- September 3rd, 2022
চাঁদের রাজ্যে পাড়ি
বাংলাস্ফিয়ার—সময়সীমা ও ব্যয়বরাদ্দ দুটোই ব্যাপকভাবে অতিক্রান্ত। তবু আনন্দের খবর হল এই যে নাসার নতুন চন্দ্রযানটিকে অবশেষে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হচ্ছে উড়ানে। অতীব ঝুঁকিপূর্ণ এক উড়ান, অতএব আপাতত যাত্রীহীন হবে এ যাত্রা।
১৯৬৯ এ নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখেন নাসার অ্যাপোলো চন্দ্রযানে সওয়ার হয়ে। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে ৩২২ ফুট (৯৮ মিটার) দৈর্ঘ্যের একটি সওয়ারী-বিহীন রকেট পাঠানো হচ্ছে আবার, একই গন্তব্যে, চাঁদের সুদূর কক্ষপথের অভ্যন্তরে।
সব ঠিকঠাক চললে, ২০২৪ এ একাধিক নভশ্চর চাঁদের চারপাশে কয়েক চক্কর দিয়ে আসতে পারবেন। ২০২৫-র মধ্যে চাঁদের বুকে দুজন পৃথিবীবাসী পা রাখবেন, এমনটাই নাসার পরিকল্পনা।
নাসার কর্মকর্তারা বলেই রেখেছিলেন ছ'-হপ্তাব্যাপী এই পরীক্ষামূলক উড়ানটি খুবই বিপজ্জনক ও ঝুঁকিবহুল, এবং সামান্য গণ্ডগোলের আভাস পেলেই তা স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়া হবে।(উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল গত সোমবার অর্থাৎ ২৯ অগাস্ট নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মুখে মহাকাশযানটিতে কিছু গোলযোগ দেখা দেওয়ার কারণে উড়ানটি তৎক্ষনাৎ মুলতুবি রাখা হয়, শনিবার ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, অর্থাৎ আজকের দিনটি নির্ধারিত হয়েছে দ্বিতীয় প্রচেষ্টার জন্য।) চন্দ্রযানটিকে কঠিনতম সব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, অভ্যন্তরে যাত্রী থাকলে যেমনটা কখনোই সম্ভব হত না। এভাবে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তোলা হবে মহাকাশযানটিকে, নিরন্ধ্র করা হবে নিরাপত্তার প্রশ্নে। গত বুধবার দ্য অ্যাসোশিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া বিবৃতিতে উপরোক্ত বিষয়গুলি পরিষ্কার করেন নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বিল নেলসন। তিনি আরো বলেন যে ব্যাপক ব্যয়বাহুল্য এবং সময়ের অপচয় সত্ত্বেও চন্দ্র অভিযানের ক্ষেত্রে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে কিনা, উন্মোচিত হবে কিনা নতুন দিগন্ত, সেসব অনেকখানি নির্ভর করবে এই উড়ানটির সাফল্যের ওপর।
চন্দ্র, মঙ্গল ও সুদূরতর মহাজাগতিক মানব-অভিযাত্রার যে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি চলেছে বছরের পর বছর ধরে, তারই প্রথম ফলশ্রুতি হতে চলেছে এই উড়ান। যেকোনো বৃহৎ বিপর্যয়ের সামনাসামনি হলে কি এই পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়বে নাকি নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে? উৎসুক পাঠকের মতই এ প্রশ্ন নাসার উপদেষ্টামন্ডলীর প্রাক্তন সদস্য জন লগসডনেরও।
আলোচ্য অভিযানের প্রস্তাবিত খরচ চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। দশক পূর্বে শুরু হওয়া প্রস্তুতি থেকে ২০২৫ এর প্রস্তাবিত চন্দ্র অবতরণ পর্যন্ত হিসেব করলে যে অর্থ হয় তা রীতিমতো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত। ৯৩ বিলিয়ন ডলার!
