- August 16th, 2022
আমিও একদা পুতিনের সমর্থক ছিলাম…(২)
আনাশতাশিয়া করিয়ার
অনুবাদ— সুমন চট্টোপাধ্যায়
২০০৮ এল, আমরা আবার আশার ঝিলিক দেখতে শুরু করলাম। সে বছর দিমিত্রি মেদভেদেভ রাশিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তার আগে তিনি ছিলেন পুতিনের মনোনীত প্রধানমন্ত্রী।আমি ও আমার বন্ধুবান্ধব ভাবতে শুরু করলাম এবার হয়তো রাশিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এরপরেই আমার স্কুল বদল হল। সেই প্রথম নতুন স্কুলে আমি এমন কয়েকজন শিক্ষককে পেলাম যাঁরা আমাদের উদ্বুদ্ধ করলেন দুটো কাজ করতে। এক, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ও বর্তমান অবস্থার নির্মোহ পর্যালোচনা। এ কাজ করতে গিয়ে যদি ক্রেমলিনের সমালোচনা করতে হয় তাও সই। সক্কলকে ছাপিয়ে গিয়ে একজন শিক্ষক তো সোজা স্তালিনের জমানার কঠোর সমালোচনা করার দুর্জয় সাহস দেখালেন, বে-আব্রু করে দিলেন রাজনৈতিক নিপীড়নের বীভৎসা যার ফলে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। একথা ভাবলে ভুল হবে এমন শিক্ষক আর কোথাও ছিল না, কেবল আমি তার আগে কখনও এদের মুখোমুখি হইনি। নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত এমনতরো মতামত তার আগে আমি কখনও শুনিনি।
অচিরেই পরিষ্কার হয়ে গেল মেদভেদেভের আসল মতলব প্রেসিডেন্টের কুর্সি গরম করে রাখা যাতে পুতিনই আবার সেখানে ফিরে আসতে পারেন। ২০০৮ সালেই সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের কার্যকালের মেয়াদ ছ'বছর করে দেওয়া হল। ২০১১-র সেপ্টেম্বরে পুতিন যখন ঘোষণা করলেন তিনি চার বছর পরে ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামবেন আমরা অশনি সঙ্কেতটি ধরতে পারলাম। পুতিনের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে অন্তত ১২ বছর পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের কার্যকাল দীর্ঘায়িত করা।
আমি ও আমার বন্ধু-বান্ধব ভেবেছিলাম রাশিয়া হয়তো গণতন্ত্রের দিকে বাঁক নেবে। সে বছরই ডিসেম্বরে সরকার বিরোধী জনরোষ পৌঁছল তুঙ্গ বিন্দুতে, ১৯৯০-এর দশকের পরে এত বড় আন্দোলন রাশিয়াতে আর হয়নি। বিক্ষোভের কারণ ছিল একটাই, পুতিন ও তাঁর দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি যে সংসদীয় নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং করেছিল তা আর গোপন ছিল না। রাজপথে নামা বিক্ষোভকারীদের হাতে নানা কথা লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল, কোনওটায় লেখা ‘পুতিন ইজ এ থিফ’, আবার কোনওটায় ‘পুতিন মুক্ত রাশিয়া’। আমি ছবিগুলি দেখেছিলাম রুশি সামাজিক মাধ্যম 'ভিকন্টাকটে’-র সৌজন্যে। ফেসবুক এটির স্পনসর।
ততদিনে পুতিনের দুর্নীতি নিয়ে আমরা এত কথা শুনছি যে সব কিছুই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। ততদিনে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক, ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছি। আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের মতো গবেষণা শুরু করলাম। কারা প্রার্থী হয়েছেন, কী তাদের প্রেক্ষাপট, প্রচারের সার কথাটাই বা কী সব কিছু নিয়ে ছানবিন চলল। গবেষণা শেষে আমাদের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত হলেন মিখাইল প্রোখোরভ, এক বৈভবশালী ব্যবসায়ী যিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচিত হলে সংবিধান সংশোধন করে তিনি দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রের মিথ্যা প্রচার দু’টোই বন্ধ করবেন। হঠাৎ মনে হতে শুরু করল আমাদের এই প্রজন্ম যারা পুতিন জমানায় বড় হয়েছি অবশেষে তারা পরিবর্তন সম্ভব করতে পারব। এমনকি আমার ঠাকুমার পুতিন ভক্তিও ততদিনে টাল খেয়ে গিয়েছে, পরিবারের বাকি সবাই পুতিনকে বাদ দিয়ে অন্য প্রার্থীদের নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়লেন।
