- August 13th, 2022
সাক্ষাৎ বাবাশ্রী
সুমন চট্টোপাধ্যায়
বৌ, নাপিত আর দাঁতের ডাক্তার কখনও বদলাতে নেই বলে উপদেশ শুনেছি। ঘাড়ে মাথা একটাই, বৌ বদলের চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সাহসই কদাচ কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। গত ১৫ বছর ধরে এক সেলুনে একই ক্ষৌরকারের কাছে গিয়েছি চুল-দাড়ি কাটতে। তারপর সব ওলট-পালট হয়ে গেল, আমার ও ক্ষৌরকার উভয়েরই জীবনে। দারুণ চালু সেলুন, কোভিডে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমার শর্মাজি এখন কোথায়, দেহাতে ফিরে গেল কি না, কিছুই জানতে পারছিনা। পুরোনো ফোনটার সঙ্গে শর্মাজির নম্বরটাও বেহাত হয়ে গিয়েছে। এখন মস্তকে চুল প্রায় সব ঝরাপাতা, তবু শর্মাজির জন্য মনটা ব্যাকুল হয় যখন অন্য নাপিতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
লক-ডাউনের কারণে আমার ডেন্টিস্টের চেম্বারও মাসের পর মাস বন্ধ ছিল। তা থাক, আমার প্রতিজ্ঞা ছিল নাপিতের মতো ডেন্টিস্ট আমি কিছুতেই বদল করব না। সমস্যা হয়েছে বারেবারে, অনেকে ভালো ডেন্টিস্টের হদিস দিয়েছেন, আমি মুখ বুজে ব্যথা-বেদনা সহ্য করেছি, একেবারে না পারলে আমার ডেন্টিস্টকেই ফোন করে ওষুধপত্রের নামধাম জেনে নিয়েছি।
বেশ কিছুদিন হল তাঁর চেম্বার খুলেছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আজ দুপুরে গিয়েছিলাম। বেশ ছোট চেম্বার, ডাক্তারের কাজের জায়গা আর রোগীর অপেক্ষা করার জায়গার মাঝে কাঠের হাফ-পার্টিশন। ওপারের সব কথা এ পারে বসে শোনা যায়। আমার ডাক্তারটি আবার একটানা দু’মিনিট মুখ বন্ধ করে রাখতে পারেন না, রোগীর সঙ্গে বকবক করেই চলেন। দাঁতের সমস্যা ছাড়া পার্থিব বাকি সব বিষয়ে।
আজ ঢুকেই মনে হল একটু যেন অপরিচিত পরিবেশ, হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ নেই, কোথায় যেন তার কেটে গিয়েছে। কৌতূহলী হয়ে ওপারে ঊঁকি দিয়ে দেখি, চেয়ারে আধ-শোয়া একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে, চাঁদপানা মুখ, ধবধবে ফর্সা। বাচ্চাটির মা মেয়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, বাবা একটু দূরে। টেনশনে মাথার হেলমেটটিও খুলে রাখতে ভুলে গিয়েছেন। কোমরে দু’হাত দিয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন কোথাও পান থেকে চুন খসলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আমি চুপ করে বসে মোবাইলে ওয়ার্ড পাজল খেলছিলাম, বাবার সঙ্গে ডাক্তারের কথোপকথনে মনোনিবেশ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
বাবা- আচ্ছা এরপরে কি খুব ব্যথা হতে পারে?
ডাক্তার- ওষুধ দিয়েছি, হওয়ার কথা নয়।
বাবা- তবু যদি হয়?
ডাক্তার- আমাকে একটা ফোন করবেন।
বাবা- আপনার ফোন নম্বরটা....
ডাক্তার- প্রেসক্রিপশনে লেখা আছে।
বাবা- বেশি রাতে প্রয়োজন হলে কি ফোন করা যাবে?
ডাক্তার- সেটা আপনার বিবেচনাবোধের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
বাবা- আচ্ছা আজ মেয়েকে কী খাওয়াব?
ডাক্তার- গরম জিনিস এক্কেবারে নয়। সব ঠান্ডা।
বাবা- ঠান্ডা মানে আইসক্রিম দিতে পারি?
ডাক্তার- নিশ্চয়ই পারেন। আপনার মেয়ে আইসক্রিম খেতে ভালোবাসে না?
বাবা- দু’টো-তিনটে পর্যন্ত দিতে পারি!
