- August 16th, 2022
বুদ্ধ ও নির্বাণ (পর্ব-৩)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমার অতি বড় দুর্ভাগ্য প্রমোদ দশগুপ্তকে চেনার সুযোগই পাইনি। ১৯৮২ সালে চিনে সফররত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু হলো, আমি তখন আজকালের ডেস্কে শিক্ষানবিশি করছি। সেই সফরে প্রমোদবাবুর সঙ্গী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর শেষযাত্রার ছবিটি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। লাখ লাখ মানুষের মৌন মিছিল নেমেছে কলকাতার রাজপথে, ইতি-উতি শোনা যাচ্ছে কোরাসে ‘ইন্টারন্যাশিওনাল’, অনেকেরই চোখ অশ্রুশিক্ত। পরের দিন কলকাতার কোনও একটি ইংরেজি কাগজ হেডলাইন করেছিল, ‘হি স্টার্টেড অ্যাজ এ ওয়ার্কার, বিকেম এ লিডার, ডায়েড অ্যান ইনস্টিটিউশন।’ একটি লাইনে সবটুকু বলে দেওয়া।
প্রমোদ দাশগুপ্তর অনুপস্থিতি সিপিএমের নির্বাচনী ভাগ্য সে ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি, তার পরেও প্রায় ৩০ বছর দল রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। তবু বলব, তাঁর কোনও যোগ্য বিকল্পও সিপিএম আর খুঁজে পায়নি।
১৯৬৪ সালে পৃথক দল হিসেবে সিপিএমের জন্ম হওয়ার পর থেকে ১৯৮২-তে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রমোদবাবু দলের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন, সংগঠনের ওপর তাঁর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ছিল, দল আগে না সরকার এই বিতর্কে তাঁর মতামত ছিল সুস্পষ্ট। কমবয়সী কমরেডরা তাঁকে ভক্তি করতেন যতটা ভয় পেতেন তারও বেশি।
অনেক পরে অন্য একটি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রমোদ’দার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসই আমাদের কারও ছিল না। মুখ ফুটে কিছু চেয়ে নেওয়ার তো প্রশ্নই নেই।’
সরকারে না গিয়ে কেন তিনি সারাটা জীবন সংগঠনে কাটিয়ে দিলেন, অনিল বিশ্বাসকে আমি একবার এই প্রশ্নটি করেছিলাম। তাঁর জবাব ছিল, প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে সরকার আর দলের মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নিতে বলেছিলেন। তাঁর রায় ছিল দলের পক্ষে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হাসতে হাসতে অনিলবাবুর এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘অসম্ভব, এটা কিছুতেই হতে পারে না। প্রমোদ’দা আমাদের সঙ্গে এ সব কথা আলোচনাই করতেন না, আমাদেরও সাহস ছিল না, লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করি।’ রাজ্য সিপিএম আর প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিল সমার্থক, তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত। বলতে গেলে সিপিএমের অন্দরে তিনিই আইন।
তবে এ কথা ঠিক ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে প্রমোদবাবু তিন জনকে চিহ্নিত করেছিলেন- বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কে দলে থাকবেন আর কে সরকারে যাবেন সেটা তিনিই নির্ধারণ করেছিলেন কি না বলা কঠিন। প্রমোদবাবুর জীবদ্দশাতেই ১৯৭৭-এ রাজ্যে প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল, তিন জনের মধ্যে একা বুদ্ধবাবুই মন্ত্রী হয়েছিলেন। বাকি দু’জন কোনও দিন মহাকরণের ছায়াই মাড়াননি, স্বেচ্ছায় না দলীয় নির্দেশে বলতে পারব না।
প্রমোদ দাশগুপ্ত, বলাই বাহুল্য, সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। আমার যেটা ভালো লাগত, তিনি দিল্লির জো-হুজুর বৃত্তি তো করতেনই না, অনেক সময়ই পলিটব্যুরোর পরামর্শ স্রেফ অগ্রাহ্য করতেন। ১৯৮২-র বিধানসভা ভোটে বাম-গণতান্ত্রিক জোটকে শক্তিশালী করার স্বার্থে পলিটব্যুরো পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমকে পরামর্শ দিয়েছিল কংগ্রেস (স)-কে বামফ্রন্ট জোটের শরিক করার। প্রমোদবাবু তাতে শুধু যে কর্ণপাত করেননি তা নয়, প্রকাশ্য সাংবাদিক বৈঠকে নাম না করে পলিটব্যুরোর সদস্যদের উপহাস করেছিলেন। ‘এমন পরামর্শ তারাই দেয় যাদের নিজেদের কোমরের জোর নেই।’ প্রমোদবাবুর পরে এই সাহস সিপিএমের অন্য কোনও রাজ্য সম্পাদক দেখাতে পারেননি, বরং পলিটব্যুরোর ভুঁইফোড় দক্ষিণী নেতাদের কাছে বারেবারে আত্মসমর্পণই করেছেন। অবশ্য সে প্রসঙ্গে আসব পরে।
