সাফল্য মানে নৌটঙ্কি
সুমন চট্টোপাধ্যায়
কোথাও একটা পুরো ইনিংস খেলার সুযোগ পাইনি, মানে দেওয়া হয়নি। সে জন্য আফশোস কিছুটা তো রয়েই গিয়েছে। সান্ত্বনা কেবল এই তথ্যটুকুতে যে বাংলা খবরের চ্যানেলের জন্মলগ্নের সময় আমি তার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। খবরের কাগজের চেনা মাঠ ছেড়ে আমাকে একটি চ্যানেলের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কতকটা স্বেচ্ছায়, তার চেয়েও বেশি বাধ্য হয়ে। সালটা ২০০৪, আজ থেকে ১৭ বছর আগে।
চ্যানেলের নাম ছিল স্টার আনন্দ, পরে স্টার বদলে এবিপি হয়েছে।
আমার বয়স তখন ৪৭। এমন একটা সময় যখন কেরিয়ারের অভিমুখ সচরাচর কেউ বদল করে না। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল নতুন চ্যালেঞ্জ। মনে হয়েছিল, খবরের কাগজকে তো জীবনের বাইশ-তেইশটা বছর দিলাম, এ বার দেখাই যাক না টেলিভিশন কতটা বিষম বস্তু।
গেলাম মুম্বইয়ে, স্টার নিউজের অফিসে প্রাথমিক তালিম নিতে, ছিলাম টানা তিন সপ্তাহ। প্রথম দিন পা রেখেই আমার শরীরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, পায়ের তলায় ভূমিকম্প হলে যেমনটা হয়। এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা, চারদিকে শুধু যন্ত্র আর কম্পিউটার, নিবু নিবু আলোয় ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে, তাদের ব্যস্ততা স্টেশনে পৌঁছে সবে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন ধরতে চাওয়া ছুটন্ত যাত্রীর মতো, ঘরের অন্যপ্রান্তে চড়া আলোর তলায় আরও চড়া মেকআপ নিয়ে দু’টি মেয়ে তারস্বরে খবর পড়ছে, এক্কেবারে প্রফেসার শঙ্কুর ল্যাবরেটরি। এ যেন উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে প্যারাট্রুপারের মতো ঝুপ করে নেমে পড়া। আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা, অথচ লজ্জায় কাউকে সে কথা বলতেও পারছি না। এঁড়ে গোরু কিনে তাঁতির কাল হওয়ার মতোই। একবার মনে হলো, কলকাতায় আনন্দবাজারের সম্পাদককে টেলিফোন করে বলেই দিই, এ আমার কম্মো নয়। পরক্ষণেই ইগো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে সেই অসহায়তাবোধকে চাপা দিয়ে দিল। টেলিভিশন কী এমন রকেট সায়েন্স যে আমি চেষ্টা করলেও বুঝতে পারব না? এতগুলি ছেলেমেয়ে পারছে, ম্যায় ভি কিসিসে কম নেহি!
পৃথিবী থেকে গিয়ে মঙ্গল গ্রহে ধাতস্থ হতে দিন কতক সময় লেগেছিল। অকৃপণ ভাবে আমাকে তখন সাহায্য করেছিল উদয় শঙ্কর, স্টার নিউজ নেটওয়ার্কের হর্তা-কর্তা-বিধাতা, আমার নতুন বস। উদয় হল ভারতীয় টেলিভিশনের ‘ওয়ান্ডার বয়’, সফলতম ব্যক্তিত্ব। বিহারের ছেলে, ক্ষুরধার মেধা, ঈর্ষনীয় নেতৃগুণ, চমৎকার বক্তা। স্টার নিউজে আসার আগে ও জি নিউজ এবং আজ তকের জন্ম দিয়ে এসেছে, দুটোই সফল। উদয়ের সঙ্গে কথা বললে মনে হত, টেলিভিশনটা ওর হাতের খেল না, কোনটা কী ভাবে করলে লোকে খাবে অব্যর্থ ভাবে সেটা বলে দিতে পারে। পাক্কা জহুরি রুপার্ট মার্ডক এই রত্নটিকে চিনতে ভুল করেননি। সরকারি নীতি বদলে যাওয়ার কারণে তিনি যখন খবরের চ্যানেলের স্বত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, উদয়ের হাতে তুলে দিলেন বাকি স্টার নেটওয়ার্কের দায়িত্ব। খবরের মতো বিনোদনকেও উদয় বশে আনল চোখের নিমেষে, ধীরে ধীরে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় উঠল একদিন। ডিজনি স্টার নেটওয়ার্ক কিনে নেওয়ার পরে হঠাৎ একদিন উদয় সিদ্ধান্ত নিল এনাফ ইজ এনাফ, এবার অন্য কাজ করবে। উদয়শঙ্কর এই মুহূর্তে দিল্লিতে, ফিকির সেক্রেটারি জেনারেল।
আমার নাতিদীর্ঘ টেলিভিশন কেরিয়ারে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটি হল উদয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ওর কাছ থেকেই টেলিভিশনের প্রথম পাঠ নেওয়া। আবার প্রথম চোটেই মোহভঙ্গ হয়েছিল ওর কথাতেই।
কলকাতায় ফেরার প্লেন ধরতে যাওয়ার আগে উদয়কে গুডবাই করতে গিয়েছি। কিছুক্ষণ আড্ডার পরে চেয়ার থেকে উঠছি উদয় বলল, ‘লেট মি টেল ইউ দ্য ওনলি মন্ত্র অব এ সাকসেসফুল নিউজ চানেল।’
সেটা কী?
‘নৌটঙ্কি’।
নিজেকে হংস মধ্যে বক যথা লাগছিল মুম্বইয়ে স্টার নিউজের নিউজ রুমে ঢুকে। কলকাতা ফেরার সময় উদয়ের মন্ত্রটি আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সারাক্ষণ। ‘নৌটঙ্কি’।
আমার প্রার্থনা শুনে ধরণী যদি সত্যিই দ্বিধা হতেন!