- January 1st, 2021
বিদায় মাসিমা
বিদায় মাসিমা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
২০০০ সালে ডা: শিশির বসুর মৃত্যুর দিনে আমি সিঙ্গাপুরে ছিলাম। সেবার আমি প্রথমবার পিতৃহীন হয়েছিলাম। আজ সকালে কৃষ্ণা বসুর চলে যাওয়ার খবর পেলাম কয়েদখানায় বসে। এবার আমি দ্বিতীয়বার মাতৃহীন হলাম।প্রথমজনকে আমি মেসোমশাই ডাকতাম, দ্বিতীয়জনকে মাসিমা! কিন্তু এই বসু দম্পতীর কাছে আমি ছিলাম আগাগোড়া সন্তান-বিশেষ। নিজের বাবা-মাকে বাদ দিলে এঁদের দুজনের কাছে সারাটা জীবন আমি যে অপত্য স্নেহ, আদর, আশ্রয় এবং প্রশ্রয় পেয়েছি অন্যত্র কোথাও তা পাইনি! ৯০ নম্বর শরৎ বসু রোডের যে বাড়িটিতে তাঁরা থাকতেন তার নাম ‘ বসুন্ধরা’, আমার কাছে জননী-বসুন্ধরা।
আমার নিজের স্থির বিশ্বাস ছিল মাসিমা তাঁর কাকাবাবু নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর মতো সেঞ্চুরি হাঁকাবেন। বয়সের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিবিধ রোগ-উপসর্গ দেখা দিলেও মাসিমাকে তা কাবু করতে পারেনি কখনও। অশক্ত শরীর নিয়েও তিনি আজ লন্ডন তো কাল বস্টন করে বেরিয়েছেন, এমনি দুর্দমনীয় তাঁর মনের জোর। একটা সময় ছিল যখন হাঁটুর ব্যথার কারণে মাসিমা সিঁড়ি চড়তে পারতেননা, তখন হাইড্রলিক চেয়ারে বসে ওঠা-নামা করতেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী আর মাসিমার হাঁটু বদলের অপারেশন হয়েছিল একসঙ্গে, মুম্বাইয়ের হাসপাতালে, মার্কিন প্রবাসী একই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে। অটলবিহারী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, মাসিমা সাংসদ। আমি রসিকতা করে বলেছিলাম, হাঁটুর আমি, হাঁটুর তুমি, হাঁটু দেখে যায় চেনা!
বসু-দম্পতীর বড় পুত্র সুগত আর আমি কলেজ জীবনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলাম, সেই সূত্রেই ১৯৭৪ সাল থেকে আমার বসুন্ধরায় যাওয়া-আসা। তখন আমরা থাকতাম এই বাড়ি থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে, দেওদার স্ট্রিটে।রোজ বিকেলে বসুন্ধরা ছিল আমাদের অনিবার্য আড্ডাস্থল, নীচের তলায় মেসোমশাইয়ের চেম্বারের ঠিক পাশের ঘরটিতে। ওটাই ছিল আমাদের নিজস্ব পার্লামেন্ট। শিশির বসু খ্যাতনামা শিশু চিকিৎসক, বিকেলবেলা বসুন্ধরার নীচের তলার ড্রয়িং রুমটি কচিকাঁচার কিচিড়-মিচিড়ে সরগরম থাকত, আমাদের গল্প-গুজবের আওয়াজ তার নীচে ঢাকা পড়ে যেত। মেসোমশাইয়ের সে ঘরে পদার্পণের কোনও প্রশ্ন ছিলনা, তবে মাসিমা কখনও কৌতুহলবশত, কখনও চা-জলখাবার লাগবে কি না খোঁজ নিতে সে ঘরে ঊঁকি-ঝুঁকি দিতেন। তারপরে দিন গেলে আমিও কীভাবে যেন বসু-বাড়ির সদস্যই বনে গেলাম। যখন খুশি বেল বাজিয়ে ঢুকে পড়তে পারি, চেয়ে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে পারি,মায় অনেক বেশি রাত হয়ে গেলে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তেও পারি। ছেলেবেলা থেকেই সুগত পরিণত বয়স্কের মতোই আচরণ করত, মাত্রাজ্ঞান খোয়াতনা কিছুতেই। আমি ছিলাম স্বভাব-বখাটে, বাড়িতে মা, বসুন্ধরায় মাসিমা হাসিমুখে আমার দামালপনা সহ্য করতেন। মায়ের কাছে তবুও বা কখনও-সখনও চড়-থাপ্পড় খেয়েছি, মাসিমার কাছে কদাচ নয়।মারধোর দূরস্থান, এমন নরম প্রকৃতির মানুষ যে উচ্চস্বরে বকাঝোকাও করতে পারতেননা। না আমাকে না তাঁর তিন সন্তানের কাউকে।
