মচারীদের অপারেশন করলে দক্ষিণা অন্য সাধারণ রোগীর তুলনায় অনেক কম৷ ‘আপনার অপারেশন করলে পাব মাত্র পাঁচ হাজার৷ আর আর আমার এমনিতে অপারেশন চার্জ পঁচিশ হাজার৷ সময় নষ্ট৷ টাকাও নষ্ট৷’

যে ডাক্তার অপারেশনের টেবিলে দাঁড়িয়ে ঘোর বিরক্তি নিয়ে আর একজন প্রবীণতর ডাক্তার রোগীকে কয়েক হাজার টাকা লোকসান হওয়ার কথা শোনাচ্ছেন, এমনকী অপারেশনের পরে রোগীর আত্মীয়-পরিজনের কাছে বারে বারে এ নিয়ে হাহুতাশ করেছেন, তাঁকে জোঁক ছাড়া অন্য কিছু বলা বিধেয়? ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন ইদানীং হাসপাতাল-নার্সিংহোমে যাওয়া মানে দুরুদুরু বুকে ধন এবং প্রাণ দু’টোকেই একসঙ্গে বাজি রাখা৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রাণের গ্যারান্টি যদিবা থেকে থাকে ধনের তো একেবারেই নেই৷

কেন এমন একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা বহুচর্চিত বলে এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন৷ বছর তিরিশেক আগেও এ রাজ্যে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য চোখ বুজে সরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে পারত৷ বড় বড় ডাক্তারবাবুদের সেখানেই পাওয়া যেত, ভিতরের ওয়ার্ডগুলোর চেহারা দেখে গোরু-ছাগলের আস্তানা বলে মনে হত না৷ কিন্তু সেদিন আর নেই৷ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থা প্রায় উবে গিয়েছে বলে, দলে দলে গরীব মানুষও আজ নার্সিংহোম বা বেসরকারি হাসপাতালমুখী হতে বাধ্য হয়৷ অর্থাৎ অর্থনীতির চাহিদা-জোগানের সহজ অঙ্কটাই কাজ করে এক্ষেত্রে৷ শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না, ফলে সর্বস্ব পণ করেই বেঁচে থাকার আশায় মানুষ দলে দলে ভিড় করে বিকল্পের সন্ধানে৷ এ কথা জেনেই যে বিকল্পটি দেখতে ঝকঝকে হলেও অসাধুতা আর কালোবাজারির প্রসারিত বধ্যভূমি ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এই বধ্যভূমিতে হিপোক্রেটিক শপথকে (পেশায় প্রবেশের সময় সব ডাক্তারকে যে শপথবাক্য পাঠ করতে হয়) সযত্নে কবর দেওয়া হয়েছে অনেক কাল আগেই, যেন-তেন-প্রকারেণ রোগী ঠকানোই যেখানে সেবার অন্য নাম৷

আমাদের কলকাতাই সম্ভবত ভূ-ভারতে একমাত্র শহর যেখানে খেলার মাঠ অথবা বিনোদন জগতের তারকাদের সঙ্গে কাঁধে স্টেথো, পরনে অ্যাপ্রন ডাক্তারবাবুদের উদ্ভাসিত হাসি-মুখ জ্বলজ্বল করে প্রমাণ সাইজের হোর্ডিয়ের বিজ্ঞাপনে৷ ডাক্তারদের এমন ব্যক্তিগত বিপণন শুধু রুচি-বিরুদ্ধ নয়, যতদূর জানি, রীতি ও নীতি বিরুদ্ধও৷ কিন্তু তাতে কী? পেশাটাই যেখানে মানবতা বর্জিত হয়ে কেবলই মাল কামানোর ধান্দায় পর্যবসিত হয়ে গিয়েছে, অপরিসীম লোভ আর লালসা বশ করে রেখেছে গোটা পরিবেশকে, সেখানে ঘোমটার নীচে খ্যামটা নাচারই বা প্রয়োজন কোথায়? আচরণবিধিকে বেদ জ্ঞানে মেনে চলাটাই তো মূর্খামি!

