Wednesday, October 30, 2024

ভয় দেখে যায় চেনা (৩)

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

‘Of all the liars in the world, sometimes the worst are our own fears.’
-Rudyard Kipling

জর্জ বার্নার্ড শ এক্কেবারে হক কথাটি বলেছিলেন। ভয় এমনই এক ভয়াবহ বস্তু যা মানুষকে যে কোনও চরম বিন্দুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।

আমাদের যত অস্বস্তিকর অনুভূতি আছে ভয়ের স্থান তার সর্বাগ্রে। এখানেই পশুজগতের সঙ্গে মনুষ্যজাতির মিল। ভয় অথবা আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা অথবা ফোবিয়া, কম-বেশি সবসময়ই বিদ্যমান, আমরা সকলে কম-বেশি এর ফল ভুগে থাকি। ভয় থেকে অভয়ে উত্তীর্ণ হতে পারা অনেকটা নতুন জীবনে প্রবেশ করার মতোই দুঃসাধ্য।

ভয়ের উপকারিতাও একেবারে ফেলনা নয়। নৃতত্ত্ববিদ বা মনোবিদ, এ বিষয়ে সবাই একমত, যে ভয় হল, ‘natural evolutionary mechanism.! বটেই তো! ভয় পাই বলেই আমরা বিপদের সম্ভাবনায় সতর্ক হয়ে যাই, সত্যিকারের বিপদের মোরাবিলা করে এ ভাবেই আমরা জীবিত থাকি। যে ভয় আমাদের সজাগ, সতর্ক করে রাখে তার উপকারিতা প্রশ্নাতীত।

আরও এক প্রকার ভয় আছে যা আমাদের পঙ্গু করে দেয়, আমরা কয়েক পা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সামর্থ্যই তখন আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শাসক সাধারণত এই ভয়ের ওপরেই নির্ভর করে এবং ধীরে ধীরে তা যাতে সমাজের সব স্তরে সংক্রামিত হয় তা নিশ্চিত করে। এ ভাবেই গণমাধ্যমকে শাসকের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা হয়, নিবীর্যকরণ করা হয় সাধারণ ভাবে গোটা সমাজেরই। ধীরে ধীরে এই ভয়ই আমাদের সার্বিক অবচেতন মানসপটে থিতু হয়ে বসে, ভয় রূপান্তরিত হয় ‘প্যানিক’ আর সন্ত্রাসে। এ ভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সন্ত্রাসের সংস্কৃতি। হয় লাইনে এস নতুবা চুপটি করে বসে থাকো সুখী গৃহকোণে, মেলা ফটর ফটর কোরো না। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে যুগে যুগে শাসক দু’টি বস্তুর উপরে সমান গুরুত্ব দিয়ে শাসন দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছে- ভয় আর জনতার অপরিসীম অজ্ঞতা।

কেবল একনায়কতন্ত্রেই সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নাগরিককে ভয় দেখায় সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলী এমন একটি তত্ত্বকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। এখন অবাধ নির্বাচনে মানুষের ভোটে জিতে এসে শাসক সুলতানের মতো আচরণ করছেন এমনটাই দেখা যাচ্ছে অনেক দেশে- রাশিয়া, তুরস্ক, হাঙ্গেরি। গণতন্ত্রের নামাবলীটি গায়ে চাপাতে চান এঁদের সকলেই, বিশ্বের চোখে শাসনের বৈধতা প্রমাণের জন্য। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবশ্যিক শর্তগুলি এঁরা বরদাস্ত করেন না। যেমন পুতিন জাল-জোচ্চুরি করে ভোটে জিতে বছরের পর বছর রাশিয়া শাসন করে চলেছেন স্তালিনের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে, সেখানে সরকারের বিরোধিতা করা নিষিদ্ধ, সত্য কথা প্রচার করা নিষিদ্ধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে, প্রশাসন এবং বিচারবিভাগ উভয়েই শাসকের উপাসক। অথচ কাগজে কলমে রাশিয়া কিন্তু আজ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই যে গণতন্ত্রের ভেক ধরে আসলে স্বৈরাচার কায়েম করা, পণ্ডিতেরা তার নাম দিয়েছেন ‘ডেমোক্রাটিক ডেসপটিজম’, অনেকটা ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের আমলের ‘এনলাইটেন্ড ডেসপটিজিমের’ আদলে। এটাই এখন নিউ নর্মাল।

অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিত আছেন যাঁরা মনে করেন ভারতবর্ষও স্বৈরাচারের ঊর্বরভূমি। এঁরা মনে করেন, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা মাত্র, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ঠিক যেমন এটাও ভ্রান্ত যে জনরোষ আর বিবিধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দার্ঢ্যতার কারণেই ইন্দিরা জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এঁদের অভিমতে আসল কথাটি হল, আমাদের গণতন্ত্র এমন কিছু মজবুত নয় যে সেখানে স্বৈরাচারকে মাথা তুলে দাঁড়াতে আদৌ কোনও বেগ পেতে হবে। জরুরি অবস্থার ২৫ বছর পূর্তিতে লাল কৃষ্ণ আডবাণীর গলায় প্রায় একই রকম সাবধানবাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। ‘জরুরি অবস্থা উঠে গেছে ঠিক। সংবিধান সংশোধন করে এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাতে সহজে এদেশে আর জরুরি অবস্থা কায়েম করা যাবে না, এটাও ঠিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জরুরি অবস্থার উপাদানগুলি নির্মূল হয়ে গিয়েছে, ভারতীয় গণতন্ত্র সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত।’ বছর দুয়েক আগেই জরুরি অবস্থার কাঁটাছেড়া করতে গিয়ে প্রিন্সটনের এক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন কী ভাবে চাইলে একজন স্বৈরাচারী শাসক ভারতীয় সংবিধানকে নিজের মতো করে বদলে দিতে পারেন। মোদ্দা কথায়, ডেমোক্রাটিক ডেসপটিজম এখন ভারতেও নিউ নর্মাল, কোথাও তার লক্ষণগুলো দগদগে কোথাও ততটা নয়, এই যা।

চারদিক দেখে শুনে এখন আমার প্লেটোর কথাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। খ্রীষ্টের জন্মেরও ৩৮০ বছর আগে প্লেটো বলেছিলেন, আমজনতার হাতে যদি শাসনভার তুলে দেওয়া হয় তাহলে অনিবার্য ভাবে একদিন না একদিন তারা স্বৈরাচারী শাসককে সমর্থন করে বসবে। গণতন্ত্রের ধাত্রীভূমি প্রাচীন এথেন্সে শহরের একটি স্থানে নাগরিকদের সভা বসত, সেখানে এসে বিবিধ বক্তা কথার ফুলঝুড়ি ছোটাতেন, তার সঙ্গে সত্য বা তথ্যের কোনও সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু এ ভাবেই তাঁরা নাগরিক মনকে প্রভাবিত করতেন। তাঁরা আবার প্রশিক্ষণ নিতেন সফিস্টদের কাছে যাঁরা কী ভাবে জনতার আবেগকে প্রভাবিত করতে হয় সেই শিক্ষা দিতেন। শুধুই আবেগ, যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা নয়।

আসল ফাঁদটি পাতা এখানেই। ক্ষমতা তাঁর হাতেই যাবে যিনি আবেগ-সর্বস্ব কথাবার্তা বলে, নাটক করে জনতার চিত্ত জয় করতে পারবেন। তথ্য কিংবা প্রমাণ দেখিয়ে জনমত প্রভাবিত করার দায় তাঁর নয়, সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহননের সামিল। বিভ্রান্তিকর ভাষণ স্বৈরাচারীর বড় অস্ত্র কেন না তাঁর প্রয়োজন জনতা জনার্দনের নিঃশর্ত সমর্থন। এর ফল শেষ পর্যন্ত এথেন্সের পক্ষে খুবই মর্মন্তুদ হয়েছিল, সর্বত্র সেটাই হয়, তবু নেতার নাটকীয় বাগ্মিতার স্রোতে গা ভাসাতে জনতা দ্বিধা করে না। সেদিনের এথেন্সে করেনি, আজও করে না।

সে জন্যই সক্রেটিস সত্যের বদলে জনমতকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতাকে মেনে নিতে পারেননি, অনেক নিন্দামন্দ করেছিলেন। অবশ্য তখনও তাঁকে দণ্ড দেওয়া হয়নি, হেমলক তুলে দেওয়া হয়নি সক্রেটিসের হাতে। এখন জনতা হয় অজ্ঞতার কারণে নতুবা স্বার্থের বশে হেমলক পান করে চলেছে নিত্যদিন, নিয়ন্ত্রণহীন তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশে দেশে নব উন্মেষ ঘটাচ্ছে ডেমোক্রাটিক ডেসপটেজিম-এর।
(শেষ)

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article