Wednesday, October 30, 2024

নেশার নাম ক্যামেরা

Must read

নিরানন্দর জার্নাল (১১)

নেশার নাম ক্যামেরা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আজ সকালে ২৪ ঘণ্টার শর্মিষ্ঠা গোস্বামী টেলিফোনে অনুরোধ করেছিল, গত রাতে চলে যাওয়া অঞ্জনকে নিয়ে দু’কথা বলার জন্য। অনেকদিন হল, শত্রু এড়াতে আমি একনিষ্ঠ ভাবে বোবার ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি, শত প্ররোচনাতেও তার অন্যথা করি না। অঞ্জনকে নিয়ে বলার অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না, প্রতিজ্ঞায় ছেদ টানতে হল।

মিনিট দু’য়েক বলেছি কি বলিনি চ্যানেল ফোনটা কেটে দিল। কেন? না মন্ত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে ততক্ষণে সিবিআই-এর অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে, সদ্য প্রয়াত নিজেদের সম্পাদককে ভুলে ঢুকতে হবে সেই খবরে। অন্যথায় টিআরপি মার খাবে, টিআরপি না পেলে বসেরা ঝাড় দেবে, বিধি বাম হলে সাধের চাকরিটাও ‘নট’ হয়ে যেতে পারে।

না, ২৪ ঘণ্টার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই, কেবল বক্তব্য শেষ করতে না পারার একটা খচখচানি মনে রয়েই গিয়েছে। আমি যদি আজ কোনও চ্যানেলের দায়িত্বে থাকতাম, একই কাজ করতাম। করতাম কারণ খবরের কারবারির চেয়ে খবর বড়, আর খবর হলো ঠিক যেন সমুদ্রের ঢেউ। একটি ঢেউ এসে পাড়ে যে রেখা এঁকে যায় পরের ঢেউয়ের কাজই হলো সেটিকে মুছে দেওয়া। বেচারা অঞ্জন প্রাতঃকালের এমন মহা-নাটকের সঙ্গে পাল্লা দেবে কী করে?

একের পর এক সহকর্মী অকালে, অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যাচ্ছে আর আমি মর্গের দারোয়ান সেজে তাদের অবিচুয়ারি লিখেই চলেছি। রহিত বসু গেল, শৌনক লাহিড়ি গেল, অরিন্দম সরকার গেল, অঞ্জনটাও রইল না। কাজটা এমনিতেই মর্মান্তিক, অনুজের স্মৃতিচারণা তো বুকটা ফালা ফালা করে দেওয়ার মতোই। অঞ্জন কেবল আমার চেয়ে অনেকটা ছোট ছিল তাই নয়, দীর্ঘদিন আমার সহকর্মী ছিল, ছিল বড় আদরের আপনজন। কলকাতায় ওর সঙ্গে কাজ করেছি পরে দিল্লি ব্যুরোতেও টেনে নিয়ে গিয়েছি। অঞ্জন মানে নির্ভুল কপি, নির্মল আনন্দ, নিরন্তর হাসি আর উচ্ছ্বাস। এত প্রাণোচ্ছল, রসিক, ফূর্তিবাজ সহকর্মী আমি কমই পেয়েছি।

একটি বিষয়ে আমাদের দাদা-ভায়ের মিল ছিল, আমরা দু’জনেই খবরের কাগজ ছেড়ে অজানা টেলিভিশনের দুনিয়ায় ঢুকেছিলাম। আমি অনেকটাই বাধ্য হয়ে, অঞ্জন স্বেচ্ছায়। টেলিভিশনে অঞ্জনের সাফল্য সম্ভব হয়েছিল ওর প্রিন্ট মিডিয়ায় বিবিধ কাজে অভিজ্ঞতার জন্য, যেটা টেলিভিশনের লোকেদের নেই বললেই চলে। স্টার আনন্দ আর ২৪ ঘণ্টার জন্ম হয়েছিল প্রায় পিঠোপিঠি, আমি ছিলাম প্রথমটির দায়িত্বে, অঞ্জন প্রথম দিন থেকেই ২৪ ঘণ্টায় ছিল কি না, আমার মনে নেই। টেলিভিশনের সঙ্গে আমার পিরিত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, অল্প দিন করে এই চ্যানেল সেই চ্যানেলে কাজ করেছি ফুরণ খাটার মতো, কালে কালে অঞ্জন হয়ে উঠেছে টিভি সেলিব্রিটি। অঞ্জনের সঞ্চালিত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি হাজির হয়েছি, ওর বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন, রসবোধের প্রশংসা না করে পারিনি। বাংলা নিউজ টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চালককে আমার কাছে এ প্রশ্ন অবান্তর বিশেষ করে আজকের এজেন্ডা তাড়িত মিডিয়ায়। এটুকু বলতে পারি সবার মধ্যে অঞ্জন সবচেয়ে সুশিক্ষিত, ময়দানে নেমে খবর করা সাংবাদিক, বাংলা ভাষায় সবচেয়ে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ।