ডাক্তার- এত আইসক্রিম খাওয়া কি উচিত? ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
বাবা- আচ্ছা সাইট্রাস জাতীয় জিনিস চলবে? যেমন ধরুন ফলের জুস।
এ বার বোধহয় ডাক্তারের ধৈর্যচ্যুতি হল। জবাব না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘পরের সপ্তাহে কবে আসতে পারবেন?’
বাবা- আপনি যেদিন বলবেন। তবে ১১টায় হলে আমার একটু সুবিধে হয়, দিনের সেকেন্ড হাফে আমার অফিস।
ডাক্তার- আপনাদের জন্য আজ আমি কিন্তু কাঁটায় কাঁটায় ১১টায় পৌঁছে গিয়েছি, আপনারাই আসেননি।
বাবা- মানে রাস্তাঘাটের ব্যাপার তো আগে থেকে প্রেডিক্ট করা যায় না।
খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে ডাক্তার এ বার বাবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মানে এ বার ভিজিটটা দিন আর মানে মানে কেটে পড়ুন।
বাচ্চাটিকে তখন ওয়েটিং কর্নারে একটা চেয়ারের উপর বসানো হয়েছে। এ বার মা পরিচর্যা শুরু করলেন। পরম যত্নে চুল বাঁধা হল, ন্যাপকিন দিয়ে ঘনঘন মোছানো শুরু হল গোলাপি মিষ্টি ঠোঁট-দুটো। মেয়েটি একটি কথাও বলছে না, একটু পরে বুঝলাম বলতে পারছে না, ওর মুখের ভিতর কিছু একটা গুঁজে দেওয়া আছে। বাবা আবার গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন, ‘মেয়ের মুখ দিয়ে এত থুতু বেরোচ্ছে কেন?’
ডাক্তার নিজেই এগিয়ে এসে দেখলেন তারপর সহকারীকে বললেন, ওর মুখের ভিতর থেকে তুলোটা বের করে দাও।
এ বার আমার রক্তচাপ একটু একটু করে বাড়ছে। কেন না আমার সময় পিছোচ্ছে। ডাক্তারের সহকারী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বাবাকে এ বার সরাসরি বললেন, ‘কই ভিজিটটা দিন।’
বাবা- কত দেব?
এ বার ডাক্তার- সাড়ে চার হাজার টাকা।
মনে হল বাবার গায়ে ফোর-ফর্টি ভোল্ট লাগল। ‘আচ্ছা সেকেন্ড ভিজিটে কত দিতে হবে?
ডাক্তার- হাজার টাকা
বাবা- তারপরে?
ডাক্তার- তারপরেরটা তারপর দেখা যাবে।
বাবা এ বার জিন্সের পকেট থেকে এক তাড়া ৫০০ টাকার নোট বের করে গিন্নিকে ভালো করে গুনতে বললেন। কিছু টাকা কম পড়ছে দেখে বাবা এ বার একটা কালো হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলে একটা সাদা রঙের প্লাস্টিক বের করলেন, সেখান থেকে আরও কয়েকটি ৫০০ টাকার নোট বের হল। আমাকে আর বাবার মহাপ্রস্থান দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হল না। ওপার থেকে আমার নামে ডাক এল।
ডাক্তারের সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়, আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি এমন বাবা ছিলেন?’
মাথা নেড়ে ডাক্তারকে ফিরিয়ে দিলাম রসিকতা। ভদ্রলোকের এলেম আছে মানতেই হবে। আপনার মতো বচনবাগীশকেও চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন।
নিছকই বাবা নন। বাবাশ্রী।
এত উত্তেজনা আর উদ্বেগ যাকে নিয়ে, সে কিন্তু রা পর্যন্ত কাড়েনি। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপ করে থেকেছে, ইঞ্জেকশন নেওয়ার সময়েও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি। সাত বছরের একরত্তি মেয়ে, বাপের চেয়ে স্নায়ুর জোর বেশি।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী করলেন বাচ্চাটার?
খুব সিম্পল ব্যাপার। ওর দুটো দুধের দাঁত কিছুতেই পড়ছে না, অথচ নতুন দুটো দাঁত নিচু থেকে ঠ্যালা মারছে। বেয়াদপ দাঁত দু’টোকে শিক্ষা দিতে বাবাশ্রী সেগুলো পকেটে করে নিয়ে গিয়েছেন।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

