31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

একদিন যদি খেলা থেমে যায়

Must read

আসল খেলাঘর বাঁধার আশায়

দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী

খেলাধুলোয় আমি চিরকাল অপটু। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। আর স্কুল কলেজের ট্র্যাক রেকর্ড তো তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
সোজা কথায়, ক্রীড়াচর্চা আর এই বান্দি আজীবন দুই মেরুর বাসিন্দা। বইপড়া, লেখালেখি, ছবি আঁকায় বরং স্বচ্ছন্দ বিচরণ আমার।
খেলতে আমি পারি না। কোনও খেলাই না— এমনটাই ভেবেছি জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। কিন্তু বালিকা থেকে কিশোরী হতে না হতেই এহেন সযত্নে লালিত বিশ্বাস গোঁত্তা খেতে শুরু করল। শোনা শুরু হলো- আরে এ মেয়ে তো পাক্কা খেলোয়াড়। স্কুলের শিক্ষিকা থেকে, শাস্ত্রীয় নৃত্যগুরু, পাড়ার স্বল্প পরিচিত সুদর্শন যুবক বা বাজারের মাছ বিক্রেতা যার কাছ থেকে যে ব্যবহারই বরাদ্দ হতে থাকল তার মূলে নাকি আমার ওই অপরিসীম এবং অনায়াস ক্রীড়া প্রতিভা।
আর কয়েকটা বছর বাদে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হতে হতে আর জীবনের নানা ধাপ পেরিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শুনতে শুরু করব নিজের ক্রীড়া প্রতিভাকে কী অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে গেছে একরত্তি এক মেয়ে। পিতৃপ্রতিম শিক্ষক থেকে অফিসের তরুণ সহকর্মী কিংবা কর্মজীবনের দীক্ষাগুরু সব্বাইকে না কি নিজের খেলুড়ে স্বভাবের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জীবনের যা কিছু উপাদেয় তা কচি বয়সেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে শিখে ফেলেছে অনায়াস দক্ষতায়।
আমার অদম্য জেদ, নিজেকে প্রমাণ করার যন্ত্রণাদায়ক খিদে, শরীর মন পাত করা লড়াকু মানসিকতা, ছিটেফোঁটা মেধা আর বিজ্ঞাপন বিমুখ সটান মেরুদণ্ড এই সব কিছুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সেই তবে থেকেই শুধুই আমার ক্রীড়া কৌশলের জয়জয়কার। কার সঙ্গে কতটা খেলে ঠিক কতটা সাফল্য অর্জন করেছি সেই স্কোরকার্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ। দু-এক জন তো আবার অতিরিক্ত উৎসাহে পরামর্শও চেয়ে বসেছেন মাঝেসাঝে। গোঁফ কিংবা ভুরুর ভাঁজে কিলবিল করতে থাকা কৌতুহলকে কোনওক্রমে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করতে করতে তাত্ত্বিক প্রশ্ন ফেঁদে ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে জানতে চেয়েছেন পুরুষরা এ খেলায় খালি গোল্লা পাবে এ কেমন বিচার! মহিলা সহকর্মীরা কেউ মুচকি হেসে আমার গেম প্ল্যানের বঙ্কিম প্রশংসা জুড়েছেন কেউ আবার খোলাখুলি গালিগালাজ।
সেই ট্রেন্ড আজও বহমান। এবং আজ এটা প্রতিষ্ঠিত বাজারি সত্য যে আমি এক ক্রীড়া প্রতিভা। জীবনের ময়দানে একা মহিলা হওয়ার সুযোগ কাজে লাগানো অবিরাম চার ছয় হাঁকিয়ে যাওয়া এক সুচতুর সুযোগসন্ধানী।
আর এই এত অযাচিত, বিরামহীন প্রশংসার বন্যায় এতটাই ক্লান্ত আমি যে জীবনের মাঝামাঝি স্টেশনে পৌঁছনোর বহু আগেই গাড়ি থামিয়ে নেমে যেতে সাধ হয়েছে মাঝে মাঝেই। মনে পড়ে অল্প বয়সে কতবার, কতজনকে, কত ভাবে বলার চেষ্টা করেছি আমি খেলতে শিখিনি, খেলতে পারি না। আনখশির সৎ সরকারি অফিসার সিঙ্গল মাদারের একমাত্র সন্তান এই মেয়েকে তার মা জীবনের মূল্যবান কিছু সত্যি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছেন শুধু। যার দৌলতে পদে পদে ধাক্কা খেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। কিন্তু সমাজের তথাকথিত খেলার চক্করে ঘাম ঝড়াইনি।
কে শোনে সে কথা! খেলার ময়দানের কৃত্রিম, অতি জান্তব উল্লাসে আমার কণ্ঠস্বর বারেবারে চাপা পড়ে গেছে। আমিও এই অযাচিত, ভিত্তিহীন ক্রীড়াচর্চা বাবদ অর্জিত খেতাব, শিরোপা ইত্যাদি তাচ্ছিল্য আর অবহেলায় এ দিক সে দিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে শিখে গেছি হয়তো। ভাবতে শিখেছি এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া নিষ্প্রয়োজন- বিশ্বজোড়া এই বিপুল ক্রীড়া আয়োজনে আমরা সবাই-ই তো খেলার পুতুল মাত্র।
তবে এই এত কিছুর মধ্যেও আমার অপেক্ষা থামেনি। খেলা থামার অপেক্ষা। ক্ষতবিক্ষত ক্লান্ত মন আর শরীরে আমি এখনও ভাবতে ভালবাসি যে একদিন আর কেউ আমায় খেলতে বলবে না, আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে কল্পনা করে নেবে না যে এ মেয়ে খেলতে চায়।
সব খেলা থেমে যাওয়া সেই দিনের অপেক্ষায় আমি। জীবনের আসল খেলাঘর বাঁধার স্বপ্নে আজও অক্লান্ত।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article