বরকতের ছিল বাদশাহি মেজাজ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। এ বার আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরী। তৃতীয় পর্ব)
অফিসে পা দিতে না দিতেই এক সহকর্মী বললেন, ‘সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে৷ আমাদের মালদার প্রতিনিধি সোমনাথ চক্রবর্তীকে বরকত সাহেবের লোকজন রিভলভার দেখিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কোনও একটা জায়গায় বন্দি করে রেখে দিয়েছে৷ আমার মনে হয়, এক্ষুনি একবার পুলিশকে খবর দেওয়া প্রয়োজন৷’
সোমনাথের অপরাধ, তার আগের দিন জেলার দলীয় কর্মীদের সভায় বরকত সাহেব যে বিস্ফোরক ভাষণটি দিয়েছিলেন সে তার হুবহু রিপোর্ট কলকাতায় পাঠিয়েছিল৷ পরের দিন কাগজে প্রথম পাতায় সেটা শিরোনাম হয়েছিল৷ সেই উত্তেজিত ভাষণে গৌড়াধিপতি আর রাজীব গান্ধী সম্পর্কে তাঁর জমা ক্ষোভ গোপন রাখতে পারেননি৷ পায়ের জুতো দিয়ে সিমেন্টের মঞ্চে দমাদ্দম আওয়াজ করতে করতে গর্জন করে উঠেছিলেন, ‘রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিত্বে আমি এ ভাবে লাথি মারি, লাথি মারি আর লাথি মারি৷’
বিরুদ্ধ প্রচার সম্পর্কে গনি খান চৌধুরী বিশেষ স্পর্শকাতর ছিলেন, জানতাম৷ কিন্তু তাঁর ক্রোধ যে এই রকম অবিশ্বাস্য বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছতে পারে, এই ঘটনাটির আগে আমার অন্তত সে সম্পর্কে কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না৷
বন্ধ ঘরে বরকত সাহেবের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সোমনাথকে শাসিয়েছিল, ‘তুই এক্ষুনি কলকাতায় ফোন করে জানিয়ে দে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বরকতদা একটি কথাও বলেননি৷ অন্যথায় মহানন্দার জলে তোর লাশ ভাসতে দেখা যাবে৷’
জল অবশ্য তারপরে আর বেশি দূর গড়ায়নি৷ বরকত ঘনিষ্ঠ আর এক প্রবীণ সহকর্মীর মধ্যস্থতায় বরকত সাহেবকে শান্ত করা গিয়েছিল, সোমনাথও কাঁপতে কাঁপতে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ পরেই৷ বিকেলে আমি যখন কোতুয়ালিতে বরকত সাহেবকে টেলিফোনে ধরি ততক্ষণে তিনি ভিজে জল৷ ‘আরে ছাড়েন না, যা হবার হয়ে গিয়েছে৷ আপনেরা তো আমার বন্ধু মানুষ…৷’
মেজাজি নেতা-নেত্রী দেখেছি অনেক৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা সংযম খোয়াচ্ছেন, এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেক৷ যেমন ইন্দিরা গান্ধী৷ কলকাতার নেতাজি ইনডোরে ১৯৮৩-র এআইসিসি অধিবেশনের শেষে ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছিলাম, সম্পূর্ষ নিরামিশ প্রশ্নের জবাবে সংযম খুইয়ে রিপোর্টারকে অকারণে ভ্যর্ৎসনা করতে।
রিপোর্টারটির প্রশ্ন ছিল, ‘ম্যাডাম, এআইসিসি-র নতুন সাধারণ সম্পাদক রাজীব গান্ধীর কাজকর্ম নিয়ে আপনার অভিমত কী?’
ইন্দিরা- আগে বলুন আপনি কোন কাগজ?
