27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

জোট-ঘোঁট-ভোট (৩)

Must read

জোট-ঘোঁট-ভোট (৩)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

অফিসে ফেরা মাত্র গুণধরদা প্রায় দৌড়ে এলেন আমার কাছে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘এক্ষুনি বাবুর ঘরে যান, আমাকে বলা হয়েছে আপনি অফিসে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে যেন আপনাকে কথাটা জানিয়ে দিই।

অফিসের জাতিপ্রথায় গুণধরদা ছিলেন সবার নীচে, মানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অসম্ভব ভদ্র, বিনয়ী, নিচু লয়ে কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সন্তোষ কুমার ঘোষের খাস পরিচারক, সেই সুবাদে আমার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সম্পাদক কেন এত অধৈর্য হয়ে উঠেছেন, গুণধরদা তার কোনও ইঙ্গিত দেননি, তবু তাঁর ফিসফিসানির ধরনে আমি অশনি সঙ্কেত দেখতে পেলাম।

নিশ্চয়ই কেস খেয়েছি, এ বার ঝাড় খেতে হবে!

দরজা ঠেলে চাঁদবদনটি সবে ভিতরে গলিয়েছি, দেখতে পেয়েই অভীকবাবু খেপচুরিয়াস। ‘কী সব উল্টোপাল্টা লিখেছ জ্যোতিবাবুকে নিয়ে? উনি নিজে ফোন করে আমার কাছে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কী দরকার এসব পাকামি করার?’

সমুদ্র-স্নান করার একটা চালু কৌশল হল হঠাৎ সামনে বড় ঢেউ এসে পড়লে মাথাটা নিচু করে তাকে ওপর দিয়ে চলে যেতে দেওয়া। অভীক সরকার কোনও কারণে রেগে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলে আমিও এই কৌশলই অবলম্বন করতাম। যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানি না এমন মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ওঁর কথার মধ্যে একটি কথাও বলতাম না। অভিজ্ঞতা আমাকে এইটুকু শিখিয়েছিল, সম্পাদক-মশায়ের রাগ খুবই ক্ষণস্থায়ী, বিনা বাধায় ঝাড়ের পর্বটি শেষ হলেই তিনি আবার নিজে থেকেই ঠান্ডা হয়ে যাবেন, কপাল ভালো থাকলে এক কাপ কফিও খাইয়ে দিতে পারেন। জামাইকার ‘ব্লু মাউন্টেইন’ কফি, পেয়ালা টেবিলে আসা মাত্র যার সুরভি ঘর-ময় ছড়িয়ে পড়ে চোখের নিমেষে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সফরসঙ্গী হয়ে আমি একবার জামাইকা গিয়েছিলাম, সঙ্গে করে দু’প্যাকেট ব্লু-মাউন্টেইন কফি নিয়ে এসেছিলাম বসের জন্য।

সেদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না, ঝাড়ের পরে তাই আর খাতির পাইনি। সম্পাদকের ঘর থেকে বেরোনোর পরে মনে কয়েকটি প্রশ্ন তোলপাড় হচ্ছিল। কী এমন লিখেছি যে জ্যোতিবাবু সোজা অভীকবাবুকে ফোন করে বসলেন? এতটাই স্বভাব-বিরোধী ছিল তাঁর এই কাজ।

আমাদের মতো ‘দু’পয়সার রিপোর্টারদের’ (স্বত্ব মহুয়া মৈত্রর) জ্যোতিবাবু পোকা-মাকড়ের চেয়ে বেশি কিছু মনে করতেন না। খুব বড় কোনও ঘোষণা থাকলে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে তিনি সাংবাদিকদের ডেকে নিতেন, কাজটা সাঙ্গ করতেন অতি দ্রুত, মনে হত যেন ঘোর অনিচ্ছায় তিনি নিজের ঘর কলুষিত হতে দিচ্ছেন। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে সবাই নুইয়ে থাকত, সাহস করে কেউ ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্ন করে বসলেই তিনি ফোঁস করে উঠে এমন কোনও মন্তব্য করে বসতেন যেটা তারপর কয়েকদিন কাগজের শিরোনামে স্থান পেত। যেমন বানতলায় ধর্ষণ-কাণ্ডের পরে তিনি অক্লেশে, ভাবলেশহীন ভাবে মন্তব্য করে বসেছিলেন, ‘এমন ঘটনা তো কতই হয়।’

