Wednesday, October 30, 2024

শূন্য এ বুকে পাখি মোর…

Must read

শূন্য এ বুকে পাখি মোর…

সুমন চট্টোপাধ্যায়

এমনিতেই গভীর অবসাদের মধ্যে দিবা-রাত্রি কাটে আমার, নিঃসঙ্গ গৃহে অন্তরীণ অবস্থার সঙ্গে যুঝতে গিয়ে পদে পদে ঠোক্কর খাই। আজ সকাল থেকে মনে হচ্ছে অবসাদের গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছি, বড্ড বেশি মন খারাপ হচ্ছে যেন। কারণটি হল, আমার পুত্র তার পুরোনো চাকরিতে ফিরবে বলে আজ সকালেই মুম্বই পাড়ি দিয়েছে। এই প্রত্যাশিত বিচ্ছেদও বড় বেদনার মতো প্রাণে বেজে চলেছে অনবরত।

অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না তো? আমার পুত্র-কন্যা দু’জনেই ইস্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর থেকে বাইরে-বাইরে, ওদের বিহনে দিনযাপনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি অনেক দিন। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় দারুণ ফল করে আমার মেয়ে যখন দিল্লিতে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে ভর্তি হল, আমি ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম। কলেজ হোস্টেলে জায়গা পেল না, কলেজ পাড়াতেই, একটা দোতলা বাড়ির এক তলায় আরও তিনটি মেয়ের সঙ্গে একই ঘরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হোল। সেই ঘরের চৌকাঠে পা রেখেই আমি আঁতকে উঠেছিলাম, প্রায়ান্ধকার একটা ছোট্ট জায়গায় চারটি চৌকি পাতা, প্রত্যেকটির সামনে একজোড়া ছোট টেবিল-চেয়ার। আমার আদুরে মেয়ে, বাড়িতে নিজের ঘরের সম্রাজ্ঞী, অপরিচিত আরও তিন জনের সঙ্গে একই ঘরে কী ভাবে দিন গুজরান করবে ভেবেই আমার কন্ঠরুদ্ধ হয়ে এসেছিল।ওকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্টে আসার সময় গাড়িতে বসে টের পাচ্ছিলাম বুকের ভিতরটা হু হু করছে, কলকাতায় বাড়িতে ফেরার পরে প্রথম কয়েকদিন কন্যার ঘরের পানে আমি তাকাতেই পারতাম না, মেয়ের সাফল্য তার সম্ভাব্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গৌণ হয়ে গিয়ে তখন কয়কদিন কন্যা-হীন সংসারে আমার সব কিছু শূন্য মনে হত।

তারপর সময়ের অব্যর্থ প্রলেপে কন্যার অনুপস্থিতি গা সওয়া হয়ে গেল।কয়েক বছর পরে পুত্র যখন বিলেতে পড়তে গেল, ভবিতব্যকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার অনুশীলনে ততদিনে আমি পারদর্শী হয়ে উঠেছি। পুত্র-কন্যা-রহিত দিন যাপনে তারপর থেকে আমি আর আমার গিন্নি ধাতস্থ হয়ে পড়েছি বলা চলে।

হঠাৎ অতিমারী এসে আবার জোড়া লাগিয়ে দিল আমাদের চার জনকে।গত বছর ১৮ আগস্ট আমি ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতায় ফিরলাম, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বন্দে ভারত বিশেষ বিমানে লন্ডন থেকে একটা টিকিট জোগাড় করে দিল্লি পৌঁছে, সেখানে প্রথম সাতদিন হোটেলে, তারপরের সাত দিন ভাড়া করা ফ্ল্যাটে কোয়ারিন্টিন পর্ব চুকিয়ে কন্যা কলকাতায় পৌঁছল ঠিক পরের দিন। পুত্র মুম্বাইয়ে টানা চারটি মাস ফ্ল্যাট-বন্দি থাকার পরে চাকরি খুইয়ে কলকাতাগামী প্রথম বিমানেই টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে। অতিমারীর বীভৎসায় মুম্বাই তখন থরহরি কম্প, ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইস্কুল, কলেজের সঙ্গে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি ব্যবসার। দিন কতক হল পুত্রের পুরোনো অফিস ফের দরজা খুলেছে, কর্তৃপক্ষ ওকে ফেরার ডাক দিয়েছে সাদরে। সেই ডাকে সাড়া দিয়েই আবার সে চলল মুম্বই।

