Wednesday, October 30, 2024

কবি তোর কাপড় কোথায়

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থা জয় গোস্বামীর এক গুচ্ছ কবিতা নিয়ে এই সবে একটি চটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। এটাই তাদের প্রথম বই। সব কবিতারই বিষয়বস্তু গুজরাত দাঙ্গা।

ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে আজকাল আর কোনও অনুষ্ঠানে শারীরিক ভাবে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমি অবশ্য এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাইনি, হাজির থাকার তাই প্রয়োজন বা অবকাশ কিছুই ছিল না। তবে ওই প্রকাশনা সংস্থার পেজে ফেসবুক লাইভে আমি অনুষ্ঠানটি খুব মন দিয়ে দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই লেখা।

ঘটনার বিশ বছর পরে জয় কেন রাত জেগে জেগে গুজরাত নিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবলেন তা নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল। সেটা নিরসন করে দিলেন কবিবর নিজেই। বললেন, সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনা তাঁকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রথমটি এই রকম। মাস তিনেক আগে এক সান্ধ্য অতিথি কবির বাড়িতে গিয়েছিলেন গল্প-গুজব করতে। কথায় কথায় গুজরাত দাঙ্গার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি হতচ্ছেদার ঢঙে বলে ওঠেন, “ও সব অনেক পুরোনো ব্যাপার। বিশ বছর পরে এ নিয়ে চর্চা করা বৃথা।” জয় তাঁকে জবাব দেন, ‘তাহলে তো নাৎসিদের ইহুদি নিধন বা স্তালিনের জমানার গুলাগ আরও পুরোনো বিষয়, তাহলে এগুলো নিয়ে এখনও নিরন্তর চর্চা হয় কেন?’

সান্ধ্য অতিথির থোঁতা মুখ নিশ্চয়ই ভোঁতা দেখাচ্ছিল যদিও জয় সে প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করেননি। তিনি যা বললেন তার মানে দাঁড়ায় অতিথির এমন নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা তাঁর কবি-সত্ত্বায় শলাকা জ্বালিয়ে দিল, ছাপার মেশিন থেকে কাগজ বেরোনোর মতো একটির পর একটি কবিতা আসতে থাকল প্রথমে তাঁর মাথায়, তারপর কলমের ডগায়। যন্ত্রণায় হঠাৎ হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে যেত, কখনও রাতে সাড়ে তিনটেয় কখনও পৌনে চারটেতে উঠে তিনি কবিতা লিখতে বসে যেতেন।

দ্বিতীয় ‘ট্রিগার’টি এল গুজরাতের সন্ত্রাস দমন শাখা তিস্তা শেতলাবাদকে গ্রেপ্তার করেছে এই খবরটি শোনার পরে। আবার কবিতা উথলে উঠতে থাকল অবরুদ্ধ কণ্ঠে, লেখা হল আরও কয়েকখানি পদ্য, অবিরত ধারায়। দুই পর্বে লেখা এই কবিতাগুলি থেকে বাছাই করা কবিতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে এই কাব্য-চটিকা, নাম দেওয়া হয়েছে ’কঙ্কাল’।

সান্ধ্য অতিথির মন্তব্যে শেলবিদ্ধ হয়ে যে কবিতা-গুচ্ছ লিখেছিলেন, জয়ের ইচ্ছে ছিল তখনই সেগুলি প্রকাশ করা। কিন্তু ঘরের মানুষ আর শুভচিন্তকেরা তাঁকে নিষেধ করে বলেন, দিনকাল খুব খারাপ, এই সব কবিতা ছেপে মিছিমিছি ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ? সে যাত্রায় জয় আর খাল কেটে কুমীর ডেকে আনেননি, আস্থা রেখেছেন সেই বহুশ্রুত ইংরেজি প্রবচনে, ‘Discretion is the better part of valour.’

