31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আচ্ছা আজকালকার বাচ্চারা কি প্রেমপত্র লেখে? 
অলস মস্তিষ্ক মানে শয়তানের কারখানা। আমার মস্তিষ্কেও তাই নানা রকম পোকা নড়াচাড়া করে। নানা রকম উদ্ভট সব প্রশ্ন উঁকি দেয়। গতকাল এই প্রশ্নটি করে গিন্নিকে বললাম, তোমার কাছে মজুত থাকলে দু’একখানা দাও তো দেখি, ছেপে দিই। আমি কবি-শিল্পী-লেখক-অভিনেতা কিছুই নই, প্রেমপত্রের জন্য মরণোত্তর প্রসিদ্ধি আমার কপালে জুটবে না। যদি করতে হয় নিজেকেই সে কাজ করতে হবে।

গিন্নির কাছ থেকে প্রত্যাশিত জবাবই পেলাম। ‘আগে তোমার অন্য বান্ধবীদের কাছ থেকে জোগাড় করো, তারপর আমি ভেবে দেখব। তবে এটা ঠিক, আমায় লেখা তোমার প্রেমপত্রগুলি আমি খুব যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছি।’

তরুণ প্রজন্মকে প্রেমপত্র লেখার অভ্যাস ভুলিয়ে দেওয়ার মতো মহা-সর্বনাশটি করলে কে? অবশ্যই প্রযুক্তি। এখন সবার হাতে ফোন, স্মার্ট অথবা আনস্মার্ট। টুকটুক করে কয়েকটি শব্দ, বাংলায় অথবা রোমানে টাইপ করে দিলেই কেল্লাফতে। এদের আবার নিজস্ব শব্দকোষ আছে, যাদের অস্তিত্ব অভিধানে না থাকলেও এদের নিত্য ব্যবহারের উপাদান। অনেক সময় বন্ধুদের পাঠানো আমার ছেলে-মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মর্মোদ্ধারই আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। যেটা বুঝতে পেরেছি তা হল একটি শব্দ পুরোটা বানান করে লিখতেও এদের গায়ে জ্বর আসে, শব্দটিকে আরও খণ্ডিত করে তাকে অণু-শব্দে বা অপশব্দে পরিণত করাটাই হল এদের সংযোগের ‘লিঙ্গো’। টেক ইট অর লিভ ইট।

গুগল কেড়ে নিচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস, হোয়াটসঅ্যাপ পঙ্গু করে দিচ্ছে লেখার ক্ষমতা, প্রেমপত্র তো বহু দূরের ব্যাপার, বাজারের ফর্দটুকুও এরা ঠিক ভাবে লিখতে পারবে না। নিশ্চয়ই এরাও প্রেমে পড়ে, হয়তো বারেবারেই পড়ে, হাফ-সোল খেলে এদের বুকের ভিতরটাও হু হু করে ওঠে, নির্জন কোণা খুঁজে নিয়ে চোখের জল ঝরায়, শপথ নেয় জিন্দেগিতে আর প্রেম করবে না, অচিরেই সেই শপথ পথের ধুলোয় লুটোয়, আবার প্রেম করে। প্রযুক্তির বিশ্বে যত তোলপাড়ই হোক, রোবট এসে ছিনিয়ে নিক মানুষের অর্ধেক কাজ, মানুষের মনটা কিন্তু মনই থাকে, বহিরঙ্গের কোনও পরিবর্তন তাতে আঁচড়ও কাটতে পারে না। বুক চিড়লে ধরা পড়বে আমার সন্তানের মনটি আসলে আমার মনেরই প্রত্যয়িত নকল।
পার্থক্যটি তৈরি হচ্ছে ভিন জায়গায়। প্রেম নিবেদনের জন্য আমাদের হাতে যে সব অস্ত্র ছিল, সন্তানদের হাতে তা নেই, মানে সেগুলি যথাযথ প্রয়োগের ক্ষমতাটাই তারা হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। তাদের দোষে নয়, যুগ-বদলের অনিবার্য অনুষঙ্গে। আমাদের কৈশোর কিংবা প্রথম যৌবনে মন দিলে মন পাওয়া যাবে কি না বোঝার প্রথম ধাপটি ছিল একটা চিরকুট লিখে তৃতীয়পক্ষের সমর্থন নিয়ে সেটি যে করেই হোক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া, তারপর দুরুদুরু বুকে হা-পিত্যেস অপেক্ষা একটা জবাবের। এল যদি ধরে নিতে হবে সিগন্যাল সবুজ, না এলে কেস জন্ডিস, নজর ফেলো অন্য কোথাও অন্য কোনও খানে।

আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন লাভ-লেটার-রাইটার, নিজেরটা ছাড়াও আরও অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। যে কোনও লেখার ক্ষেত্রে লেখকের সামনে যে চ্যালেঞ্জ থাকে, প্রেমপত্রের ক্ষেত্রেও তা ভিন্ন নয়। এমন ভাবে লেখা যাতে শুরু থেকে শেষ এক নিঃশ্বাসে পড়তে বাধ্য হয়, প্রত্যাখ্যান করলেও তার আগে দশবার ভাবে। আবেগের আতিশয্য থাকলে চলবে না, আবার একেবারে আবেগ-বর্জিত হলেও সর্বনাশ। আদেখলাপনা, গলে যাওয়া ভাব দেখিও না, লেখায় যেন একটা নিরাসক্ত, নিরুচ্চার ঔদ্ধত্যের ছাপ থাকে। রবি ঠাকুরের গানের লাইন অথবা কোনও প্রেমের কবিতার লাইন নির্বিচারে যেখানে সেখানে বসিয়ে দিও না, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মোদ্দা কথা নিজের জমিটুকুতে সোজা দাঁড়িয়ে থেকে তারপরে হাতটা বাড়িয়ে দাও। তাতে প্রত্যাখ্যাত হলেও সম্মানটুকু পাবে।

আমার নিজের কাছে প্রেমপত্র ছিল লেখার অভ্যাস ঝালিয়ে নেওয়ার মস্ত সুযোগ। ফলে লিখতে বসে অনেক সময়ই আমার দৈর্ঘ্যের কথা মনে থাকত না, শেষ করে খামে পুরতে বেশ কষ্ট হতো, চিঠি তো নয় যেন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। অনেক সময় কস্তুরী রসিকতা করে বলত, উফ, এতক্ষণ ধরে চিঠি পড়া যায় না!
পুত্র-কন্যার সঙ্গে আমার বন্ধুর সম্পর্ক, কোনও ট্যাবু নেই, বাবা বলে কোনও কিছু গোপন করতেও হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে একবার মস্করা করে কন্যাকে বলেছিলাম, ‘দে তোর প্রেমপত্রটা আমিই লিখে দিই। কোনও দিন লিখিসনি তো ছড়িয়ে ফেলবি।’
মেয়ের জবাব, ‘বাট ইউ হাভ টু রাইট ইট ইন ইংলিশ!’
মাথায় বাজ পড়ল যেন। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় আবার প্রেম নিবেদন করা যায় নাকি? অসম্ভব, সে অসম্ভব।

বিখ্যাত লোকেদের প্রকাশিত প্রেমপত্র পড়তে আমার দিব্যি লাগে। বাইরে থেকে একজন বিখ্যাত মানুষকে যে ভাবে চিনি, তাঁর প্রেমপত্রে প্রবেশ করলে সন্ধান মেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর একজন মানুষের। প্রেমপত্র কেবল হৃদয় খোয়ানোর ব্যাকুলতা নয়, সব সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে সৎ, সংবেদনশীল ও পবিত্র। অন্তত যে মুহূর্তে সেই প্রেমপত্রটি লেখা, তখন।
সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়ন, যুদ্ধক্ষেত্রে নৃশংস অথচ স্ত্রী জোসেফিনের কাছে লেখা চিঠিতে শুধুই এলিয়ে পড়া প্রেমিক। রণাঙ্গন থেকে নেপোলিয়ন লিখছেন, ‘Since I left you I have been constantly depressed. My happiness is to be near you. Increasingly I live over in my memory of your caresses, your tears, your affectionate solicitude. The charms of the incomparable Josephine kindle continually a burning and glowing flame in my heart. When free from all solicitude, all harassing care, shall I be able to pass all my time with you, having only to love you, and to think only of the happiness of so saying and of proving it to you?’

এত প্রেম-মথিত কথাবার্তা লেখার পরে নেপোলিয়ন কী করেছিলেন? জোসেফিনের সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই বলে তাকে ডিভোর্স করে দিলেন।
তাহলে সত্য কোনটা, নেপোলিয়নের প্রেম না বংশরক্ষার তাগিদ? দুটোই। কেন? না এটাই জীবন।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article