প্রচারপর্বের একেবারে শেষ পর্বে এসে কী করে যেন ছবিটা আমূল বদলে গেল। হঠাৎ মিডিয়ায় পুতিনের পক্ষে আর প্রোখোরভের বিরুদ্ধে প্রচারের টর্নাডো শুরু হয়ে গেল যেন। প্রচারের সারকথাটি ছিল, রাশিয়ার একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক প্রয়োজন, পুতিন ছাড়া আর কেউ নেই যাঁর কাঁধে এমন গুরু দায়িত্ব সমর্পণ করা যায়। নিজেকে বিভ্রান্ত আর আশাহত মনে হতে শুরু করল, ভোট এসে গেল শিয়রে। আমার এক বন্ধুও দেখলাম প্রচারে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে। 'আমার মনে হচ্ছে পুতিনকে নির্বাচিত করাটাই এখন একমাত্র উচিত কাজ। তাছাড়া আমার অব্যবহৃত ব্যালটে পুতিনের নাম ছাপ লাগবে এমনিতেই।'
ফলে অবাধ কারচুপির অভিযোগের মধ্যে পুতিন যখন ফের নির্বাচিত হলেন, আমার আশাভঙ্গ হল না।
এখন ভাবলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে যে ক্রিমিয়া বিজয়ের পরে আমি প্রবল উৎসাহে পুতিনপন্থী শিবিরে নাম লেখালাম। ২০১৩-১৪ সালে ইউক্রেনের ‘ইউরোমায়দান’ বিপ্লব রাশিয়ার টেলিভিশনে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। তবে প্রচারটা ছিল ভিন্ন কায়দায়, তথ্য বিকৃত করে। রাশিয়ার হাতের পুতুল, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিচের বিরুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের খবর বা সরকারের পতনের খবরটা আড়াল করে রাশিয়ার টেলিভিশন বলতে শুরু করল ইউক্রেনে সরকার ফেলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ফাসিস্তরা নাকি ক্ষমতা দখল করেছে। এই প্রসঙ্গে ক্রিমিয়ার দৃষ্টান্ত দিয়ে পুতিন ভজনা আরম্ভ হল, বলা হল তিনি কেমন বীরদর্পে সেখানে ফাসিস্তদের হাত থেকে এথনিক রাশিয়ানদের উদ্ধার করেছেন। আমার একটি ছবির কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে, ক্রিমিয়ার রাস্তায় সারসার বাড়ি, তাদের জানালা থেকে পতপত করে রুশি পতাকা উড়ছে। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? বাবার মুখে শুনলাম তিনি শুনেছেন আমাদের ছোট শহরেও নাকি ইউক্রেনের শরনার্থীদের স্বাগত জানানো হচ্ছে, রুশিরা নিজেরা যে সামাজিক সাহায্যটুকু পেয়ে থাকেন তা তাঁরা ছেড়ে দিচ্ছেন শরণার্থীদের জন্য। হঠাৎ পুতিন সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল যা আগে কখনও অনুভব করিনি।
রাশিয়ায় লেভাডা সেন্টার নামের একটি সংস্থা আছে যাদের কাজ ভোট নিয়ে গবেষণা চালানো। এরা নিজেদের স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করে। তাদের এক রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ সালে যেখানে পুতিনের জনপ্রিয়তা ছিল ৬৯ শতাংশ, মাত্র এক বছর বাদে ২০১৪ সালের এপ্রিলে তা হঠাৎ এক ঝটকায় বেড়ে হয় ৮২ শতাংশ। যেখানে তাকাই সেখান থেকেই শুনতে পাই একই প্রচার, শুনে আমার বিহ্বলতা বাড়ে। বিভ্রান্তিকর সব যুক্তিকে এক এক করে বিশ্লেষণ করার চেয়ে ক্রেমলিনের লাইন নিঃশব্দে মেনে নেওয়া ছিল সহজতর। আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করি, পশ্চিমের দেশগুলি পুতিনকে গালমন্দ করে আসলে আমার মাতৃভূমিরই হেনস্থা করছে। দেশপ্রেম সম্পর্কে আমার বোধবুদ্ধি এবার হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়াকে অন্ধ সমর্থন। এবার আমি আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কোনও আলোচনা করিনি, ধরেই নিয়েছিলাম, তাদের মনোভাবও নিশ্চিত একই হবে।
গত কয়েক বছর ধরে রাশিয়ায় স্বাধীন মিডিয়া বলে কোনও বস্তু নেই। ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এই অসুবিধেটা আরও তীব্র হয়েছে। কারণ পুতিন আইন করে বলে দিয়েছেন কেউ ‘ফেক নিউজ’ প্রচার করলে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থাৎ হয় ক্রেমলিন অনুমোদিত খবর প্রচার করো নতুবা ১৫ বছর গারদবন্দি হও। বেশ কয়েকটি মিডিয়া সংস্থা এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে, অনেক সংবাদিক দেশান্তরী হয়েছেন। রুশিদের মধ্যে যাঁরা সঠিক সংবাদ জানতে আগ্রহী তারা ভিপিএন ব্যবহার করে সেইসব খবরের সাইটগুলি পড়ে পুতিন যাদের নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। আর আমার বাবা-মা'র মতো অযুত মানুষের কাছে থাকল কেবল টেলিভিশন, খবরের কাগজ কিংবা সামাজিক মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মিথ্যার বন্যা। (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