রিপোর্টার- ইন্ডিয়া টু ডে৷
ইন্দিরা- ইন্ডিয়া টু ডে? দ্যাট ইজ অ্যান অ্যান্টি ন্যাশনাল পেপার৷ আই ওন্ট আনসার ইওর কোয়েশ্চেন৷
প্রধানমন্ত্রীর এ মতো উদ্ধত জবাব শুনে কনফারেন্স হলে তখন শ্মশানের স্তব্ধতা, কিন্তু বিনীত ভাবে প্রতিবাদ জানাবেন সেই সাহসও কারও নেই৷ যাঁরা মনে করছেন, বিরোধী মত সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, বিরোধিতা করলেই তার গায়ে দেশ-বিরোধী তকমা লাগিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ভারতীয় রাজনীতিতে ইদানীং গেরুয়া শিবিরের লোকজন আমদানি করেছেন, এর আগে পরিস্থিতি আদৌ এত ভয়ানক ছিল না, তাঁরা ভুল করছেন৷ জরুরি অবস্থার বিশেষ স্বেচ্ছাচারের কথা বাদ দিয়েও নিশ্চিন্তে বলা যায়, এ ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাকিরা দুগ্ধপোষ্য শিশু৷
সাংবাদিক বৈঠকে সংযম খোয়ানোর বদভ্যাস ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়েরও৷ বিরুদ্ধ প্রশ্ন শুনলে তিনি ক্রুদ্ধ হতেন এমনটা নয়, তাঁকে সহসা উত্তেজিত করে তুলত বোকা বোকা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন৷ রেগে গেলে চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠত তাঁর, রিপোর্টারকে এমন ভাবে মুখ-ঝামটা দিতেন যে বেচারা মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজে পেত না৷
বেশ কয়েকবার তাঁর এমন অগ্নিশর্মা চেহারাটি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার পরে একান্ত আলোচনায় প্রণববাবুকে বলেই ফেলেছিলাম, ‘আপনি এত বড় মাপের একজন নেতা৷ সামান্য প্রশ্ন শুনে এ ভাবে মেজাজ হারান কেন? এই জন্যই তো মিডিয়ায় আপনার শুভার্থী এত কম৷’
প্রশ্নটিকে প্রণববাবু একেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দেননি৷ হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিলেন, ‘কথাটা তুই যে খুব একটা ভুল বলছিস তা নয়৷ কিন্তু কী করি বল, কেউ ছুঁচোর মতো প্রশ্ন করলে আমার আর মাথার ঠিক থাকে না৷’
ছুঁচো মানে?
অশিক্ষিত৷ আরে বাবা, একটা প্রশ্ন করার আগে তো ভালো করে বিষয়টা জেনে-বুঝে আসতে হবে৷ পড়াশুনো করতে হবে৷ সে সব কিছুই করবে না, দুমদাম প্রশ্ন করে বসবে৷
বলতে পারব না, মিডিয়ার একটা বড় অংশ সম্পর্কে প্রণববাবুর অনুযোগ অসঙ্গত ছিল৷ বরং যত দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে যেন ক’অক্ষর গোমাংসে ভরে যাচ্ছে আমাদের এই পেশাটি৷ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে৷ তবে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এ কথা বিলক্ষণ জানতাম প্রণববাবুর সবচেয়ে কড়া গালগালটা ছিল ‘ছুঁচো’৷ কারও সঙ্গে তিনি যখন এই বিরক্তিকর প্রাণীটির তুলনা টানতেন, বুঝতে পারতাম তিনি রয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অপছন্দের তালিকার শীর্ষস্থানে৷
মেজাজে ষোলো আনা জমিদার আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরীর অনুরাগ এবং বীতরাগ দু’টোই বাঁধা থাকত প্রচণ্ড চড়া সুরে৷ যাঁদের তিনি ভালোবাসতেন অথবা পছন্দ করতেন তাঁদের জন্য ন্যায়-অন্যায় যে কোনও কাজ করতে পিছপা হতেন না৷ কংগ্রেসের কত ছোট-বড় নেতা যে বরকত সাহেবের এমন উজাড় করা স্নেহ আর ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই৷ কিন্তু একবার রেগে গেলে? যার ওপর ক্রুদ্ধ হচ্ছেন তার কথা বাদই দেওয়া যাক, অকুস্থলে উপস্থিত সকলেরই তখন মনে হত একটাই কথা৷ ‘ধরণী (সত্যজিৎ রায় ধরণী নয় অবশ্যই) দ্বিধা হও৷’
একটা ‘আঁখো দেখা’ ঘটনা স্মরণ করি৷ গ্রীষ্মের দুপুরে বরকত সাহেবের আকবর রোডের বাংলোর অফিস ঘরে ঢুকতেই শুনি সাহেব তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘ওরে অতুল, লোকটাকে দুই লাথ মেরে বের করে দিচ্ছিস না কেন? কী রে অতুল, তুই গেলি কোথায়?’
