শ্রাদ্ধবাসরে খ্যামটা নাচ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ডাক্তার কুণাল সরকার বঙ্গসমাজে একটি অতি সুপরিচিত নাম। সুদক্ষ হার্ট সার্জন, বাংলা-ইংরেজি দু’টি ভাষাতেই সমান সাবলীল, স্বচ্ছন্দ, প্রথম সারির তার্কিক। সঠিক সময়ে উচিত কথাটি প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে বলতে কুনাল কদাচ পিছপা হন না, ভদ্রলোক নামক ভীতু সম্প্রদায়ের মধ্যে এক উজ্জ্বল, ব্যতিক্রমী, সাহসী ব্যক্তিত্ব। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর থেকেই কুণাল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সামাজিক মাধ্যমে একের পর এক সাক্ষাৎকারে অকুতোভয়ে বোমার পর বোমা ফাটিয়ে চলেছেন।
কুণাল আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, ভ্রাতৃসম, এ শহরে অসংখ্য বিতর্কসভায় আমরা একসঙ্গে তর্কযুদ্ধ করেছি। মোদ্দা কথায় কখনও যদি কুণালের কোনও ফ্যান-ক্লাব গড়ে ওঠে আমি তার উৎসাহী সদস্য হবই। কোভিডের বীভৎসা নিয়ে কুণাল বিস্ফোরক কথা বলেছেন অনেক, আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে আইপিএল সংক্রান্ত মন্তব্যটি।
কুণালের কথায়, ‘এ যেন শ্রাদ্ধবাড়িতে নাচের আসর।’
আমি হলে হয়তো নাচের আসরের আগে একটি শব্দ জুড়ে দিতাম। খ্যামটা।
এ যেন অনেকটা তৃণমূল কংগ্রেসের এ বারের নির্বাচনী স্লোগান, ‘খেলা হবে’। হাজারে হাজারে মানুষ মরছে মরুক, ‘খেলা হবে’। অক্সিজেনের আকাল দেখে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় তবু ‘খেলা হবে’। হাসপাতালে বেড নেই, হাঁসফাঁস করা রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে চক্কর কাটছে শহরে শহরে, রোগীর পরিজনদের অসহায়, আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস তবু ‘খেলা হবে’। শ্মশানে-শ্মশানে জমছে সেলোফিনে মোড়া লাশের স্তূপ, হচ্ছে গণ-সৎকার, কবর দেওয়ার স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না বলে গির্জা থেকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে শবদেহ দাহ করার, তবু, ‘খেলা হবে’। গোটা দুনিয়া থেকে ভারত আজ বিচ্ছিন্ন, অনেক দেশ বিমান সংযোগ ছিন্ন করে দিয়েছে, কৃপাপ্রার্থী হয়ে ভিন দেশের দুয়ারে দুয়ারে কড়া নাড়তে হচ্ছে আমাদের, তবু, ‘খেলা হবে।’ অতিমারিতে দেশটা উজার হয়ে গেলে হোক, ’খেলা হবেই’।
কালো মেঘের ভ্রূকুটি, চিতা থেকে বাতাসে ভেসে আসা পোড়া দেহের গন্ধ, নেটিজেনদের সোচ্চার বিরূপ সমালোচনা, সব কিছুকে উপেক্ষা করে এই যে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ধনুর্ভঙ্গ পণ, তার চরিত্রটি ঠিক কী রকম? মাঠে খেলা অথচ গ্যালারি ধূ ধূ প্রান্তর, কায়দা করে যার নাম দেওয়া হয়েছে বায়ো-বাবল। মানে এমন ভাবে নিরাপত্তার একটি আচ্ছাদন তৈরি করা যা ভেদ করে প্রাণঘাতী ভাইরাস খেলার সঙ্গে যুক্ত কাউকে স্পর্শ করতে পারবে না। না মাঠে, না বাসে, না হোটেলে। তার মানে খেলছে যারা তারাও আসলে বন্দি-জীবনযাপন করতেই বাধ্য হচ্ছে। বুদ্বুদের বাইরে পা রাখার উপায় নেই, কেউ রেখে ফেললে আবার তাকে আইসোলেশনে থেকে কোভিডের পরীক্ষা করিয়ে ফিরতে হবে। এমন একটা জীবনও আদৌ প্রত্যাশিত নয়, অনেক প্লেয়ারই বায়ো-বাবলের মধ্যে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠছেন, যার কেতাবী নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাবল ফ্যাটিগ’। গতকালই পড়লাম ইংল্যান্ডের এক ক্রিকেটার বলেছেন, ভারত সফরে গিয়ে বায়ো-বাবলের মধ্যে থাকতে থাকতে তাঁর ক্রিকেট সম্পর্কেই ভক্তি-শ্রদ্ধা সব উবে গিয়েছিল।
দেশ-জোড়া বিপর্যয়ের মধ্যে, দর্শকহীন মাঠে বায়ো-বাবলে বন্দি খেলোয়াড়দের নামিয়ে দেওয়ার এমন পৈশাচিক আয়োজনের তাহলে কী দরকার ছিল? গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি না দেওয়ায় এই খ্যামটা নাচের আসর সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সংযুক্ত আমিরশাহিতে। অথচ এ বার পরিস্থিতি যখন গত বছরের তুলনায় দশ-গুণ খারাপ তখন দেশের ভিতরে এই টুর্নামেন্ট করার ছাড়পত্র দেওয়া হল কেন? ভুল সংশোধন করতে এখনই বা এটা বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে না কেন? অতিমারির কারণে ইউরোপে চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো ভুবনখ্যাত টুর্নামেন্ট যদি বন্ধ হতে পারে তাহলে মানুষের মরদেহের ওপরে এই ভূতের কেত্তন চলতে দেওয়া হচ্ছে কেন?
উত্তরটি অতীব সংক্ষিপ্ত। টাকা। টাকা, টাকা, টাকা। আই পি এলের বিনোদন-রস আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে বলতে পারব না, টুর্নামেন্টের বৈভব যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, বিসিসিআই-য়ের কোষাগার তাল মিলিয়ে স্ফীতকায় হচ্ছে, আমরা সবাই জানি। জানি, আইপিএল মানে সংশ্লিষ্ট সক্কলের মাল কামানো, প্লেয়ার, ফ্র্যানচাইজি, বিসিসিআই, ব্রডকাস্টার সবার। এমন অনর্থকারী অর্থ-লালসাই চোখে ফেট্টি পরিয়ে দেয়, চারপাশের পৃথিবী, তার হাহাকার, অবর্ণনীয় দুর্দশা, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মিছিল, সব কিছু গৌণ হয়ে গিয়ে কেবল একটি শব্দ-বন্ধই বেঁচে থাকে। ‘খেলা হবে’।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? আছে। টেলিভিশনে আইপিএল দেখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। আমি যেমন এ যাবৎ এই খ্যামটা নাচের একটি পর্বও দেখিনি, আপনাদের অনুরোধ দেখবেন না। সাচ্চা দেশভক্তির প্রমাণ দেওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে সামনে, হেলাফেলা করবেন না। অগণিত দুর্গত ভারতবাসীকে সম্মান জানানোর এটাই সুযোগ।