কিন্তু তিস্তার গ্রেপ্তারের পরে জয়ের মনের তিস্তা ব্যারেজ ভেঙে দু’কূল প্লাবিত হয়, তাঁর মনে হতে থাকে এই পদ্যগুলি প্রকাশ করা ’কবির দায়’ যা তাঁকে পালন করতেই হবে। কঙ্কালের জন্মের সিদ্ধান্ত এরপরেই। কথায় কথায় জয় কবুল করেছেন, প্রথম পর্বের কবিতাগুলি থেকে কয়েকটি বাদ দেওয়া হয়েছে। শোনার পর থেকেই আমার খচ্চর মন জানতে চাইছে বাদ দেওয়ার হেতু কি তিস্তা শেতলাবাদ হয়ে যাওয়ার ভয় না অন্য কিছু? কষ্ট করে রাত জেগে লিখলেনই যখন ওই কবিতাগুলিও সংকলনে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল নাকি? অবশ্য সেটা একান্ত ভাবেই কবির অধিকার, আমার ফুট কাটা উচিত নয়।

বইটি তো প্রকাশ পেল, কবির বুক কি দুরু দুরু করেই চলেছে? নইলে তিনি লিখলেন কেন, ‘এ বার হয়তো আমার সামনেও খাড়া করা হবে আমার অজানা কোনও অপরাধ। সাক্ষী ও প্রমাণও দাঁড়িয়ে যাবে সামনে, দেখা যাক।’ যে নৃশংসতা দেখে জয়ের মনে হয়েছে তাঁর নিজস্ব অপমান একেবারেই তুচ্ছ ঘটনা, যিনি ‘কবির দায়’ পালন করতে তালপাতার সেপাই হয়েও ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, তিনি নিজের হাতে সাহসের পাত্রে এমন দু’ফোঁটা গো-চোনা ফেলবেন কেন?

আমার মনে হয় না ‘কঙ্কাল’ কবির নিগ্রহের কারণ হবে, কবিতা হিসেবে অত্যন্ত উঁচু মানের হলেও, রাষ্ট্রের নিপীড়ন যন্ত্র এক বাঙালি কবির দায় নিয়ে মাথাব্যথা করবে বলে মনে হয় না। তবে তেমন কালো রাত সত্যিই এলে জয়ের পাশে পিদিম জ্বালিয়ে আমি হয়তো থাকব কিন্তু যাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কথা তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু কবির বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যাবেন। ঘর পোড়া গোরু আমি, সাহসের মূল্য কী ভাবে চোকাতে হয় তা বিলক্ষণ জানি। তখন সেই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা তিস্তা শেতলাবাদের গ্রেপ্তারের মতো কবি হৃদয়কে কতটা ক্ষতবিক্ষত করে, রাত জেগে তিনি নিজের ভ্রান্তি-বিলাস নিয়ে ক’টা কবিতা লেখেন সেটাই দেখার।

প্রশ্ন আছে আরও, একটু বেশি স্পর্শকাতর, একটু নির্দয়। ’সংবাদ আসলে কাব্য’ ধরে নিয়ে এই পুস্তিকায় জয় গুজরাত দাঙ্গার অনেক খবরের অংশ বিশেষ তুলে ধরেছেন। আমিও তেমনি পেপার কাটিং দেখিয়ে কবিকে মনে করিয়ে দিতে পারি গুজরাতে ২০০২-এর বিধানসভা ভোটের পরে কারা কারা লাল গোলাপের তোড়া পাঠিয়ে আজকের ‘দিল্লির অধীশ্বরকে’ অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। বিশ্বাস হয় না জয় তাঁদের নাম বিস্মৃত হয়েছেন। আমার জানতে ইচ্ছে হয় ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’ তাদের বিচার আলাদা আলাদা মানদণ্ডে করা কি লজ্জার দ্বিচারিতা নয়? জয় গোস্বামী আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবি সন্দেহ নেই, কিন্তু যে কবির কবিতা পড়ে সমাজ উত্তেজিত হয়, যুব সমাজ নেমে যায় রাজপথে, জয়কে সেই আসনে আর বসানো যাচ্ছে না, অনেকদিন হল। হয়তো আমার কথাটা কিঞ্চিৎ রূঢ় শোনাবে, তবু সত্যটা হল, একজন শঙ্খ ঘোষের সম্মান তাঁর প্রাপ্য নয়। কেন না তিনি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের শরিক-সমর্থক এবং দাক্ষিণ্যভোগী।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article