নিজস্ব প্রতিবেদন: সাসেক্সের ডিউক ও ডাচেস, তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানের আগমনবার্তা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকন্যার নামটিও সর্বসমক্ষে নিয়ে এলেন গত রোববার। মানুষটা অ্যাত্তোটুকু হলে কী হবে, নামটা তার ইয়া লম্বা! লিলিবেট ‘লিলি’ ডায়ানা মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর। ব্রিটিশ রাজপরিবারের আরও অনেক নামের মতোই, এই নামটাতেও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে দু’জন পূর্বনারীকে, প্রিন্স হ্যারির জীবনে যাঁদের প্রভাব অপরিসীম।
লিলিবেট। ভারী মিষ্টি, অন্যরকমের নাম, এক্ষেত্রে বেজায় তাৎপর্যপূর্ণও বটে! আমরা যাঁকে রানি এলিজাবেথ নামে চিনি, পরিজন-প্রিয়জনেরা এই ডাকনামেই ডেকে থাকেন তাঁকে।
চলুন, এ বার একটু পিছন পানে যাই। আজকের বৃদ্ধা রানি-মা তখন ছোট্ট রাজকন্যে, নিজের খটোমটো ভালো নামটা ঠিক করে উচ্চারণও করতে পারেন না। শিশুর আধো-বুলিতে যা বেরোতো তাই নকল করে আদরিণী নাতনীকে ডাকতেন রাজা পঞ্চম জর্জ। সেই নামই কালক্রমে কন্যের স্থায়ী ডাকনাম হয়ে গেল। ২০০২ সালে রাজমাতা যখন গত হন, তাঁর কফিনের ওপর রানির দেওয়া পুষ্পস্তবকটিই শুধু রাখা হয়েছিল, তাতে লেখা, ‘তোমার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছে তোমার প্রিয় লিলিবেট।’ ফিলিপ নামের রাজপুত্তুরও তাঁর স্ত্রীকে মেয়েবেলার এই ডাকনামেই নাকি ডাকতেন, গত এপ্রিলে পরপারে যাত্রা করার আগে অবধি।
রানি এলিজাবেথের ১১তম পুতি, প্রপিতামহীর রাজসিংহাসনের অষ্টম দাবিদার, সাসেক্সের রাজনন্দিনীকে অবশ্য ডাকা হবে ‘লিলি’ নামে, সেকেলে ‘লিলিবেট’ আধুনিক হল, আবার খ্রিস্টিয় পুরাণে পবিত্রতার প্রতীক লিলিফুলের নামও থাকলো। লিলিয়ান কিম্বা এলিজাবেথ নামের নারীদের সবচেয়ে প্রচলিত ডাকনাম ছিল লিলি, বরাবরই। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বছরভর রাজপরিবারের প্রতি সর্বসমক্ষে একের পর এক তোপ দেগে, রাজপরিবার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে, যে দূরত্ব ও বিদ্বেষের আবহ তৈরি করেছিলেন এই দম্পতি, এ নামকরণ সে ক্ষত নিরাময়ের প্রচেষ্টামাত্র, রানিকে লক্ষ করে উড়িয়ে দেওয়া শ্বেত-কপোত।
সদ্যোজাত লিলিবেটের দ্বিতীয় নামটিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে তার পরলোকগত পিতামহীকে। প্রিন্সেস অফ ওয়েলস বা প্রিন্সেস ডায়ানা, বেঁচে থাকলে এ বছরই ষাট ছুঁতেন যে রূপকথার নায়িকা।
১৯৯৭-তে প্যারিসে পাপারাৎসিদের এড়াতে সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় যখন মা-কে হারান, হ্যারি তখন দ্বাদশবর্ষীয় বালক। কৈশোরের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো হ্যারির মনোজগতে সেই মৃত্যু কী গভীর অভিঘাত তৈরি করেছিল, তা তিনি বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের চোখ-ধাঁধানো বিবাহটি জুড়ে হ্যারি ও মেগান বারবার ডায়ানার স্মৃতিকে উদযাপন করেছেন, সে অদ্বিতীয়ার কায়াহীন উপস্থিতি নিবিড় ভাবে ঘিরে রেখেছিল গোটা অনুষ্ঠানটিকে। তাঁর প্রিয় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল কনেকে, সদ্যবিবাহিত যুগলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম ভাষণটি ছিল তাঁর বোন লেডি জেন ফেলস-এর, তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরাও সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেনের রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার যে সাহসী সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন হ্যারি, তাও তাঁর মা’র কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। বছর দুয়েক আগে তাঁর কাকা প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে মার্কিনী ধনকুবের জেফ্রি এইপস্টেন সংক্রান্ত কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ার কারণে যে ভাবে রাজপরিবার থেকে প্রায় বিতাড়িত করা হয়েছিল, তার সঙ্গে কোনও ভাবেই তুলনা চলে না হ্যারির এই সিদ্ধান্তের। রাজকীয়তা তাঁকে বিপুল বৈভব, অসহ্য চাপ, নিঃসঙ্গতা আর মিডিয়ার অসুস্থ কৌতুহল ছাড়া কিচ্ছু দেয়নি। মা’র ভয়ঙ্কর মৃত্যু, বাবার অবহেলা, আত্মীয়-পরিজনের সংবেদনের অভাব, একের পর এক প্রেম ভেঙে যাওয়া, সব মিলে যে অশান্ত, অতৃপ্ত, বিক্ষুব্ধ শৈশব-কৈশোর ও যৌবন যাপন করেছেন হ্যারি, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, স্ত্রী-সন্তানদের একটা সুস্থ জীবন উপহার দেওয়ার জন্য সোনার শিকল ছিঁড়েছেন তিনি, স্বেচ্ছায়। আবেগপ্রবণ, মানবদরদী, বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের আত্মজ যে এমনটাই হবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী!
এই কিছুদিন আগে, এ বছরেরই জানুয়ারি মাসে, ওপরা উইনফ্রেকে দেওয়া খোলামেলা সাক্ষাৎকারটিতে মেগানের মণিবন্ধে ছিল শাশুড়ি-মা’র রেখে যাওয়া কঙ্কন। সারা পৃথিবীতে শোরগোল ফেলে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে মেগান তীক্ষ্ণ সমালোচনায় ফালাফালা করেন ব্রিটিশ রাজপরিবারকে, কী ভাবে শ্বশুরবাড়ির চাপ, অসহযোগিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব, মিডিয়ার নজরদারি তাঁকে বারংবার ঠেলে দিচ্ছিল আত্মহননের দিকে। হ্যারিও যেন বছর কয়েকের তফাতে তাঁর মা’র জীবনের ছাঁচটাই পুণরাবৃত্ত হতে দেখছিলেন মেগানের জীবনে, তাঁর সরু সুতোর ওপর টাল খেতে খেতে হেঁটে চলার মধ্যে। তার সঙ্গে যোগ হয় তাঁদের প্রথম সন্তান আর্চি হ্যারিসন মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসরের জন্মের আগেই তার চামড়ার রং নিয়ে কুরুচিকর চর্চা। রাজপরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ উগরে দিলেও রানিমায়ের প্রতি অবশ্য শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিই প্রকাশ পেয়েছিল মেগানের বক্তব্যে। অন্যদিকে, হ্যারি উইনফ্রেকে বলেছিলেন, সিংহাসন-দখলের ইঁদুর দৌড় থেকে তাঁদের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মা রাগ করতেন বটে, দুঃখও পেতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্তানের ভালো থাকা, নিজের মতো করে বাঁচা-ই প্রাধান্য পেত তাঁর কাছে। নামের লাতিন অর্থ ‘স্বর্গীয়’ হলেও ‘ডায়ানা’ তো এই পৃথিবীরই ধুলোমাটি মেখে, মানুষকে ভালোবেসে, নিজের শর্তে জীবনকে উদযাপন করার আরএক নাম ছিলেন আসলে!