২৪ ঘণ্টায় লম্বা ইনিংস খেলার পরে পরিস্থিতির চাপে অঞ্জন ফিরে এসেছিল ৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে, আনন্দবাজার ডিজিটালের দায়িত্ব নিয়ে। আমার বিচারে অঞ্জনের গোটা সাংবাদিক কেরিয়ারে ডিজিটালের সম্পাদনাই ওর সেরা ইনিংস, ওর নেতৃত্বে এবিপি ডিজিটাল সত্যিই এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। আর অঞ্জনের জীবনের সবচয়ে বড় ভুলটি হল ডিজিটাল ছেড়ে ফের টেলিভিশনে ফিরে যাওয়া। সত্যি কথা বলতে কি অঞ্জনের এই সিদ্ধান্ত আমাকে বিস্মিত করেছিল, আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তারপর একদিন যখন দেখলাম অঞ্জন প্রশস্ত টাকে কৃত্রিম চুল গজিয়ে নিজের বয়স লুকোনোর চেষ্টা করছে আমি হাসি চেপে রাখতে পারিনি।

ভুল সবাই করে, অঞ্জন একটা ভুল করলে আমি এক ডজন করেছি। কিন্তু অঞ্জনের মতো বুদ্ধিমান ছেলে মাঝ-পঞ্চাশে পৌঁছে এমন একটা ভুল করল কেন? স্বাধীনতার মানদণ্ডে এবিপি ডিজিটালের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার কোনও তুলনাই চলে না। অভীকবাবুর হঠাৎ হঠাৎ খামখেয়ালিপনাটুকু ছাড়া সেখানে সম্পাদকের স্বাধীনতা অপরিসীম। সেটা ছেড়ে অঞ্জন যেখানে গেল সেটা একপেশে দলীয় রাজনীতির পাঁকে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত, হুকুম বরদার না হলে সেখানে টেকার উপায় নেই। তাহলে?

সিগারেট, মদ, খইনি, গুটকা ইত্যাদির বাইরেও একটি নেশা আছে যার হাতছানি অস্বীকার করা খুবই কঠিন। বিশেষ করে একবার যে সেই নেশায় মজেছে তার পক্ষে। সেই নেশাটির নাম ক্যামেরা। চোখের পলকে পরিচিতি পাওয়ার এর চেয়ে ভালো প্রেমিকা আর কেউ নেই, পেটে বিদ্যে-বুদ্ধি আছে কি না সে প্রশ্ন নিরর্থক। আমার বিশ্বাস ক্যামেরার সঙ্গে বিচ্ছেদ অঞ্জন মেনে নিতে পারেনি, হাই-ভিজিবিলিটি থেকে একেবারে অন্তরালে চলে যাওয়াটা ওকে পীড়া দিয়ে গিয়েছে রীতিমতো। ফলে জীবনে যখন ফের একটা সুযোগ এসেছে ও টেলিভিশনে ফেরার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। আমি জানি অভীকবাবু ওকে পই পই করে নিষেধ করেছিলেন, অঞ্জন শোনেনি।

এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেনি অঞ্জন। করলে ওকে একটা কথাই বলতাম, ‘যে দরজা দিয়ে একবার বেরিয়ে এসেছিস, সেই দরজা দিয়ে আবার ভিতরে ঢুকিস না।’

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article