ঘরে ঢোকার আগে বাইরে দেখে এসেছি মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ বুঝতে পারি, তাঁকেই বের করে দেওয়ার কথা বলছেন বরকত সাহেব৷ কিন্তু কেন? অচিরেই বোঝা গেল, কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিয়ে তিনি এসেছেন এবং এমনি আস্পর্ধা যে দরজা ঠেলে সাহেবের ঘরে ঢুকে তাঁর দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। অতএব তাঁকে শুধু যে অর্ধচন্দ্র দিতে হবে তা নয়, তাঁর পশ্চাদ্দেশে অতুলকে সজোরে দু’টি লাথিও মারতে হবে৷ সে কাজটি অবশ্যই করেনি অতুল৷ তবে পরে একদিন ফিসফিস করে আমাকে বলেছিল, ‘সাহেবকে নিয়ে সত্যিই পারা যায় না! কখন যে কার ওপর খচে যাবেন, ভগবানও জানেন না৷’
মন্ত্রী ছিলেন যতদিন আমলাদের মুখে ‘না’ শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না বরকত সাহেব৷ চাকরি বাঁচাতে আমলারা সরকারি নিয়ম-কানুনের প্রশ্ন তুললেই তাঁদের গালমন্দ শুনতে হত৷ একবার আসামে সফর করার সময় গাড়িতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব, যিনি পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারেরই আই এ এস অফিসার৷ বাংলার কোনও একটি প্রকল্প নিয়ে কথাবার্তা বলার সময় দোষের মধ্যে সচিব মশাই মন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কেন তাঁর প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়৷ ক্রুদ্ধ বরকত সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দেন৷ তারপর ব্যক্তিগত সচিবকে বলেন, ‘এক্ষুনি গাড়ি থেকে নেমে যান৷ দেরি করলে আমিই আপনাকে লাথ মেরে ফেলে দেব৷’ হাতে-পায়ে ধরে সে যাত্রায় নিরস্ত করা হয়েছিল বরকত সাহেবকে৷
তবে সবচেয়ে মজার ঘটনাটি ঘটেছিল এ রাজ্যে এসে রাজীব গান্ধী বিশেষ ট্রেনে করে বঙ্গ-দর্শন করার সময়৷ বরকত সাহেব তখন রেল মন্ত্রী, রাজীব এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক৷ সফর শুরু হওয়ার আগের দিন সঙ্গী রিপোর্টাররা দল বেঁধে বরকত সাহেবকে জানাল, ট্রেন থেকে কপি পাঠানো সম্ভব নয়, আজকের খবর কালকে লিখলে সেটা বাসি হয়ে যাবে৷ অতঅব মন্ত্রী যদি ট্রেনের কামরাতেই টেলিফোনের বন্দোবস্ত করতে পারেন খুব ভালো হয়৷ মোবইল টেলিফোনের যুগ তখন দূর-অস্ত!