মাসিমা এসেছিলেন ময়মনসিংহের বিখ্যাত, সংস্কৃতিবান, চৌধুরী পরিবার থেকে।বসুরা ঘটি মাসিমা বাঙাল, তবু তা নিয়ে কখনও চাপান-উতোর শুনিনি। মাসীমার বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরী আমাদের কলেজের দিনগুলোয় রোজ বিকেলে তাঁর রাসবিহারী অ্যাভিন্যুর বাড়ি থেকে লাঠি হাতে বসুন্ধরায় কিছুক্ষণ সময় কাটাতে আসতেন। নাতি/নাতনিদের সঙ্গে আমিও তাঁকে ‘ দাদুয়া’ বলেই ডাকতাম।সহোদর নীরদচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর চেহারায় মিল থাকলেও স্বভাবে ছিলেন একেবারে বিপরীত মেরুতে। তিনিও অসামান্য পণ্ডিত, যদিও তা কদাচ জাহির করতেন না। ভাল গান গাইতেন, এসরাজ বাজাতে পারতেন, সুর অশুদ্ধ মনে হলে তা শুধরেও দিতেন। মাসিমার গানের গলাটিও ছিল চমৎকার! মাতুলালয় সূত্রেই সুরের রসিক হতে পেরেছে শর্মিলা ও সুগত। শর্মিলা রেওয়াজ করছে, চেয়ারে বসে দাদুয়া চোখবন্ধ করে নিবিষ্ট মনে শুনছেন, এই ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে! অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর গানের এত চর্চা আমি আর দ্বিতীয় কোনও বাঙালি পরিবারে দেখিনি।
বাঙালির কাছে সুভাষচন্দ্র বসু আজ যে সহজলভ্য হতে পেরেছেন তার পিছনে নীরব অবদান এই বসু দম্পতির। নেতাজির উত্তরাধিকার জীবনের মূল্যে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা ছিল শিশির-কৃষ্ণার সারা জীবনের সাধনা! দু’জনে লিখেও গিয়েছেন নিরন্তর।মাসিমা জাত লেখক, তাঁর বাংলা গদ্য যেমন সুখপাঠ্য তেমনি নিজস্ব শৈলীর ওপর প্রতিষ্ঠিত।নেতাজিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন অনেক পণ্ডিত, কিন্তু জনতার সরণিতে তাঁক হাজির করিয়েছেন বসু দম্পতি, বিশেষ করে মাসিমা। নেতাজির বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারময় জীবনের এক অপরূপ আলেখ্য মাসিমার বই “চরণরেখা তব”, আমি বার তিনেক সেটা পড়েছি তো বটেই! এই তো সেদিনই আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পাতাতে লেখা পড়লাম তাঁর।
গত চোদ্দ-মাসে আজই প্রথম মনে হল, পারলে গরাদ ভেঙে একছুটে কলকাতায় চলে যাই, দু’দণ্ড গিয়ে দাঁড়াই মাসিমার পাশে, কাঁধে হাত রাখি সুগতর! হে ঈশ্বর আর কতো পরীক্ষা নেবে আমার, আর কতে আঘাত সইতে হবে এমন নিরালা অন্ধপুরীতে। ১৯৮৪-তে আমার মা যখন অকস্মাৎ চলে গিয়েছিলেন আমি কলকাতায় ছিলাম না! আজ আর এক মায়ের শেষ দর্শনেরও সৌভাগ্য হল না আমার! সত্যিই আমি মহাপাতক।
(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

