- August 13th, 2022
বন্ধ বাড়িতে বাপ-মায়ের শব আগলে বসে আছে সেই মেয়ে
শুভেন্দু দেবনাথ
গত ৯ মে ছিল বিশ্ব মাতৃ দিবস। সত্যি কথা বলতে কী আমরা যারা আশির দশকে জন্মেছি আমাদের শৈশবে আলাদা আলাদা করে এমন বিশেষ দিন ছিল না। তাই আলাদা করে মাকে শুভেচ্ছা জানানোরও কোনও বিশেষ মুহূর্ত থাকত না। বরং আমরা জড়িয়ে থাকতাম, শাসনে, সোহাগে, আদরে, বাঁদরামিতে।
আমার সাহেবি কেতার বাবার গ্রাম্য ক্লাস ফোর পাশ বউয়ের জীবনেও তাই আলাদা করে কোনও বিশেষ দিন ছিল না। না জন্মদিন, না বিবাহবার্ষিকী না অন্য কোনো কিছু। মফস্সলে একান্নবর্তী পরিবারে এত জনের মধ্যে কেউই বা কবে মনে রেখেছে বাড়ির বউটির কোনও বিশেষ দিনের কথা।
আমার মা ছিলেন পাড়ার মুশকিল আসান। ভালো রান্না করতেন। তাই পাড়ায় কারও বাড়িতে পূজার্চনা হোক বা ছেলে-মেয়ের বিয়ে, রান্নার তদারকির দায়িত্ব থেকে সমস্ত নিয়মকানুনের দায় এসে পড়ত মায়ের ঘাড়ে।
আমাদের পাড়াটা ছিল চুঁচুড়া-চন্দননগরের বর্ডারে, তালডাঙায়। একটা উদ্বাস্তু কলোনি গোছের পাড়া। সকাল হলেই কলতলায় আছড়ে পড়া বাসন দিয়ে শুরু হত ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি, হাতাহাতি। আমাদের ঘুম ভাঙত এসব শব্দে। মায়ের সঙ্গে রোজই লেগে যেত কারও না কারও ঝামেলা। আবার সকালে যাদের সঙ্গে ঝামেলা দুপুরে স্নান খাওয়ার পর পাড়ার পুকুর ধারে চুল শোকাতে শোকাতে তাদের সঙ্গেই চলত দেদার আড্ডা আর পরনিন্দা-পরচর্চা। লোকে বলে আমি মাতৃমুখী তাই স্বভাবও পেয়েছি মায়ের মতোই। কিন্তু সমস্যা হল মায়ের সঙ্গে আমার দূরত্ব শত যোজন। মনোমালিন্য লেগেই আছে, কিন্তু মাকে কী আর ফেলতে পারা যায়! অতএব আমাদের সেই অম্লমধুর সম্পর্ক আজও বজায় রয়েছে।
তাই ৯ মে আর মাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়নি বা ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়নি। আসলে সারাদিনের কাজের ফাঁকে সত্যি বলতে কী মায়ের কথা একবারও মনেই পড়েনি। কিন্তু মাতৃদিবসের এক ভয়ঙ্কর ঘটনা প্রায় এক মাস হয়ে যাওয়ার পরও ভুলতে দিচ্ছে না। ঘুমের মধ্যেও বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সেই দৃশ্য।
প্রত্যেক দিনের মতো সেদিনও একের পর এক ফোন, দৌড়াদৌড়ি, অক্সিজেন সিলিন্ডার, বেড, রেসকিউর ব্যস্ততা। ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ একটা অচেনা নম্বর থেকে পুরুষ কণ্ঠে ফোন আসে। ‘দাদা, আমাদের পাড়ার এক পরিবারের তিন দিন ধরে কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দরজা বন্ধ। গন্ধও বেরোচ্ছে সামান্য। আপনারা একটু দেখবেন!’ খুঁটিয়ে প্রশ্ন করি ভদ্রলোককে। বাড়িতে মোট তিন জন থাকেন। বাবা-মা আর মেয়ে। এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেটের কাছের একটি পাড়া। আমাদের শহরতলির মত নয়। কলকাতার ফ্ল্যাট কালচারের পাড়াগুলিতে কে-ই বা কার খবর রাখে। ছুটে যাই আমার দু-তিন জন সঙ্গীকে নিয়ে। সত্যিই ফ্ল্যাটটা থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে। ধাক্কাধাক্কি-ডাকাডাকিতেও সাড়া মেলে না দরজার ও প্রান্ত থেকে। ফ্ল্যাটের চারদিকে জড়ো হওয়া মানুষজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি, কেউ বলে পুলিশে খবর দিন, কারও বা বক্তব্য মরে টেরে গেল নাকি… মহিলাদের মধ্যে ফিসফাস, গুঞ্জন— মেয়েটার একটা লাভ অ্যাফেয়ার ছিল না! রাত বিরেতে বাড়ি ফিরত।
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, থানা পুলিশ পরে হবে আগে তো দেখি কেউ বেঁচে আছে কি না, তাকে উদ্ধার করতে হবে। তিন জনে মিলে দরজা ভেঙে ফেলি। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতেই পিছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তামাশা দেখতে আসা লোকজন। কিন্তু আমাদের তিন জনের পাশপাশি উপস্থিত জনতাকেও স্তম্ভিত করে দেয় ভিতরের দৃশ্য। বেডরুমে একটি বড় খাটে বালিশে মাথা দিয়ে পাশাপাশি ঘুমোচ্ছেন দুই বয়স্ক পুরুষ এবং নারী। আর বয়স্ক মহিলাটির মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করছে এক ১৭-১৮ বছরের তরুণী। সারা ঘরে মর্গের মতো দুর্গন্ধ। পরিস্থিতি বুঝতে সময় লাগে না। দ্রুত বুঝে যাই কী করতে হবে।