গ্রীক পুরাণের সূয্যিদেব অ্যাপোলোর যমজ বোন ছিলেন আর্তেমিস। পবিত্রতার প্রতীক। তাঁরই নামাঙ্কিত নাসার চন্দ্রলোক অভিযাত্রা সম্পর্কিত কিছু জরুরি তথ্য দেওয়া হল নীচেঃ-
১) অর্থশতক পূর্বে অ্যাপলো নামক চন্দ্রাভিযান কর্মসূচিতে ২৪ জন নভশ্চরকে নিয়ে যে স্যাটার্ন-৫ রকেটগুলো চাঁদে পৌঁছেছিল, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার চেয়ে কম হলেও নতুন মহাকাশযানটি অনেক বেশি মজবুত। আপাতত এর নামকরণ করা হয়েছে এস.এল.এস. রকেট না স্পেস লঞ্চ সিস্টেম রকেট, যদিও সরলতর হালফ্যাশানের কোন নামের সন্ধানে আছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। চেহারায় স্যাটার্ন ৫-এর মত ছিমছাম নয়, কিন্তু কার্যকর অনেক বেশি। দুটো গতিবর্ধক বুস্টার লাগানো এর শরীরে, উড়ানের ঠিক দু'মিনিটের মধ্যে যা খসে পড়বে অতলান্তিকে, আপনা থেকেই। তারপর টুকরো টুকরো হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে যাবে কেন্দ্রস্থিত অংশটি।উৎক্ষেপনের দু'ঘন্টার মধ্যে তীব্রবেগে নিক্ষিপ্ত হয়ে অরিয়ন নামক যানটি ধাবিত হবে সেই গন্তব্যের দিকে যাকে নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, পুরাণে কতই না গল্পগাছা, যাকে ঘিরে আছে মানুষের কত স্বপ্ন, আবেগ, কল্পনা।
২) নাসার অত্যুন্নত প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযানটির নামকরণ করা হয়েছে অরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের নামে। রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল এই নক্ষত্রপুঞ্জ ভারতবর্ষে মহাব্যাধ নামে পরিচিত। ৩ মিটার (১০ ফিট) দীর্ঘ এই যানটির ভিতর চারজন নভশ্চর বসতে পারবেন অনায়াসে। পরীক্ষামূলক এই উৎক্ষেপনে পূর্ণদৈর্ঘ্যের এক নকল মানুষকে কমলারঙের জামা পরিয়ে বসানো হবে দলপতির আসনে, তার কৃত্রিম দেহে গেঁথে নেওয়া হবে কম্পন ও ত্বরণ মাপার সেন্সর। মহাকাশযাত্রার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হল মহাজাগতিক বিকীরণ, সেটি মাপা হবে হাতপাহীন আরো দুটো মানব মূর্তি ব্যবহার করে। ইজরায়েলে তৈরি বিশেষ ধরণের একটি জ্যাকেট থাকবে একটি মূর্তির পরিধানে। ২০১৪ সালে এই অরিয়ন দু'বার প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীকে। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি এইবার একটি মডিউল জুড়ে দিয়েছে অরিয়নের লেজে, তাতে থাকবে চারটি পাখা যার মাধ্যমে সৌরশক্তি তৈরি হবে এবং ঠিক পথ ধরে এগিয়ে যাবে যানটি।
৩) ফ্লোরিডা থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ অবধি এই যাত্রাসূচী মোটামুটি ছ'সপ্তাহব্যাপী। ক্যাপসুলটি কতখানি মজবুত এবং চাপসহ তা পরীক্ষা করার জন্য সাধারণ মহাকাশ যাত্রার দ্বিগুণ সময় ধার্য করা হয়েছে অরিয়নের জন্য। পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যবর্তী ২,৪০,০০০ মাইল ( ৩,৮৬,০০০ কিলোমিটার) পেরোতে লেগে যাবে মোটামুটি একটি সপ্তাহ। চতুর্দিক সরেজমিনে ঘুরেফিরে ক্যাপসুলটি প্রবেশ করবে চাঁদের কোনো সুদূর কক্ষপথের সুদূরতম বিন্দুতে। তখন অরিয়ন চলে এসেছে পৃথিবী থেকে ২,৮০,০০০ মাইল (৪,৫০,০০০ কিলোমিটার) দূরে, যে দূরত্ব অ্যাপলো পেরোতে পারেনি। কথায় আছে, সব ভালো যার শেষ ভালো। এই অভিযানের একদম শেষে অপেক্ষা করে আছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা, যখন ঘন্টায় ২৫,০০০ মাইল (৪০,০০০ কিলোমিটার) গতিবেগে বায়ুমণ্ডলকে ছুঁয়ে অরিয়ন ঝাঁপ দেবে প্রশান্ত মহাসাগরে। অ্যাপলোর মত উচ্চ তাপমাত্রা নিরোধক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে অরিয়নের ক্ষেত্রেও, যা ৫,০০০ ডিগ্রি ফারেনহেইট (২,৭৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারবে।