এত কথা বলার কারণ একটাই। ভিন্ন জাত আর গোত্রের রাজনীতিক জ্যোতি বসু মিডিয়াকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত এক ছটাকও বেশি গুরুত্ব দিতেন না।

মিডিয়া-নির্ভর রাজনীতি করা তো দূরস্থান, মিডিয়াই ভয়ে অথবা ভক্তিতে তাঁর সামনে নতজানু হয়ে থাকত। বামফ্রন্ট সরকারের কাজকর্মের বিরোধিতা করার জন্য তিনি প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে চারটি সংবাদপত্রকে গাল দিতেন তাদের নাম না করেই। তাঁর সম্পর্কে কোন কাগজে কে কী লিখল তিনি তার পরোয়া করতেন না, অন্যায় সমালোচনা বা মিডিয়ার মিথ্যাচার সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করতেন। আনন্দবাজার ছেড়ে বরুণ সেনগুপ্ত নিজের কাগজ বর্তমান বের করার পরে জ্যোতি বসুই ছিল তাঁর আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য, সেটাই ছিল নতুন কাগজটির ইউনিক সেলিং পয়েন্ট, প্রাথমিক জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ। বর্তমানে জ্যোতিবাবু সম্পর্কে এমন অনেক খবর প্রকাশ পেত যা সর্বৈব মিথ্যে অথবা তথ্য-বিকৃতি। জ্যোতিবাবুকে কোনও দিন এর প্রতিক্রিয়া জানাতে শুনিনি, মানহানির মামলা নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া তো কল্পনাতীত। বৌবাজার বিস্ফোরণের কিছুদিন পরে আনন্দবাজারেও একটি আঠারো আনা মিথ্যা সংবাদ প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল। বিস্ফোরণের মূল পান্ডা, কুখ্যাত দুষ্কৃতী রশিদ খানের টাকায় জ্যোতিবাবু নাকি একবার বিদেশে গিয়েছিলেন। এখন এত বছর পরে ঠিক মনে নেই, এই খবরের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী তখন মানহানির মামলা করেছিলেন কি না। সার কথাটা হল, নিজের চারপাশে লোহার পর্দা ঝুলিয়ে জ্যোতিবাবু থাকতেন, তাকে ভেদ করা একেবারেই সহজসাধ্য ছিল না, হাতে গোনা কয়েকজন রিপোর্টারকে তিনি মানুষ বলে মনে করতেন, বাকিদের নিয়ে সামান্যতম মাথাব্যথাও ছিল না।

এহেন একজন মানুষ আমার মতো এক অপরিচিত জুনিয়র রিপোর্টারের প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা পড়ে এতটাই ক্রুদ্ধ হলেন যে একেবারে সোজা নালিশ ঠুকে দিলেন মালিকের কাছে? মনটা ভারাক্রান্ত হল যদিও রিপোর্টের লেখক হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারলাম, মুখ্যমন্ত্রীর ঘা-টা লেগেছে কোথায়।

