- August 13th, 2022
জয় জগদীশ হরে
নিরানন্দর জার্নাল (১৬)
জয় জগদীশ হরে
সুমন চট্টোপাধায়
তক্ষশিলা।
ইতিহাসের ছাত্র, এতবার পাকিস্তানে গিয়েছি, এমন একটি মহা-ঐতিহাসিক জায়গা দেখার সুযোগই হয়ে ওঠেনি। তুলনায় আমার কন্যা সৌভাগ্যবতী, সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে পড়ার সময় ওরা কয়জন বন্ধু মিলে পাকিস্তানে গিয়ে তক্ষশিলা দেখে এসেছে। আমি কেবল গপ্পো শুনেছি, ঘ্রাণেন অর্ধ-ভোজনং যাকে বলে।
নিজের কথা নয় বলতে বসেছি জগদীশচন্দ্র সেনগুপ্তর কথা। নিরানব্বই নট আউট, কোভিড গেট আউট এই নমস্য ভদ্রলোকের অসমাপ্ত কাহিনিতে যতি-চিহ্ন পড়েছিল তক্ষশিলায়। বেশিরভাগ সময়টা ট্রেনের ছাদে চড়ে, তার পর পাঠানের লাঠির গুঁতো খেয়ে নীচে নেমে যিনি সকাল আটটা-সাড়ে আটটায় তক্ষশিলা স্টেশনে এসে নামলেন।
ওভার টু জগদীশবাবু।
‘সারাটা দিন আমায় তক্ষশিলায় কাটাতে হবে কেন না আমার পরের ট্রেন সন্ধ্যেবেলায়। একটা ছোট হোটলে পোঁটলা-পুঁটলি রেখে আমি বেরিয়ে পড়লাম আর্কিওলজিকাল সার্ভের মহাযজ্ঞ দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক বাংলায় কথা বলছেন। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম, জানলাম তাঁর নাম রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনি যে মস্ত বড় ঐতিহাসিক, দুনিয়া জোড়া নাম এ সব কিছুই তখন জানতাম না। রমেশবাবুই উদ্যোগ নিয়ে আমার জন্য একটা টঙ্গার বন্দোবস্ত করে দিয়ে বললেন, যান, সব কিছু ভালো করে ঘুরে দেখুন। দেখলাম, একটা ঝুপড়িতে নেমে ডাল-রুটি খেলাম, বিকেলে হোটেল থেকে পোঁটলা বগলদাবা করে ফের এলাম স্টেশনে।’
জগদীশবাবুর গন্তব্যস্থলের নাম ছিল পারসেরা, পেশোয়ার থেকে বেশ কিছুটা দূরে কাশ্মীর সীমান্ত ঘেঁষা। পারসেরা পর্যন্ত কোনও ট্রেন নেই, তক্ষশিলা থেকে ফাউন্টেইন স্টেশন পর্যন্ত এসে নেমে পড়তে হবে। তারপর বাস। সে আরও দু’আড়াই ঘণ্টার যাত্রা। রেকর্ডারে জগদীশবাবুর সফরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তো মামুলি চাকরি নয়, দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার পেরোনোর গল্প। পুরোদস্তুর অ্যাডভেঞ্চার। বাঙালির কলজেয় তখন দম ছিল, সিলেট থেকে দিল্লি হয়ে, লাহোর-রাওয়ালপিন্ডি পেরিয়ে, তক্ষশিলা ছুঁয়ে, খাইবার পাসের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। বীরদর্পে, সাড়ে ছ’ফুট পাঠানের লাঠির খোঁচা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে। তাহলে ঘরকুনো বলে আমাদের বদনামটা দিল কোন মিনসে!
জগদীশবাবুর বাস পারসেরায় পৌঁছল রাত ১১টা নাগাদ। তারপর?