তাই বলে কি নিয়মে ব্যতিক্রম নেই? হতে পারে না? সব ডাক্তারই কি চশম-খোর? রক্তচোষা জোঁক? তা যে আদৌ নয়, চারদিকের এমন ঘন অমানিশার মধ্যেও কয়েকজন ডাক্তারবাবু যে নিজেদের বিবেক এখনও জাগ্রত রেখে আশার আলোটাকে জ্বালিয়ে রাখতে চাইছেন এবং পারছেন সেটাই ঠাওর হয় কলকাতা দক্ষিণ শহরতলিতে সোনারপুর রেল স্টেশনের অনতিদূরের একটি হাসপাতালে গেলে৷ অর্থ নয়, লোভ নয়, প্রয়োজনাতিরিক্ত লাভও নয়, সেবাই ধর্ম হিসেবে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালে।

লিভার আর পেটের অসুখের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট এই হাসপাতাল। পোশাকী নাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ সায়েন্সেস (আইআইএলডিএস)।

অবিশ্বাস্য রূপকথার মতো এই হাসপাতালের গপ্পো৷ এলাকারই এক মহীয়সী নারী কয়েক কোটি টাকা দামের চার একর জমি সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা যাবে না৷ তাঁর সেই ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে রাজ্য সরকার এই জমি দিয়েছিলেন কলকাতার লিভার ফাউন্ডেশনকে৷ সেখানেই ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছে এই হাসপাতাল৷

বচর পাঁচেক আগে এই হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে লিভার ফাউন্ডেশনের কর্ণধার এই হাসপাতালের প্রধান স্বেচ্ছাসেবী-স্থপতি ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী এমন কয়েকটি চমকপ্রদ ঘোষণা করেছিলেন, যা শুনে প্রথম চোটে মনে হয়েছিল বলতে হয় তাই বলছে, আদপে এই সব কিছুই কার্যকর হবে না। পাঁচ বছর পরে অবাক হয়ে দেখলাম, আমার সেদিনের সংশয় কতটা ভ্রান্ত ছিল। অভিজিৎ সেদিন বলেছিলেন, অচিরেই ১০০ শয্যার ব্যবস্থা থাকবে এই হাসপাতালে। এক বছর যেতে না যেতেই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়ে গিয়েছে। বলেছিলেন, এই হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র গড়া হবে। সেটি গড়ার কাজ চলছে পুরোদমে। সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিশ্রুতিটি ছিল এই যে, এই হাসপাতালটি রোগীদের বধ্যভূমিতে পর্যবসিত হবে না কোনও দিন। টাকা না দেওয়ার জন্য রোগীর মরদেহ এখানে আটকে রাখা হবে না।

বিনি পয়সার ভোজের ব্যবস্থা অবশ্যই নেই এই হাসপাতালে৷ সঙ্গত কারণেই নয়৷ কিন্তু যে পরিষেবার জন্য ন্যূনতম যেটুকু মূল্য নেওয়া প্রয়োজন, নইলে হাসপাতালের লোকসান, নেওয়া হবে সেই টুকুই৷ মোদ্দা কথায় এর অর্থ, পাঁচ টাকার সেবার জন্য পঞ্চাশ টাকার বিল ধরানো হচ্ছে না রোগীর হাতে, যে সব পরীক্ষার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই তার লম্বা তালিকা নিয়ে রোগীকে দৌড়তে হচ্ছে না ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, ডাক্তারদের ফি-ও থাকছে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই৷ অস্তিত্ব রক্ষার অমোঘ নিয়মে ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই চলছে এই হাসপাতাল। কিন্তু লোভ সেই ব্যবসার চালিকাশক্তি নয়৷ অন্যায্য মুনাফা ঘরে তোলার কোনও তাগিদই নেই এখানে৷ রোগী এখানে মুর্গি নয়, হাসপাতালটিও নয় পরিচিত জবাইখানা৷ তার মানে বেসরকারির ব্যবসার যেটুকু ভালো এবং যেটুকু গ্রহণযোগ্য তাকে শিরোধার্য করে বর্জন করা হবে জোঁকের রক্ত-পিপাসাকে৷ অর্থাৎ লিভার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য এখন যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে পঁচিশ-তিরিশ লাখ টাকা খরচ হয় এখানে সেটা হবে না৷ যেতে হবে না রাজ্য ছেড়েও৷

এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষিত হল তা জানার জন্য অভিজিৎকে ফোন করেছিলাম। সে বলল, বিল বকেয়া থাকার জন্য একজন রোগীর মরদেহও এই হাসপাতালে আটকানো হয়নি। তাঁর কথায়, ‘আমরা এসব ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে স্পষ্ট ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি কোথায়, কী জন্য, কত টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা হল, রোগীর সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য সঠিক ভাবে রাখতে পারলে রোগীরা কখনও টাকা দিতে অস্বীকার করেন না। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার ছ’মাস পরে বকেয়া টাকার সামান্য কিছু আত্মীয়-পরিজন ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের হচ্ছে ঘন ঘন।’

শুধু তাই নয়, এই হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে অনেক রোগী স্বেচ্ছায় যে যাঁর মতো করে অর্থ সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কেউ ১০ হাজার, কেউ ২০ হাজার। এই হাসপাতালের বিশেষত্বটাই এখানে, পুরোটাই চলে দয়ার দানে। এই হাসপাতালের কোনও মালিক নেই। লিভার ফাউন্ডেশনের কর্তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় বিদেশের বেশ কয়েকটি বড় ফাউন্ডেশন এমনকী বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে কিন্তু অপ্রতিহত গতিতে বাড়ছে দাতাদের সংখ্যা। শুভ উদ্যোগে অর্থের অভাব যে হয় না, এই হাসপাতাল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

জন লেনন একবার বলেছিলেন, ‘আপনি যখন একা কোনও স্বপ্ন দেখেন, তখন সেটা নিছকই স্বপ্ন৷ কিন্তু আরও অনেককে নিয়ে আপনি যে স্বপ্নটা দেখেন, সেটা বাস্তব৷’ আরও অনেককে নিয়ে, বস্তুত যে সাহায্য করতে চেয়েছেন, তাঁকেই এই আন্দোলনে শরিক করে অভিজিৎ আজ নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে ফেলেছেন৷ নতুন হাসপাতালের ডিরেক্টর হয়েছেন ডাঃ অশোক কোনার, এগিয়ে এসেছেন ডাঃ কল্যাণ বসু-সহ পিজি হাসপাতালে অভিজিতের অনেক সতীর্থই৷ দিল্লির এআইএমএস, আইএলবিএস, ফর্টিস হাসপাতাল, সেন্টার ফর লিভার অ্যান্ড বাউলিয়ারি সায়েন্সেস, মুম্বইয়ের গ্লোবাল হসপিটাল, ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ মায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হাজির থেকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছিল, এই নবজাতকের পাশে তারা সবাই থাকবে৷ আবেগ মথিত হয়ে বাংলাদেশের এক ডাক্তার প্রতিনিধি বলেছিলেন, এই হাসপাতাল বাঙালিরই অনন্য কীর্তি৷

চলার পথে এ পর্যন্ত বাগড়া দেয়নি কেউ৷ তোলা চাইতে কেউ লোক-লস্করও পাঠায়নি৷ দলীয় রাজনীতি ভুলে এলাকার মানুষ দু’হাত ভরে আর্শীবাদ করছেন এমন মহান উদ্যোগকে৷ ঘড়ির কাঁটা ধরে সব কিছুই এমন ঠিকঠাক এগিয়ে চলার এমন দৃষ্টান্ত এই বাংলায় বড় একটা খুঁজে পাওয়া যাবে কি?

দেখুন না, আপনিও পারেন কি না বাড়িয়ে দিতে সাহায্যের হাত? নাম-যশ যদিবা নাও হয়, পুণ্য তো হবেই৷

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article