প্রস্তাবটি শুনেই বরকত সাহেব ডেকে পাঠালেন রেলের সংশ্লিষ্ট অফিসারকে৷ ‘শুনুন রাজীব গান্ধীর ট্রেনে রিপোর্টারদের জন্য ফোনের ব্যবস্থা করতে হবে৷’
‘এত অল্প সময়ের মধ্যে স্যার কী করে সেটা সম্ভব হবে?’ কাঁচুমাচু মুখে উত্তর অফিসারের৷
বরকত- ‘ও সম্ভব হবে না বলছেন? তাহলে এক কাজ করুন৷ একটা সাদা কাগজে আপনি নিজের ইস্তফাটা লিখে দিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যান৷ আপনাদের মতো ওয়ার্থলেস অফিসারের কোনও প্রয়োজন নেই আমার৷’
পরের দিন ট্রেনে উঠে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় রিপোর্টারদের৷ তাঁরা দেখেন, যে স্টেশনে ট্রেন থামছে সেখানেই দলে দলে রেল কর্মচারী ঝালমুড়ির টিনের মতো গলায় টেলিফোন ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ট্রেনে উঠে রিপোর্টারদের তাঁরা সাধাসাধি করছেন যাঁর যে রকম খুশি টেলিফোন ব্যবহার করার জন্য৷ ট্রেন থেকে লাইন প্রথমে যাবে রেলের এক্সচেঞ্জে, সেখান থেকে জুড়ে দেওয়া হবে বিবিধ কাগজের অফিসের লাইন৷ শুনেছি, স্টেশনে স্টেশনে টেলিফোন গলায় রেল কর্মচারীদের এমন বিচিত্র তৎপরতা দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন খোদ রাজীব গান্ধীও৷ কেবল বরকত সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছিল, এ অতি স্বাভাবিক ঘটনা৷ তিনি যখন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তখন অসম্ভবও অনায়াসে সম্ভব তো হবেই৷
এই ছিল যাঁর প্রতাপ আর হাঁকডাক, রাজীব গান্ধী হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর অবস্থাটা রাতারাতি কতটা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল, সহজেই অনুমেয়৷ তবু আশ্চর্য হয়ে দেখতাম গান্ধী পরিবার সম্পর্কে পারতপক্ষে তিনি ব্যক্তিগত আলোচনাতেও কটূ কথা বলতেন না, হঠাৎ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার মর্ম বেদনা অব্যক্ত শোকের মতো নিজের কাছেই রেখে দিতেন৷ তাঁর সঙ্গে আড্ডায় ফিরে ফিরে আসত ইন্দিরা ও তাঁর পুত্র সঞ্জয়ের প্রসঙ্গ৷ দু’জনের সম্পর্কেই তাঁর অপরিমিত শ্রদ্ধা আমাকে বিস্মিতও করত অনেক সময়৷ দু’একবার অস্ফুট ভাবে এঁদের সম্পর্কে আমি যে বিরূপ মন্তব্য করার চেষ্টা করিনি তা নয়, কিন্তু লক্ষ করে দেখতাম নেহরু পরিবারের সমালোচনায় তিনি কর্ণপাতও করতেন না৷ তাঁর কাছে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেত্রী আর তাঁর পুত্র প্রভূত সম্ভাবনাময় যুবক৷ রাজীব গান্ধীর প্রসঙ্গ তুললেই তিনি এড়িয়ে যেতেন সন্তর্পণে। সেই থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি আর দিল্লিতে তাঁর হৃত-গৌরব ফিরে পাননি৷ নরসিংহ রাও কিংবা মনমোহন সিংহ কেউই তাঁদের মন্ত্রিসভায় বরকত সাহেবকে জায়গা দেওয়ার কথা ভাবেনওনি৷ তবু কংগ্রেসটা শেষ পর্যন্ত ছাড়তে পারেননি বরকত সাহেব, ক্রুদ্ধ হয়েছেন, অনেক সময় বিক্ষুব্ধ শিবিরে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত হয়েছেন, তবু শেষমেশ থেকে গিয়েছেন নিজের দলেই৷ আনুগত্যের পরীক্ষায় এ ভাবেই তিনি তাঁর মতো করে হারিয়ে দিয়েছিলেন প্রায় সকলকেই৷ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, প্রণব মুখোপাধ্যায়, অশোক সেন সব্বাইকে৷
রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো তাঁকে যে দপ্তর দেওয়া হয়েছিল তাতে কার্যত কোনও কাজ ছিল না৷ তবু একটা মন্ত্রক তো ছিল৷ ১৯৮৭-র মে মাস নাগাদ সেটাও তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে৷ সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মুম্বাইয়ের এক ব্যবসায়ীকে তিনি অন্যায্য সুবিধে পাইয়ে দিয়েছেন৷ সেই রিপোর্ট নিয়ে হই-চই শুরু হওয়ার পরে বরকত সাহেবের মনে হয়েছিল আলঙ্কারিক মন্ত্রিত্বটা রক্ষা করার কোনও মানে হয় না৷ রাজীব গান্ধীর হাতে ইস্তফাপত্রটি সঁপে দিয়ে বিকেলের বিমানেই তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়৷ সেখান থেকে নিজের মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়িতে চড়ে সোজা মালদায় নিজের ডেরায়৷ তার পরেই কংগ্রেস কর্মীদের সভায় দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ উজার করে দিতে গিয়ে রাজীবের মন্ত্রিত্বে লাথি মারার কথা বলেছিলেন বরকত সাহেব৷ সোজা হয়ে চলতে ফিরতে তাঁর বিলক্ষণ অসুবিধে হত৷ তবু কেন জানি না লাথি মারাটাকেই তিনি বিরক্তি প্রকাশের একমাত্র অস্ত্র বলে মনে করতেন৷
বরকত সাহেব দাবি করেছিলেন, তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন স্বেচ্ছায়৷ এ কথা না বলে তাঁর উপায় ছিল না৷ কিন্তু ঘটনা হল তিনি শিকার হয়েছিলেন রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির৷ রাজীবের একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুচর মাখন লাল ফোতেদার পি এ সি-র রিপোর্ট নিয়ে হৈ হল্লা শুরু হওয়ার পরে বরকত সাহেবকে টেলিফোন করে বলেছিলেন হয় তাঁকে ইস্তফা দিতে হবে, নতুবা আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমন একটা বিবৃতি দিতে হবে যা সকলের কাছে একবাক্যে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে৷ কেন? না প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর মন্ত্রিসভার কোনও মন্ত্রীর দুনীর্তি নিয়ে বিতর্ক হোক তা একেবারেই আকাঙ্খিত নয়৷
বফর্স কেলেঙ্কারি তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে৷ সুইডিশ রেডিও দালালি দেওয়ার খবর প্রকাশ্যে আনার পরে জোর বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে রাজধানীর রাজনীতিতে৷ আক্ষরিক অর্থেই রাজীবের তখন আপনি বাঁচলে বাপের নাম অবস্থা৷ প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিজের ইস্তফা পত্রটি তুলে দিয়ে বরকত সাহেব আকবর রোডে নিজের বাংলোয় ফিরে আসার পরে আমি দু’চার মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে৷
‘কী দরকার ছিল মুম্বইয়ের ব্যবসায়ীকে বাড়তি খাতির করার? হাজার হোক, উনি তো আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নন৷’
বরকত- কেন দিয়েছিলাম জানেন? ওই ভদ্রলোক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক ছিলেন৷ ওঁর একটা সামান্য অনুরোধ রক্ষা করতে পারাটা আমার কাছে রীতিমতো গর্বের বিষয়৷
‘তার মানে আপনি এতটুকুও অনুতপ্ত নন?’
মনে হল প্রশ্নটি শুনে বরকত সাহেব হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন৷ ‘পারলে রাজীব গান্ধীকে বলে দেবেন, আবার যদি কোনওদিন মন্ত্রী হতে পারি, আবার একই কাজ করব৷’