একটি চেয়ারের গপ্পো
সুমন চট্টোপাধ্যায়
হঠাৎ সেদিন একটি ছোট্ট কাঠের চেয়ারের ছবি ভেসে উঠল আমার টাইম-লাইনে। কিঞ্চিৎ মলিন তবে যত্নআত্তির ছাপও স্পষ্ট। আজ প্রায় ৫৫ বছর হয়ে গেল, একটি পরিবার সেটিকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এই খবরটি পাওয়া ইস্তক আমার বিহ্বলতা যেন কিছুতেই আর কাটছে না। যতবার ভাবছি মনে একটাই প্রশ্ন ঊঁকি দিচ্ছে। মানুষের স্নেহ-মমতা কী করে এমন অবিশ্বাস্য বিন্দুতে পৌঁছতে পারে! এই নির্মম, স্বার্থপর সংসারে তাহলে এমন আপাত-অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে।
ওই চেয়ারটির কোনও ঐতিহাসিক মূল্য নেই। কেননা কোনও রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা নেতাজি সুভাষ তাতে শৈশবে বসেননি। এমনকি যে পরিবারে এটি যত্নে রক্ষিত হয়েছে সেই পরিবারের কোনও শিশুও নয়। তাহলে বসল কে? কেনই বা কোনও পরিবার পরের বাড়ির ছেলের স্মৃতিচিহ্ন এমন নীরবে বয়ে চলেছে? কাহিনির চমকটুকু এখানেই।
চলুন ফ্ল্যাশব্যাকে ফেরা যাক ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। শহর ঝাড়গ্রাম, ইস্কুলটির নাম বিদ্যাসাগর বাণীভবন।তখন ছিল নার্সারি আর প্রাইমারি।একেবারে শহরের প্রান্তসীমায়, নির্জন এক কোণে। বিশাল খেলার মাঠ, বাহারি ফুলের বাগান, আতা-পেয়ারা-বাতাবি লেবুর গাছ-গাছালি মোড়া বেশ আশ্রমিক, আরণ্যক পরিবেশ। শহরের বাচ্চারা আসত পলকা ভ্যানে চড়ে। চালাতেন ভুবন’দা। বাড়ি থেকে ইস্কুল এই পথটুকুতে তিনিই বাচ্চাদের বাবা-কাকা-জ্যাঠা সব। ভ্যানের অন্দরে বেশি পেঁয়াজি করলে তাঁর কান মুলে দেওয়ার অধিকার সর্বজনস্বীকৃত।
ইস্কুলে দিদিমণি ছিলেন জনা কতক। তাঁদের মধ্যে দু’জন দুই সেকশনের প্রধান। বড়দিমণি লীনা বসু প্রাইমারির, ইভা সেনগুপ্ত নার্সারির। গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের। তুই-তুকারির সম্পর্ক। লীনা’দির চেহারাটা ছিপছিপে, ইভা’দি পৃথুলা। দু’জনেই রোজ পাটভাঙা শাড়ি পড়তেন, সাধারণ সুতির। দু’জনের কারুরই তখন বিয়ে হয়নি, পরেও তাঁরা জোড় বেঁধে আজীবন কুমারী থাকার পণ করেছিলেন। দু’জনেই আদতে কলকাতার বাসিন্দা, গরম আর পুজোর ছুটিতে বাড়ি যেতেন। বাকি পুরোটা সময় ইস্কুলে। ইস্কুলটাই তাঁদের প্রাণ আর বাচ্চাগুলো সন্তান।
সন্তানদের মধ্যে একজন ছিল দু’জনেরই সমান প্রিয়পাত্র। সে লেখাপড়ায় যতটা ভাল ছিল তার চেয়ে বেশি সুনাম কুড়িয়েছিল দস্যিবৃত্তিতে। বাচ্চাদের মধ্যে যেখানে গন্ডগোল সেখানেই সে অনিবার্যভাবে মধ্যমণি। সেই সবচেয়ে বেশি গাছে চড়ে, দোলনায় আর কাউকে দুলতে দেয় না, তারজন্যই ইস্কুলে ডেটলের শিশি সত্বর খালি হয়ে যায়। আবার টিফিনে যদি দুটি মুড়ির মোয়া বরাদ্দ থাকে সে তৃতীয়টি পাওয়ার জন্য হাত পাতবেই। স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানও তাকে বাদ দিয়ে করা যাবে না। সে গাইবে, আবৃত্তি করবে, অভিনয়ও করবে। তবু দুই দিদিমণি তাকেই ভালবাসবে সবচেয়ে বেশি। সে মার খাবে যত, আদরও পাবে সমানুপাতিক। কেননা পরীক্ষায় দেখা যাবে সব বিষয়ে তাকে ফুল মার্কস না দিয়ে পারা যাবে না। চতুর্থ শ্রেণির শেষে বৃত্তি পরীক্ষায় ইস্কুলের মান রাখল সেই খুদেই। অঙ্কে ১০ নম্বর ভুল করে বসেও।
সেই ছেলে ইস্কুলে যে চেয়ারটিতে বসত, দুই দিদিমনি বোধহয় তাতে পরে আর কাউকে বসতে দেননি। তারও বহু বছর পরে অবসর নেওয়ার সময় বাক্স-প্যাঁটরার সঙ্গে ইভাদি ওই চেয়ারটিও নিয়ে এলেন কলকাতায় বাপের বাড়িতে, চলে যাওয়ার সময় ভাইঝি সুতপাকে বলে গেলেন সেও যেন যত্ন করে সেটিকে রক্ষা করে।
এমন পরমাশ্চর্য ঘটনাটির কথা সেদিনের সেই শিশু জানতে পারল দিন কতক আগে, দৈবাৎ। এখন সেই শিশুর বয়স ৬১ পেরিয়েছে। মাথার চুল পাতলা, এক গাল সাদা দাড়ি, হৃদয়ের তন্ত্রীতে দু’টো স্টেন্ট, সকাল সন্ধ্যে দেড় ডজন ওষুধ নির্ভর তার জীবন। কাউকে না জানিয়ে একজন শিক্ষিকা নীরবে, নিজের গৃহকোনে একজন প্রিয় ছাত্রের স্মৃতিকে এভাবে বুকে আগলে রাখতে পারেন ভাবলেই আজকের বৃদ্ধ-শিশুর চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। নাভিস্থল থেকে উঠে আসছে একটিই শব্দ। প্র-ণা-ম।
আর হ্যাঁ, শিশুটির নাম বলার কোনও প্রয়োজন আছে কি?