করোনার অবধারিত অনুষঙ্গ হিসেবে পুত্র-কন্যার গৃহে প্রত্যাবর্তন ছিল আমার কাছে লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার মতোই।তারপর গত কয়েক মাসে ওদের সঙ্গ থেকে এই বিপন্ন সময়ে আমি সংগ্রহ করেছি বেঁচে থাকার অক্সিজেন কিংবা অবসাদ ভোলার অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট।বলতে পারেন আবার সবাই মিলে এক ছাদের তলায় থাকাটা ধীরে ধীরে ফের একটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল, মাঝখানের বেশ কয়েকটা বছর প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আজ পুত্র ফের গৃহত্যাগী হল বলে শুধু যে অভ্যাসে ছেদ পড়ল তা নয়, দিল্লির সেই পুরোনো ব্যথাটা বুকের মধ্যে ফের মোচড় দিয়ে উঠল। আমার বেকার জীবনে আবার তৈরি হল নতুন শূন্যতা, মন কেঁদে বলে উঠল, ‘ শূন্য এ বুকে পাখি মোর, আয় ফিরে আয়।’

জানি এ বেদনা কেবল আমার একার নয়। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত বলয়ে এটা ঘর ঘর কি কাহানি, প্রৌঢত্বে অথবা বার্ধক্যে সন্তান বিচ্ছিন্ন বেদনাতুর নিঃসঙ্গ জীবন। অনভিপ্রেত কিন্তু অনিবার্য। চারপাশে যখন তাকিয়ে দেখি আমাদের চেয়েও করুণতর অবস্থা, নিজের বেদনাবোধ তখন কিঞ্চিৎ লাঘব হয়। মনে হয়, আরে ওমুকের তুলনায় তো আমরা ভালো আছি।

আছিই তো। আমি আমার সমবয়সী এক ভদ্রমহিলার কথা জানি যিনি শান্তিনিকেতনের অদূরে এক গ্রামে একেবারে একা থাকেন তিনটি সারমেয়র সান্নিধ্যে। তাঁর একমাত্র মেয়ে, বিদুষী, উচ্চ-শিক্ষিত, দিল্লির কাছে একটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে বেশ উচ্চপদে আসীন। লকডাউন পর্ব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে চলে আসে মায়ের কাছে, মা-মেয়েতে মিলে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার সঙ্গে মহানন্দে কয়েকটা মাস কাটায়। আজ সকালে সেই মেয়েও দমদম থেকে দিল্লির বিমান ধরেছে বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে বলে। সেই মেয়ে দিন কতক আগে কাতর গলায় আমাকে বলেছে, ”জানো সুমনদা, মায়ের কথা ভাবলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এক মাস আগে থেকেই মা আমার চলে যাওয়ার দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছে। রোজ সকালে মায়ের মুখে একই কথা শুনি, আর তো মোটে ক’টা দিন তুই থাকবি আমার সঙ্গে।’ সেই মেয়ে আজ সকালে বিদায় নেওয়ার সময় তার মায়ের মুখটি কি আমার মুখের চেয়েও অনেক বেশি কালো দেখায়নি?

কিংবা আমার এক বন্ধুর কাহিনি বলা যাক। বন্ধুবর অতি সৌভাগ্যবান পিতা কেননা তাঁর দু’টি পুত্রই হীরের টুকরো, দু’জনেই আমেরিকায় আই ভি লিগ কলেজে দাপিয়ে লেখাপড়া করে। আমার পুত্র-কন্যার মতো বন্ধুবরের দুই পুত্রও করোনার তাড়া খেয়ে কয়েক মাস যাবৎ কলকাতায়। এবার তাদেরও প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসছে। সে কথা জানিয়ে বন্ধুবরটি বললেন, ”সবই ভাল সুমনদা, কেবল মুখ ফুটে দুই ছেলের একটিকেও বলতে পারছি না, লেখাপড়া শেষে ঘরে ফিরে আসিস বাবা। কোন মুখে এ কথা বলব বলতো?”

আমি, আমার বন্ধু আর শান্তিকেতনের সেই গ্রামের মা একই সুতোয় গাঁথা, আমাদের প্রত্যেকের দীর্ঘঃশ্বাসের আওয়াজটাও একই রকম। আদতে এটা একটা গোটা সমাজের দীর্ঘশ্বাস,যার কানাকড়ি গুরুত্বও নেই শাসকদের কাছে। নেই কারণ ভোট-ব্যাঙ্ক হিসেবে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের সংখ্যা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। কিংবা শাসকদের আলাদা করে দোষ দিয়েই বা কী লাভ। আমাদের এই শহর, এই রাজ্য আজ যদি আমাদের সন্ততিদের কাছে অ-বাসযোগ্য বলে মনে হয়, সুযোগের অভাবে তারা যদি দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়, সেই ব্যর্থতার দায় আমাদের ওপরেও সমান ভাবে বর্তায়।দীর্ঘঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আমরাই বা কী করলাম নিজেদের এই মাতৃভূমিকে শিশুদের বাসযোগ্য করে তুলতে? সত্যিই তো কোন মুখে আমরা সন্তানদের বলব, আয় বাড়ি ফিরে আয়!

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article