logo

এবার দ্যাখ কেমন লাগে

  • December 3rd, 2022
Suman Nama

এবার দ্যাখ কেমন লাগে

সুমন চট্টোপাধ্যায়

খেলাটার মাঝপথে ভাগ্যিস ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ক্যামেরুনের কাছে ব্রাজিল এক গোলে হারল, চোখের সামনে দেখতে হয়নি। প্রভাতে চক্ষু মেলিতেই দেখিলাম এই দুঃসংবাদ।ঝটকা লাগল, ব্যথা নয়। আগেই জানা ছিল, হারুক, জিতুক, ড্র করুক, ব্রাজিলের প্লে-অফ পর্বে যাওয়া তো নিশ্চিত!

সব বিশ্বকাপই কোনও না কোনও কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকে, অন্য আরও অনেক কারণের মধ্যে কাতার স্মরণীয় হয়ে থাকবে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলির হঠাৎ আলোর ঝলকানির জন্য যা প্রাথমিক পর্বের রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিল একেবারে শেষ মহূর্ত পর্যন্ত! তাদের শৌর্যের উজ্জ্বল ছটায় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে অনেক ফুটবল-জায়েন্টকে বাড়ি ফেরার বিমানে উঠতে হোল। সাচ্চা ফুটবল প্রেমিকের কাছে এটাও কি খুব কম কিছু পাওয়া।

এই যেমন উরুগুয়ে।গতকাল একই সময়ে গ্রুপ পর্বের অন্তিম চরণের দু’টি ম্যাচ চলছিল পাশাপাশি, একটিতে পর্তুগাল বনাম দক্ষিণ কোরিয়া, অন্যটি উরুগুয়ে বনাম ঘানা। পর্তুগাল তার আগেই দুটো ম্যাচ পকেটে পুরে প্লে- অফ পর্বে চলে গিয়েছিল, তালিকার দ্বিতীয় স্থানটি কে দখল করবে তা নিয়েই ছিল রোমকূপ খাড়া করা উত্তেজনা। পর্তুগাল যদি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারলে উরুগুয়ে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে প্রোমোশন পেয়ে যেত। পাশা উল্টে দিল দক্ষিণ কোরিয়া। রোনাল্ডোর দল দেখল লাল ড্রাগন কীভাবে পরাজয়ের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে পারে। এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থায় উরুগুয়ের প্রয়োজন ছিল ঘানাকে তিন গোলে হারানো। সেক্ষেত্রে গোল অ্যাভারেজের দাঁড়িপাল্লা উরুগুয়ের পক্ষে ঝুঁকে যেত। মরণপন লড়াই করেও উরুগুয়ে তা পারলনা, গোলের ব্যবধান দুই থেকে তিন হওয়ার আগেই রেফারি বেলা শেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। ইতিহাস তৈরি করল সোল, হেরে বাড়ি ফেরার আগে ঘানা বদলা নিয়ে গেল বারো বছর আগের একটি গর্হিত অন্যায়ের। এক্কেবারে পোয়েটিক জাস্টিস।

২০১০-এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে এই ঘানারাই জেতার কথা ছিল উরুগুয়ের বিরুদ্ধে। ম্যাচের এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি পেল ঘানা। গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে সেই বল যখন গোলে প্রায় ঢুকে পড়েছে, সুয়ারেজ গোল লাইনে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে বলটা বারের ওপারে পাঠিয়ে দিলেন। সময় শেষের বাঁশি বাজল, সুয়ারেজের শাস্তি হোল কেবল লাল-কার্ড, ঘানার কপালে জুটল বিশ্বকাপ থেকে অন্যায় বিদায়। গতকাল সেই সুয়ারেজকে দেখলাম সাইড লাইনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, সন্ধানী ক্যামেরার লেন্সকে ফাঁকি দিতে জার্সি ওপরে টেনে নিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন বারেবারে। মেসির কান্না দেখলে বুকে বাজে, সুয়ারেজের কান্নায় আমার কোনও প্রতিক্রিয়াই হোলনা। উল্টে চেঁচিয়ে বলে উঠতে ইচ্ছে করল, ‘ এবার দ্যাখ কেমন লাগে।’