১৯৮৭-র বিধানসভা ভোটে আমাকে দেওয়া হয়েছিল জ্যোতি বসুর নিজের কেন্দ্র সাতগাছিয়া কভার করার দায়িত্ব। আমি ঢুকেই দেখলাম, গোটা বিশেক এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে রাস্তার দু’পাড়ে দাঁড়িয়ে। আদুল গা, খালি পা, নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় একটা পাটকাঠি, তার ডগায় কাগজের ছোট্টা তেরঙা পতাকা। নামতা পড়ার ছন্দে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে তারা ছড়া কাটছে— জ্যোতি বাবু নমস্কার/ পাঁচ বছরে একবার। বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে বেদম ফূর্তিতে। স্থানীয় লোকজন জানাল যে কোনও মুহূর্তে জ্যোতিবাবুর কনভয় ওই রাস্তা দিয়ে সাতগাছিয়ায় ঢুকবে, তাঁকে এ ভাবেই অভ্যর্থনা জানাবে এই বাচ্চাগুলো। বুঝতে পারলাম এমন একটি দুষ্টু অভিসন্ধির পিছনে পাকা মাথা আছে, বাচ্চাগুলোকে নিশ্চয়ই কিছু দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে, ছড়া মুখস্থ করিয়ে এ ভাবে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার বেশ মজা লাগছিল তাই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ও পথ দিয়ে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সারাটা দিন সাতগাছিয়ায় চক্কর কেটে অফিসে ফিরে লিখতে বসে মনে হল রিপোর্টের শুরুটা ওই ছড়া দিয়েই করি – জ্যোতিবাবু নমস্কার, পাঁচ বছরে একবার। তার পরিণতি যে এতটা বিয়োগান্তক হতে পারে আমার দূরতম কল্পনার মধ্যেও ছিল না।

আক্ষরিক অর্থে অনুযোগটি ভ্রান্ত ছিল না, আর পাঁচজন রাজনীতিক যে ভাবে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, যাকে বলা হয় কনস্টিটিউয়েন্সি নার্স করা, জ্যোতিবাবুর অবস্থান ছিল ঠিক তার বিপ্রতীপে। তিনি সাতগাছিয়ায় যেতেন কচ্চিৎ-কদাচিৎ, প্রায় না যাওয়ারই মতো। তিনি ভোটে জিতবেন, তারপর পাঁচ বছর পার্টির স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রের দেখভাল করবেন, এটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। ১৯৮৭-র ভোটে কংগ্রেস সাতগাছিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিটাকেই ভোটের ইস্যু করে তুলেছিল হঠাৎ। যেখানেই গিয়েছি সাধারণ ভোটারদের একাংশ বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কেবল দু’বার সাতগাছিয়ায় আসেন, ভোটের আগে প্রচারে আর ভোটের পরে জেতার সার্টিফিকেট নিতে।

আক্ষরিক অর্থে অনুযোগটি ভ্রান্ত ছিল না, আর পাঁচজন রাজনীতিক যে ভাবে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, যাকে বলা হয় কনস্টিটিউয়েন্সি নার্স করা, জ্যোতিবাবুর অবস্থান ছিল ঠিক তার বিপ্রতীপে। তিনি সাতগাছিয়ায় যেতেন কচ্চিৎ-কদাচিৎ, প্রায় না যাওয়ারই মতো। তিনি ভোটে জিতবেন, তারপর পাঁচ বছর পার্টির স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রের দেখভাল করবেন, এটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। ১৯৮৭-র ভোটে কংগ্রেস সাতগাছিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিটাকেই ভোটের ইস্যু করে তুলেছিল হঠাৎ। যেখানেই গিয়েছি সাধারণ ভোটারদের একাংশ বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কেবল দু’বার সাতগাছিয়ায় আসেন, ভোটের আগে প্রচারে আর ভোটের পরে জেতার সার্টিফিকেট নিতে।

আমার স্থির বিশ্বাস ১৯৮৭ না হয়ে ভোটটা যদি ১৯৯১-এর হত আমার রিপোর্টকেও জ্যোতিবাবু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতেন। কিন্তু ৮৭-র ভোটের আগে রাজ্য-রাজনীতিতে একটা অবিশ্বাস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, হাওয়া উঠেছিল বামদুর্গের পতন হলেও হতে পারে। স্বভাবতই সরকারের কাণ্ডারি জ্যোতিবাবুও প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁর স্নায়ুর ওপরেও বাড়তি চাপ পড়েছিল। এমন একটি উত্তেজক পরিস্থিতিতে আমার রিপোর্ট ছিল উত্তেজনার বারুদে জ্বলন্ত সলতে। জ্যোতি বসুর স্বভাব-বিরোধী ক্ষোভ উদ্গীরণ সেই কারণেই।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article