আমি যা বলছি তাহাই সত্য
সুমন চট্টোপাধ্যায়
এক্কেবারে ছেলেবেলায় আমার এক বন্ধু খেলায় হেরে গেলেই চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দিত। ‘তুই চোট্টামি করে জিতেছিস, তোর সঙ্গে আর কোনও দিন আমি খেলবই না।’
বিদায়লগ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখে আমার বারবার সেই বন্ধুটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ আর ‘পপুলার ভোট’ দু’টোতেই ট্রাম্প সাহেব ভো-কাট্টা হয়ে গিয়েছেন, গোটা দুনিয়া সেই রায় মেনে নিয়ে হবু প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছে, একের পর এক মার্কিন আদালত তাকে মান্যতা দিয়েছে, ট্রাম্প তবু নিজের গোঁ থেকে নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু।
ট্রাম্প ভেঙেছেন কিন্তু মচকাননি। যে অপবাদ, অপমান, অবজ্ঞা, দ্বেষ ও শ্লেষের আবহে তাঁকে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে, অতীতে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের তেমন দুর্ভাগ্য হয়নি। মার্কিন ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট যাঁকে অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’দুবার ইমপিচ করা হয়েছে, এ বার বিচারে বসবে মার্কিন কংগ্রেসের সেনেট। সেখানে ট্রাম্পের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা কেননা ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় তাঁর প্রকাশ্য উস্কানির পরে তাঁর রিপাবলিকান সতীর্থদের মধ্যে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন এনাফ ইজ এনাফ। সেনেটের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প জীবনে আর প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে সামিল হতে পারবেন না। মার্কিন মিডিয়া ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে, হোয়াইট হাউসের বদলে অদূর ভবিষ্যতে গরাদের পিছনে থাকতে হতে পারে বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে। তেমনটা হলে সেটাও হবে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন রেকর্ড।
ভোটে হারার পরে ট্রাম্পের পায়ের তলার মাটি দৃশ্যতই একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল। ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পরে শুরু হয়েছে গোটা আমেরিকা জুড়ে ঘৃণার অগ্নুৎপাত। রাতারাতি একঘরে হয়ে পড়েছেন ট্রাম্প। সব ক’টি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তিনি নির্বাসিত, একের পর এক দলীয় সতীর্থ আর বন্ধু ধন-কুবের তাঁকে পরিত্যাগ করছেন। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর বিদায়ী ভাষণটিও রীতি মেনে প্রকাশ্যে দেওয়ার সাহস করেননি তিনি। ভাষণের ভিডিয়ো রেকর্ডিংটি তিনি চুপিসাড়ে ইউটিউব আর হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে আপলোড করে দিয়েছেন। প্রায় কোনও বড় নিউজ চ্যানেল সঙ্গে সঙ্গে সেটি সম্প্রচার করেনি, ওয়াশিংটন পোস্ট তো দেখলাম ২০ মিনিটের বিদায়ী ভাষণে ট্রাম্প কতগুলো মিথ্যা আস্ফালন করেছেন তার ফ্যাক্ট-চেক করা শুরু করে দিয়েছে। এমন অবর্ণনীয় নির্মম পরিণতির মধ্যে আর কোনও প্রেসিডেন্টকে বোধহয় হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিতে হয়নি।
বেহদ্দ বেহায়ার মতো ট্রাম্প তবু ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন, ‘আমি মোটেই হারিনি, আমাকে চোট্টামি করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বিদায়ী ভাষণে তাঁর উত্তরসূরির নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি ট্রাম্প, বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান বয়কট করার কথা তো আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। সাত জার্মান একলা জগাই তবুও জগাই লড়ে।
বোঝো ঠ্যালা। সত্যকে সহজ ভাবে মেনে নেওয়ার উপদেশ কবি দিয়ে গেলেও, তা কি পালন করা অত সহজ? এই পশ্চিমবঙ্গেও আমরা অতীতে অনেকবার ভোটের ফল প্রকাশ হওয়ার পরে হেরো-পার্টিকে চিল-চিৎকার করে কখনও ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ কখনও আবার ইভিএম মেশিন জালিয়াতির আজগুবি তত্ত্ব-কথা বলতে শুনিনি কি? ক্ষমতা হারানোর ব্যথা যে কতটা পীড়াদায়ক তা বোঝেন একমাত্র তাঁরাই যাঁরা ক্ষমতা ভোগ করেছেন। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