ওই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কংগ্রস (স) ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। প্রিয়রঞ্জন সেই দলের সভাপতি। পরের বছর বিদ্রোহে রাম রাম করে দুই কংগ্রেসের মিলন হয়ে যায়।
আজকালের সম্পাদক আর প্রমোদবাবু ছিলেন চুরুট-কমরেড, একজনের রাজনৈতিক অবস্থান উত্তর গোলার্ধে হলে অন্যজনেরটা ছিল দক্ষিণে। তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও প্রভাবিত হয়নি। পরে আনন্দবাজারে গিয়ে শুনেছি, প্রমোদবাবু বরুণ সেনগুপ্তকে বিশেষ স্নেহ করতেন, অনেক খবর তিনি বরুণদা ছাড়া আর কাউকেই দিতেন না। বুর্জোয়া কাগজের একজন আপাদমস্তক বুর্জোয়া সাংবাদিক এমন পক্ষপাত আদায় করে নিতে পেরেছিলেন কী করে? কেউ বলেন এটা ছিল ‘বরিশালী ঐক্য’ কেউ বলেন ‘বদ্যি-একতা’। আমার মনে হয় সবার ওপরে প্রমোদবাবুর একটা স্নেহশীল মন ছিল, যেখানে রাজনীতি, শত্রু-মিত্রবোধ ছায়াপাত করতে পারত না একেবারেই। এই গুণ কম বেশি প্রায় সব প্রবীণ সিপিএম নেতাদের মধ্যেই ছিল- সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত, বিনয় চৌধুরী মায় জ্যোতি বসুর মধ্যেও।
আজকাল প্রকাশিত হয় ১৯৮১-র মার্চে, পরের বছরেই ছিল বিধানসভা ভোট। আমি তখন ডেস্কে চাকরি করি, জমিতে নেমে ভোট কভার করার সুযোগ ছিল না, রিপোর্টার বন্ধুরা সরেজমিনে কভার করত, আমার কাজ ছিল তাতে শিরোণাম বসানো, ঈর্ষা হতো, মনোকষ্টও, কিন্তু সম্পাদকের ফতোয়া অগ্রাহ্য করার উপায় ছিল না। ৮২-র ভোটে বামফ্রন্ট প্রত্যাশিত ভাবেই বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিল, সম্ভবত ৫০ শতাংশের বেশি ভোটই পেয়েছিল, কংগ্রেসের জোট কল্কেই পায়নি। জয়ের দুগ্ধপাত্রে দু’ফোঁটা গো-চোনা পড়ল দুই মহারথীর অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে। কাশীপুর কেন্দ্রে প্রফুল্লকান্তি ঘোষের কাছে যৎসামান্য ভোটে হেরে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, রাসবিহারীতে রাজনীতিতে আনকোরা ডাঃ হৈমী বসুর কাছে পরাজিত হলেন ডঃ অশোক মিত্র। এই দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের পরাজয়ই ছিল ৮২-র ভোটের বড় খবর। হেরেছিলেন আরও দুই মন্ত্রী তবে তাঁরা তারকা ছিলেন না।
কাশীপুরে সামান্য ভোটে হারার পরে কেন্দ্র বদল করে বুদ্ধদেব চলে এলেন যাদবপুরে। ২০১১-র ভোটে হারা পর্যন্ত এখান থেকেই তিনি সব ক’টি বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছেন। একটি কেন্দ্রে হেরে গেলে আর সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করাটা বাংলার ভিআইপি রাজনীতিকদের চালু অভ্যেস। যেমন বরানগরে হারার পরে জ্যোতিবাবু চলে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাতগাছিয়ায়। যাদবপুরে হেরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় গেলেন বোলপুরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতায়। আমার একে পলায়নী মনোবৃত্তি ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি।
বুদ্ধদেববাবু যখন পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে আছেন, আমার পেশাগত জীবনে তখনই ঘটেছে বড় রদবদল। ৮৩-র মে মাসে আমি আজকাল ছেড়ে আনন্দবাজারে চলে যাই, ঠিক দু’বছরের মাথায় বদলি হয়ে যাই দিল্লিতে। আমার কাছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে যান দূরের মানুষ, ৯৩-এ আমি কলকাতায় না ফেরা পর্যন্ত। (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