‘সেই কোন সকালে দুটো ডাল-রুটি খেয়েছি, পেটে ছুঁচোয় ডন মারছিল। দেখি, বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা জায়গায় অনেকে হ্যারিকেনের আলোয় গোল হয়ে বসে খাচ্ছে। মাংস-ভাত। আমিও অর্ডার করলাম। মাংসে হাত দিয়ে দেখি প্রচণ্ড শক্ত, তেলে ভর্তি, আঙুলে ব্যথা করতে লাগল। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি, পরে বুঝলাম গো-মাংস। আমার আর খাওয়াই হল না। আমি একটা দড়ির খাটিয়া জোগাড় করে শুয়ে পড়লাম, দেখলাম আরও পঞ্চাশ-ষাট জন সে ভাবেই শুয়ে আছে, যা হবার কাল সূর্য উঠলে দেখা যাবে। এক রাতের জন্য খাটিয়ার ভাড়া চার আনা।’
‘সকালে উঠেই আমি রওনা হলাম সার্ভে অফিসে যাব বলে। আমার কথা পাঠানরা বোঝে না, পাঠানদের কথা আমি বুঝি না। অনেকের সঙ্গে কথা বলার পরে মোটামুটি বুঝতে পারা গেল আড়াই মাইল হাঁটার পরে রাস্তার কিনারে যে দালানটা দেখা যাবে সেটাই সার্ভে অফিস। অনেক কষ্টে সেখানে পৌঁছে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, কয়েক জন বাঙালির দেখা পেলাম। তারা নিজেদের মধ্যে একটা মেস করে থাকছিল, আমার তো কিছুই নেই, আমি সেখানে ঢুকে পড়লাম। শতপথী বলে একটা ছেলে দেশের বাড়ি থেকে একজন চাকর সঙ্গে করে এনেছিল, নাম চিন্তামণি। এছাড়া আমাদের প্রত্যেকের জন্য একজন করে ব্যাটম্যান থাকত, সবাই পাঠান। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজ করত ওরাই। আমার ব্যাটম্যানের নাম ছিল গুলাম খুদা বক্স। বেশ কিছুদিন পরে বাড়ি থেকে বাবার একটা চিঠি পেলাম। লিখেছেন, একজন ভালো দেখে লোক রাখবে, অবশ্যই সে যেন হিন্দু হয়। জবাবে আমি বাবাকে লিখলাম খুবই ভালো একজনকে পেয়েছি কিন্তু নামটা আর উল্লেখ করলাম না।’
মুসলিমদের সম্পর্কে আমাদের মনোভাবে তার পরেও খুব একটা বদল হয়েছে কী? নাকি ছুঁতমার্গের সেই মজ্জাগত ট্র্যাডিশন এখনও চলছে সমানেই।
নাতনি মেঘনা এরপরে দাদুকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমার কেরিয়ারে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় কোনটা?’ দাদুর উত্তর, ‘চিনা আগ্রাসনের সময় নেফা সীমান্তে সার্ভের কাজ ফেলে রেখে, লোক-লস্কর, মালপত্র সঙ্গে নিয়ে টানা পনেরো দিন ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলে সুরক্ষিত জায়গায় নেমে আসা।’ দাদুর জবানীতেই শোনা যাক সেই রোমহর্ষক কাহিনি।
‘তখন অরুণাচল বলে কিছু ছিল না, গোটা জায়গাটাকে বলা হত নেফা, নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি। আমরা সীমান্তের কাছেই বিরাট সার্ভের কাজ করছি, আমার তলায় ২০জন সার্ভেয়ার, নেপাল থেকে আনা ৫০০ জন কুলি, কয়েক’শ খালাসি, একেবারে এলাহি ব্যাপার। আমার কাছে একটা ধুমসো ব্যাটারি-চালিত রেডিও ছিল, একদিন সকালে শুনি, চিনারা নাকি ভারতের দিকে এগিয়ে আসছে। এল, কিন্তু আমাদের বরাত ভালো আমাদের থেকে পাঁচ মাইল দূর দিয়ে ওরা নেমে গেল।’