৪) শুধু তিনখানি কৃত্রিম মানুষ-পুতুল নয়, এই উড়ানটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে একদল নিবিষ্ট গবেষকও। চন্দ্র-অভিমুখে তীব্রবেগে ছুটে যাওয়ার পথে জুতোর বাক্স-র মাপের দশখানা কৃত্রিম উপগ্রহ ক্যাপসুলটি থেকে বিযুক্ত হতে থাকবে আস্তে আস্তে। মুশকিলের ব্যাপার হল এই চৌকাকৃতি উপগ্রহগুলো প্রায় বছরখানেক আগে স্থাপন করা হয়েছিল রকেটটির শরীরে। অনিবার্য কারণে বারবার পিছিয়ে গেছে উড়ানের দিন, উপগ্রহগুলির ব্যাটারি রিচার্জ করা হয়নি সময়মত। ন্যূনতম খরচে তৈরি এই ক্ষুদ্রকায় উপগ্রহগুলো যেকোনো সময়ে অকেজো হয়ে যেতে পারে এমনটাই নাসার আশঙ্কা। মহাকাশযানটিতে স্মারক হিসেবে থাকবে ১৯৬৯ এ নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের চন্দ্রাভিযানকালে চাঁদের বুক থেকে সংগৃহীত কয়েকটি পাথরের টুকরো, ওই রকেটের ইঞ্জিনের একটা ছোট্ট অংশ। নাসার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উৎক্ষেপণের সময়ে অলড্রিন উপস্থিত না থাকতে পারলেও থাকবেন তাঁর তিন প্রাক্তন সহকর্মী। ওয়াল্টার কানিংহাম (অ্যাপলো ৭), টম স্ট্যাফোর্ড (অ্যাপলো ১০) এবং হ্যারিসন শ্মিট (অ্যাপলো ১৭)।
৫) অর্ধশতক পার হয়ে আজো নাসার বৃহত্তম সাফল্যের নাম অ্যাপলো। নাসার সর্বপ্রথম নভশ্চর ছিলেন অ্যালান শেফার্ড, তাঁর মহাকাশযাত্রার আটবছর পরে আর্মস্টং- অলড্রিন জুটির সেই রোমহষর্ক চন্দ্র-যাত্রা। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২- তিনবছরে মোট বারোজন নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা রাখেন, কেউই তিনদিনের বেশি সময় কাটাননি সেখানে। অন্যদিকে, আর্তেমিস, যার জন্ম কন্সটেলেশন নামাঙ্কিত চন্দ্রাভিযান প্রকল্পের ফলশ্রুতিতে, প্রায় দশবছর ধরে প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে। এখন অবধি ৪২ জন নভশ্চরকে বাছাই করা হয়েছে যাঁরা অন্তত সাত দিন অতিবাহিত করবেন চাঁদের মাটিতে, হাওয়ায়। অরিয়নের সুষ্ঠু প্রত্যাবর্তনের পরই তাঁদের নাম ঘোষণা করবেন নাসার বিল নেলসন।
সব ঠিকঠাক চললে এ গ্রহের মহাকাশচারীরা আরো একবার অবতরণ করবেন চাঁদের বুকে। তার আগে, অনেক কাজ বাকি এখনো। ২০২৪ এ পরীক্ষামূলক দ্বিতীয় উড়ানটিতে পাঠানো হবে চারজনকে। আরো চারজনকে পাঠানো হবে তারও বছরখানেক পর, তাঁদের মধ্যে দুজন চাঁদের দক্ষিণমেরু ছুঁয়ে আসবেন।
অ্যাপলোর মত নিজস্ব চন্দ্র অবতরক নেই অরিয়নের। এলন মাস্কের স্পেস এক্স থেকে স্টারশিপ মহাকাশযানটিকে ভাড়া করা হয়েছে অতএব। চাঁদে পরিধান করার উপযুক্ত জামা বানানোর কাজ দেওয়া হয়েছে দুটি প্রাইভেট কোম্পানীকে।
এমনতরো নানা কাজ, নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে আর্তেমিস তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। আমরাও অপেক্ষা করে আছি অধীর আগ্রহে তার সাফল্য।

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How


পরিশ্রম, অর্থ, সময় ইত্যাদির মিশেলে যে বিরাট কর্মযজ্ঞ , তারই ফলস্বরূপ আর্তেমিস যে চলেছে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে ….. সমস্ত পৃথিবী যেন ‘মানব- ভুবন’ হয়ে তার সাফল্য কামনা করছে।