দু’জনের নাড়ি পরীক্ষা করি, ঠান্ডা শরীরে স্পন্দন অনুভব করতে পারি না। তরুণীটিকে ধরে বার দুয়েক ঝাঁকুনি দিয়েও তার সম্বিৎ ফেরাতে পারি না। অগত্যা পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকেই বার কয়েক তার গালে চড় মারতেই হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে মেয়েটি। কয়েক দিন ধরেই বাবা-মা অসুস্থ। করোনা পজিটিভ রিপোর্টও আসে। টেলি মেডিসিন চলছিল। দিন তিনেক আগে ভয়ানক শরীর খারাপ হতে থাকে দু’জনের। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হওয়া, হাসপাতালে না যাওয়া মেয়েটি বুঝতে পারে না কী করণীয়। আত্মীয় স্বজনরাও অনেক দূরে। ফোনে তাদেরও সহায়তা পায়নি। বহু জায়গাতেই ফোন করেছে কিন্তু… শেষমেশ বসে বসেই বাবা-মায়ের মৃত্যু দেখেছে সে।
আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা মেয়েটার মাথায় আপনা হতেই আমার হাত চলে যায়। মৃতদেহ সৎকারের চেয়েও আগে জরুরি এই মেয়েটিকে সামলানো। ইতিমধ্যেই গুঞ্জন বেড়েছে বাইরের ভিড়ের। কেউ দাবি তুলেছেন পুলিশে খবর দেওয়ার, কেউ বা বলছেন অন্য ব্যবস্থার কথাও। বেঁচে থাকতে কিন্তু কেউই এসে দাঁড়ায়নি মেয়েটির পাশে।
ফোন করি এক সাইকোলজিস্ট বন্ধুকে, তাকে সবটা জানাতেই সে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে, তার দায়িত্ব নেয়। আমরাও থানায় জানাই। পরিচিত অফিসার, সাহায্যও করেন অনেকটা। সৎকারের বন্দবোস্ত হয়। মেয়েটিকে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে যায় বন্ধুটি। সেখানেই তার কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করে আমার বন্ধু। দু’দিন ধরে আমার সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধুটি মেয়েটিকে কাউন্সেলিং করায়। তাকে অনেকটা ধাতস্থ করে। মৃতদেহের মুখাগ্নি আমাকেই করতে হয়।
করোনায় মৃতদের পোড়ানোর নিয়ম আলাদা। সৎকারের হিন্দু রীতি নিয়ম সেখানে চলে না। ওই নমো নমো করে দুটো শরীরে আগুন ঠেকাই। হাঁ করে তাকিয়ে থাকি পুড়তে থাকা শরীর দুটোর দিকে। আগুন যখন জ্বলতে জ্বলতে মেয়েটির মায়ের মাথার চুলগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছিল তখন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিশোরীর ওই চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার দৃশ্য। তাকাতে পারি না। চলে আসি সেখান থেকে। রাতের বেলায় ক্লান্ত অবসন্ন যখন আমি বন্ধুর বাড়িতে যাই। মেয়েটি ঘুমোচ্ছে, নিষ্পাপ, ঘুমন্ত মুখে সামান্য যন্ত্রণার ছাপ। বন্ধুটি বলে ভয়ের কিছু নেই। কাল করোনা রিপোর্ট আসবে, আরও দু’দিন নিজের কাছে রেখে মেয়েটিকে সেই পৌঁছে দেবে মামার বাড়িতে। মেয়েটির কাছ থেকে তার মামার বাড়ির নম্বর নিয়ে ইতিমধ্যেই বন্ধুটি যোগাযোগ করে ফেলেছে।
আবারও প্রায় যন্ত্রের মতো নিজের শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে ফিরি। তখন অনেক রাত। যন্ত্রের মতোই স্নান করি, এক কাপ চা খাই, কিন্তু রাতের খাবার কিছুতেই তুলতে পারি না মুখে। ক্রমগত একটি দৃশ্য মাথায় ঘোরা ফেরা করে, এক তরুণী পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মায়ের মাথায়।
জীবনে কখনও মাকে মাতৃদিবসের শুভেচ্ছা না জানানো আমি রাত ১২টায় ফোন করি। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোনো আমার মায়ের ফোনটা বেজে যায়, বেজেই যায়। এ বছরও আর মাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। শুধু একটা এসএমএস ইথার তরঙ্গে ছেড়ে দিই, তোমাকে বড্ড ভালোবাসি মা। সকালে ফোন কোরো…


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