পরের দিন সকালে আসামের গভর্ণরের ওয়ারলেস মেসেজ এল, সব কিছু, প্রয়োজনে টাকা-পয়সাও পুড়িয়ে দিয়ে অবিলম্বে চলে এস। কিছুক্ষণ পরে ওখানে পোস্টেড দু’জন পলিটিক্যাল অফিসার এসে আমাকে অর্ডার করল ওদের ২০ জন পোর্টার দিতে হবে। আমি বললাম কে আপনাদের অর্ডারের পরোয়া করে, আমি একজনও পোর্টার দেব না। অনেকক্ষণ ধরে কাকুতি মিনতি করার পরে ওরা আমার পা জড়িয়ে ধরল, বলল বাড়িতে স্ত্রীর প্রচুর জামা কাপড় আছে, পোর্টার না পেলে ওরা পথে বসবে। আমি তখন চারজন পোর্টারকে ছাড়তে রাজি হলাম। অনেক পরে জঙ্গল দিয়ে নামার সময় একদিন দেখি, ট্রাক বোঝাই শুধু টাকা। সরকার যেহেতু বলেছে টাকা পুড়িয়ে আসবে তাই ওরা আত্মসাৎ করার মস্ত সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। ওখানকার পোস্ট মাস্টারকেও দেখেছি, ধোপার মতো বড় পুঁটলিতে টাকা ভরে পালাচ্ছে, আমাদের খালাসিরা মাস পয়লা ওই পোস্ট অফিস থেকে বাড়িতে মানি অর্ডার করত। সেই টাকাগুলোই বোধহয় পোস্ট মাস্টার চুরি করেছিল।’
জগদীশচন্দ্র গভর্নরের আদেশ পুরোটা মানেননি। গাছ কাটার জন্য তাঁদের কাছে শ’পাঁচেক ভারী ভারী কুঠার ছিল, বড় গর্ত করে বস্তা ফেলে কুঠারগুলো সেখানে চাপা দেওয়া হল। এর বাইরে কোনও কিছুতে তিনি আগুন ধরাতে দেননি, কিছু ফেলেও আসেননি। দিবা-রাত্র গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ চলতে চলতে তাঁরা দিন পনেরো পরে নেমে আসেন ফুট-হিলসে। সমতলে। কেউ কোত্থাও নেই, রেল লাইনে ফাঁকা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, ভারতীয় ফৌজের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলের পথে জগদীশ-বাহিনী অনেকগুলি পরিত্যক্ত রাইফেল খুঁজে পেয়েছিল।
ফুট হিলস থেকে সমতলে শুরু হল পদযাত্রা, থামল চার দুয়ারে এসে। চার দুয়ার ক্যান্টনমেন্ট টাউন, কোনও জনপ্রাণী নেই। সবাই আপনি বাঁচলে বাপের নাম করে পালিয়েছে। গোটা শহরে মানুষ বলতে দু’জন পাহারাদার, সরকারি গুদাম সুরক্ষার দায়িত্বে। জগদীশবাবুর বর্ণনায়, ‘পালিয়ে যাওয়ার সময় আর্মির লোকেরা এদেরও তুলে নিতে এসেছিল। কিন্তু এরা যায়নি। বলেছে, এখান থেকে চলে গেলে তো আমাদের চাকরিটা যাবে আর চাকরি চলে গেলে ভুখা মরতে হবে। কিন্তু চিনারা যদি আসে? ওদের জবাব ছিল, আনে দিজিয়ে না, মানা লেঙ্গে।
এই দুই পাহারাদারের কর্তব্যপরায়নতা জগদীশবাবুকে মুগ্ধ করেছিল। ফৌজ পালিয়ে যাওয়ার পরেও যারা কর্তব্যে অবিচল থাকে তাদের পুরস্কৃত করার জন্য উপরমহলে জগদীশবাবু চিঠি লিখেছিলেন। বছর খানেক পরে দুই পাহারাদার কয়েকশ টাকা করে সরকারি ইনাম পায়।
নটে গাছটি মুড়োলে জগদীশগাথার উপসংহারটি হতে পারে এই রকম। যে মানুষ পাঠানদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, সন্নিকটে চিনা ফৌজের গুলির আওয়াজ শুনেও যাঁর পা কাঁপেনি, সামান্য ভাইরাস তাঁকে ভয় দেখাতে পারে কি? হৌসলা বুলন্দ থাকলে যে কোনও বিপর্যয়ে বুক চিতিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়।
আসুন আমরা সকলে জগদীশবাবুকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর শতবর্ষপূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করি।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