ভলতেয়ার বলেছিলেন, যাঁরা সত্যের অন্বেষণ করেন তাঁরা শ্রদ্ধেয়, কিন্তু যাঁরা সত্যকে আবিষ্কার করার দাবি করেন, তাঁদের সম্পর্কে সাবধান। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর মতো আরও অসংখ্য মানুষ রয়েছেন এই দ্বিতীয় দলে।
মনস্তত্ত্ববিদেরা সত্যকে স্বীকার করার অস্বীকৃতিকেই ‘ডিনায়েলিজম’ বলে থাকেন। এই ব্যাধি করোনা ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী হয়তো নয়। কিন্তু এর বিস্তার অতিমারীর মতোই আজ সর্বব্যাপী। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, অথবা বিশ্বাসকে ইতিহাস বলে দাবি করাটা এ যুগের অন্যতম চরিত্র লক্ষণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার যুগ-পুরুষ। প্রযুক্তির কল্যাণে ইন্টারনেটে আজ এত তথ্যের ছড়াছড়ি, একই বিষয়ে এত রকমের মতামত, থিসিস-কাউন্টার থিসিস, সব মিলিয়ে কোলাহল মুখর এই জঙ্গলে, কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, বুঝে নিতে বিভ্রম হয়, হওয়া স্বাভাবিক।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায়বেলার এমতো আচরণ আমাদের কাছে হাস্যকর, বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু এটা তাঁর ঘরানার সঙ্গে ষোলো আনা সঙ্গতিপূর্ণ, সত্যকে অস্বীকার করাটাকে তিনি তাঁর জমানার ‘সিগনেচর’ করে তুলেছিলেন, ‘ডিনায়েলিজম’কে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন রাজনীতির ব্রহ্মাস্ত্র করে তুলতে। অনেকাংশে তিনি সফলও হয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনেক আগে, ২০১২ সালে ট্রাম্প একটা টুইটে লিখেছিলেন, বিশ্বের উষ্ণায়নের তত্ত্ব আসলে চিনাদের মস্তিষ্ক প্রসূত, তাদের স্বার্থের জন্যই তৈরি করা, যাতে আমেরিকার ভারী শিল্প বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেকেই তখন এই বক্তব্যকে মার্কিন দক্ষিণপন্থী লবির পরিচিত আর্তনাদ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে জগৎ বুঝেছিল, এটা তাঁর কথার কথা নয়, উষ্ণায়নের অস্বীকৃতিকে তিনি তাঁর প্রশাসনের অন্যতম নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চান। শেষ পর্যন্ত প্যারিস প্রোটোকল থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়ে এসে ট্রাম্প একটি জ্বলন্ত, বৈজ্ঞানিক সত্যকে সদর্পে অস্বীকার করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। নতুন প্রেসিডেন্ট আমেরিকাকে আবার প্যারিস প্রোটোকলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন যদিও উষ্ণায়ন প্রতিহত করার লড়াইটা গত চার বছরে যে অনেকখানি দুর্বল হয়ে গেল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে উষ্ণায়নের বিতর্কটাকেও বেশ কিছুটা ঘোলাটে করে দেওয়া হল।
দুনিয়ায় এমন ‘অস্বীকারবাদীদের’ সংখ্যা অজস্র। নানা বিষয়ে তাদের যাতায়াত। যেমন ইউরোপে একদল লোক আছে যারা মনে করে হিটলারের জমানায় হলোকাস্ট হয়ইনি, ধূর্ত ইহুদিরা নিজেদের স্বার্থে এটা প্রচার করেছে। প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক এমন একটা তত্ত্ব প্রচার করে জেলে গিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে। আর্মেনিয়ানদের গণহত্যার প্রতিষ্ঠিত, তর্কাতীত সত্য তুরস্ক কখনও স্বীকার করেনি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রেসিডেন্ট এম বেকির জমানায় এইডসে আক্রান্ত হয়ে সাড়ে তিন লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল কেননা প্রেসিডেন্টকে একদল বিশেষজ্ঞ এ কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে আদতে এইডস বলে কোনও অসুখই নেই। এর অর্থ, অস্বীকারবাদ যখন সংগঠিত ভাবে ময়দানে নেমে ঘটনাবলী প্রভাবিত করে তার ফল হয় মারাত্মক। উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ক্ষতিটাই করে গেলেন।
অস্বীকার করার প্রবণতা কম বেশি সব মানুষেরই থাকে, থাকবেও। ব্যক্তিগতস্তরে কোনও কিছু অস্বীকার করা আর অনেকে মিলে জোর গলায় অস্বীকারবাদকে প্রতিষ্ঠা করা এক জিনিস নয়। অস্বীকারবাদের উৎসস্থলটি কোথায় তা নিয়ে পণ্ডিতরা গবেষণা করে চলেছেন নিরন্তর। একটি বিষয়ে তাঁরা মোটামুটি একমত – The desire for something not to be true is the driver of denialism.