- August 13th, 2022
একদিন যদি খেলা থেমে যায়
অপ্রমত্ত চিত্তের প্রযত্ন
সন্মাত্রানন্দ
যদি কেন, নিশ্চিত ভাবেই খেলা থেমে যাবে একদিন। আর খেলা যে থেমে যাবে—সে কথা খেলা শুরুর আগে থেকেই তো জানতাম! কারণ, যা নিয়ে খেলতে নেমেছি— এই দেহ, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার এবং যাদের সঙ্গে খেলতে এসেছি—এই ঘর, বাহির, ভুবন, মানবিক সম্পর্ক— সমস্তই সংকর বা যৌগিক। নানা উপাদানে গড়া। সে সব উপাদানের টুকরোগুলোকে যতই কেন বাসনার আঠা দিয়ে জুড়ে রাখি, একদিন তারা বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়বেই। খেলনা ভেঙে যাবে। খেলুড়েও ভেঙে যাবে। খেলা থেমে যাবে। কিচ্ছু থাকবে না।
মাটি থেকে উঠে আসা রস, সূর্যের আলো, বাতাস আর ফুলের বীজ—এরা আছে বলেই গোলাপ হয়েছে। গোলাপের কোনও স্বতন্ত্র সত্তা নেই। জল, আলো, বাতাস আর বীজের সত্তায় গোলাপ সত্তাবান। যদি জলকে বলি ফিরে যেতে ভূগর্ভে, আলোকে বলি ফিরে যেতে সূর্যলোকে, বাতাসকে বলি বয়ে যেতে অন্য দেশে, বীজকে বলি মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকতে, তাহলে ‘গোলাপ’ বলে কিছুই থাকবে না। এই সবই শর্তসাপেক্ষ, যৌগিক। উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট হয়ে গেলে কোনও বস্তু বা ব্যক্তিই তার সত্তাকে ধরে রাখতে পারে না আর।
সেই যে আড়াই হাজার বছর আগে অশীতিপর এক শ্রমণ কুশীনগর গ্রামের এক পাহাড়ের সানুদেশে দু’টি শালতরুর মাঝে শুয়েছিলেন তাঁর অন্তিম শয্যায়। তাঁর চারিদিকে সমবেত হয়েছিলেন তাঁর অনুগামীরা। মানুষের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় রচিত হচ্ছিল নিঃশব্দে। শেষ মুহূর্ত যখন এল, যখন বুজে এল তাঁর ক্লান্ত চোখ দু’টি শুকিয়ে যাওয়া ফুলের পাপড়ির মতো, তখন অন্তিম শ্বাস নিতে নিতে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন: ব্যয়ধম্মো সঙ্খারঃ অপ্পমাদেন সম্পদেত্তা—সকল যৌগিক বস্তুই ভেঙে পড়ে, তাই অপ্রমত্ত চিত্তে প্রযত্ন করো।
প্রযত্ন করো কীসের জন্য তবে? স্বার্থশূন্য হওয়ার জন্য। যেহেতু কিছুই রইবে না। তোমার ‘আমি’র চারিদিকে এই যে খেলাঘর, এ ভেঙে পড়বে অবলীলায়, নিভে আসবে তোমার ‘আমি’র প্রদীপ, যেহেতু তার অস্তিত্বও ‘তুমি’-সাপেক্ষ, যেহেতু তাও অন্তিমতঃ অলীক। যা থাকবে না, যা থেমে যাবে, তাকে টিকিয়ে রাখার, তাকে চিরত্ব দেওয়ার ভ্রান্তি করো কেন সারাজীবন? জলের দাগ মুছে যায় অচিরেই—here lies one whose name is writ in water.
এই যদি সত্য হয়, তবে কী ভাবে আমি তাকাব এই জগতের দিকে? এখানে যে কত গান, কত হাসি, কত প্রেম, কত মধুমাস! একথা সত্যি যে, এর পাশাপাশি কত ঈর্ষা, কত অসুন্দর, কত ক্রূর মন্ত্রণাও রয়েছে এখানে। তবু জগতে কি এতটুকু সুখ নেই? ভালোবাসা নেই? আছে তো! সুখ, দুঃখ সবই আপেক্ষিক। প্রেম-অপ্রেম সবই আপেক্ষিক। একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা যায় না, তাও সত্যি। তবু শুধু বিষাদের গান দিয়েই গড়া নয় মানবজীবন। শুধু মুশকিল হল, এরা কেউ থাকে না, চলে যায় যে! সুখ চলে যায়, দুঃখও চলে যায়। অপ্রেম চলে যায়, প্রেমও চলে যায়। অপবিত্রতা চলে যায়, পবিত্রতাও চলে যায়। চলিষ্ণুতার এই বোধ একবার রক্তের ভিতর ছড়িয়ে গেলে কেমন করে আর মুখ ডুবিয়ে ভোগ করতে পারি আমি?
পারি না। বরং তার পরিবর্তে মনের ভিতর যে হিমশৈল ধীরে ধীরে মাথা তুলতে থাকে, তার অন্য নাম কারুণ্য। মহাকরুণা। যেহেতু আমি জানি, এ রাতের রেলগাড়ির সওয়ারি হয়েছি আমরা সবাই। সময় হলেই নেমে যাব যে যার স্টেশনে। একই স্টেশনে সবাই নামব না। একই সময়ে নামব না সকলে। এই পথটুকু শুধু একসঙ্গে যাওয়া। তাহলে মিথ্যা দ্বন্দ্বে শক্তি আর সময়ের অপচয় না করে আমরা শুধু একে অন্যকে আরএকটু জায়গা ছেড়ে দিতে পারি। আমাদের খেলা থেমে যাবে, আমরা মরণশীল সকলেই, এ কথা জানলে এই মুমূর্ষু পৃথিবীকে বুকে তুলে নিতে পারি পরম মমতায়। আমাদের সমস্ত আদর, সমস্ত অশ্রুপাত, সমস্ত মায়াবী আনন্দের কিরণ, আমাদের সর্বস্ব আমরা ঢেলে দিতে পারি ধরিত্রীর প্রতিটি ধূলিকণার জন্য। ভালোবাসতে পারি, কিন্তু ধরে তো রাখতে পারি না কাউকে। এই প্রেম, এই জ্ঞান আমাদের সর্বোচ্চ দক্ষতায় খেলতে শেখায়, যে খেলা একদিন থেমে যাবে সময়ের মুষলাঘাতে। আমাদের শেখায় বহু যতন করে জ্বালাতে জীবনের সেই উজ্জ্বল প্রদীপ, যা নিভে যাবে একদিন চৈত্রাবসানের দুরন্ত বাতাসে।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