সুয়েরেজ আজ ফুটবল ‘জেরেন্টোক্রেসির’ নিভন্ত তারকা, মেসি অথবা রোনাল্ডোর মতো কাতার ছিল তাঁরও বিদায়বেলার শেষ বিশ্বকাপ যদিও প্রথম দু’জনের এখনও যে দম আর স্ট্যামিনা আছে সুয়ারেজের তা নেই। প্রশ্নাতীতভাবে তিনি বিশ্বের উজ্জ্বলতম তারকাদের মধ্যে একজন, বার্সিলোনায় মেসির পাশাপাশি অনেক দিন খেলেছেন, অদ্ভুত ক্ষমতা সম্পন্ন গেম-মেকার। তবু বিশ্বকাপের আসরে তাঁর চারপেয়ের মতো কান্ডকারখানা, কখনও হাত দিয়ে গোল বাঁচানো, কখনও আবার বিপক্ষের খেলোয়াড়ের হাত কামড়ে দেওয়া, তাঁকে খলনায়কের আসনে বসিয়েছে বারেবারে। শক্তি চট্টোপাধযায়কে যা মানায় সুকল্প চট্টোপাধ্যায়কে যেমন তা মানায়না, অনেকটা তেমনি দিয়েগো মারাদোনাকে যা মানাতো, সুয়ারেজকে তা কখনও মানায় কী? মারাদোনার হাত ছোঁয়া বল বিপক্ষের গোলে গেলেও সেটা ‘ হ্যান্ড অব গড’ কেননা আকাশের ঈশ্বর তো ফুটবলের ঈশ্বরের সহায় হবেনই। ঈশ্বরের কি খেয়ে দেয়ে আর কোনও কাজ নেই যে অপাত্রে করুণা বর্ষণ করবেন? ফলে চোখের জলে বিশ্বকাপের মাঠ ছাড়াটাই ছিল সুয়ারেজের ললাট লিখন।

এশিয়া থেকে গ্রুপ অব সিক্সটিনে গেল জাপান আর কোরিয়া। জাপানের গৌরব প্রতিবেশির চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি কেননা জার্মানি আর স্পেনের মতো সুপারপাওয়ার ফুটবল যুদ্ধে তাদের পদানত। আফ্রিকা থেকে উঠে এল সেনেগাল আর মরোক্কো, দ্বিতীয়জন তো বীরবিক্রমে। প্রথম গ্রুপ ম্যাচে মেসির দলকে হতচিকত করে দিয়ে সৌদিরাও কি ইতিহাস তৈরি করেনি।কাতারের বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সামান্য ছাত্র হিসেবে অচিরেই এক নতুন সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি। দেশের নামখানি এখন যাই হোকনা কেন, ইউরোপের ফুটবল এখন কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে। এবার কালা আদমির হাতে বিশ্বকাপ উঠবে সেই দিন আগত প্রায়। এও আরেক ধরণের রিভার্স কলোনিয়ালিজম। ইতিহাসের বদলা। ঢিলের বদলে পাটকেল!

5 comments

  1. সেদিনের সুয়ারেজ হেসেছিল। আর গতকাল সে কাঁদল। ফুটবল কিন্তু সবসময় হিসেব বরাবর করে দেয়।
    খুব ভালো লাগল পড়ে।

    1. ২৬ তম লাইনে দ:কোরিয়ার বদলে দ:আফ্রিকা হয়ে গেছে,সম্ভব হলে ঠিক করে দেবেন।🙏

  2. মানুষ হিসাবে সুয়ারেজ অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু মারাদোনা প্রকৃত ভাল মনের মানুষ ছিলেন।

Leave a Reply to Samiran Roy Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *