Wednesday, October 30, 2024

ব্রুনোই হয়ে উঠুক ইউটোপিয়া

Must read

বিশেষ প্রতিবেদন: চেক রিপাবলিকের বার্নো শহর। তার ঠিক মাঝখানটিতে বিশাল বাস স্ট্যান্ড। সেখানে এসে প্রায়ই বসে থাকেন আলেক্সান্দ্রু। বসে বসে অপেক্ষা করেন দীর্ঘকায় মানুষটি। কখন একটা বাস আসবে তাঁর স্বদেশ মল্ডোভা থেকে। নিদেনপক্ষে পড়শি দেশ ইউক্রেন থেকে। বাস আসে, যাত্রীরা এক এক করে নামেন, আলেক্সান্দ্রু দেখে বোঝার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে কার সঙ্গে উজিয়ে গিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। তখনই নজর পড়ে ভদ্রলোকের উপর। ওই যে বাস থেকে নেমে ঢাউস ব্যাগটা বইতে বইতে গিয়ে বসেছেন ওই বেঞ্চিটায়, ওঁর কথাই বলছি।

এগিয়ে যান আলেক্সান্দ্রু। মাতৃভাষা রোমানীয়তে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোত্থেকে আসছেন? মল্ডোভা?’ উত্তর আসে রুশ ভাষায়। সে ভাষাতেও অবশ্য সমান স্বচ্ছন্দ আলেক্সান্দ্রু। স্মিত মুখে তিনি নিজের পরিচয় দেন, এগিয়ে দেন নিজের কার্ডও। ‘আলেক্সান্দ্রু সেবান। পুর- কর্মচারী। যে কোনও দরকারে যোগাযোগ করতে পারেন আমার সঙ্গে।’

ব্রুনো-র পৌর-প্রশাসনের সংস্কৃতি-দপ্তরের কর্মী সেবান পরে জানান, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপকার করতে গেলে উল্টোদিকের মানুষটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল বোঝেন, সন্দিহান হয়ে ওঠেন। দশজনের মধ্যে অন্তত দু-একজন কার্ড নিতে রাজি হলেই সেবানের আর আনন্দের সীমা থাকে না। পুরসভায় চাকরির পাশাপাশি গির্জায় পৌরোহিত্যও করেন সেবান মাঝেসাঝে।

যে অভিবাসীদের সঙ্গে সেবানের আলাপ হয়, তাঁদের কেউ নির্মাণকর্মী, কেউ ফলের গুদাম কিম্বা মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ নিয়ে আসেন। কর্মী ভিসা পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয় প্রচুর। তাই টুরিস্ট ভিসা নিয়েই আসেন তাঁরা সাধারণত, মেয়াদ ফুরোলে ফিরে যান, আবার আসেন কিছুদিন বাদে। এক একবারে মাস-তিনেকের জন্য।

অধিকাংশ সময়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা মালিকপক্ষের দ্বারা প্রতারিত হন, ন্যায্য মজুরি পান না, জড়িয়ে পড়েন নানারকম ঝামেলায়। আর ঠিক সেই সময়ে সেবানের কথা মনে পড়ে যায় তাঁদের। এইসব জট ছাড়ানোর পাশাপাশি চেক প্রজাতন্ত্র নামক দেশটির রীতিনীতি ধরনধারণ সম্পর্কে দেশোয়ালি ভাইদের অবহিত করাকেও অত্যন্ত জরুরি কাজ বলে মনে করেন আলেক্সান্দ্রু সেবান।

সেবান জানান, ‘পরিযায়ী শ্রমিকরা যত অল্পদিনই থাকুন না কেন, এ দেশ এবং এই শহরের সমাজ ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তাঁদের বুঝতে হবে তো! বিনা টিকিটে যে হুট্ করে ট্রামে উঠে পড়া যায় না কিম্বা যিনি আবর্জনা পরিষ্কার করেন, তাঁকে পারিশ্রমিক দিতে হয়, এগুলো জেনে না রাখলে পদে পদে সমস্যায় পড়তে হবে তাঁদের।’

ভিয়েতনাম, মধ্য প্রাচ্য, মল্ডোভা, রোমানিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন.. এ সব দেশ থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা আসেন এ শহরে। যে সমস্ত সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ, যাদের সঙ্গে মেলামেশা বিরল হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক দূরত্বও বেশি, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে তাঁদেরই পছন্দ করে এ শহরের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ দপ্তর। তাঁদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের কাজটি করে থাকেন প্রধানত সেবানের মতো অভিবাসী কিছু মানুষ। দেশ ছেড়ে চলে আসা এই মানুষগুলো নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে অনুভব করতে পারেন পেটের টানে বিদেশ- বিভুঁইয়ে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের সুবিধা- অসুবিধা, চাওয়া-পাওয়া, বেদনা, পিছুটান।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দক্ষিণ মোরাভিয়া অঞ্চলে, এবং তার রাজধানী ব্রুনোতে, অভিবাসী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০১৭-এ, যখন প্রথম সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তিকে সরকারি কর্মসূচির ভিতর নিয়ে আসা হয়েছিল, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৬, ৫৭৪। ২০২০-র শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৫৯,০০০। এই বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল চেক অর্থনীতিও। ২০২১ এর  হিসেব অনুযায়ী সে দেশের মোট শ্রমশক্তির ১৭% ছিলেন অভিবাসী শ্রমিক। শিল্পক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন, দক্ষ শ্রমশক্তির প্রয়োজন। নিজের দেশে তার অভাব থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়। শুধু শিল্পক্ষেত্র নয়, মরসুমি ফল তোলার কাজেও দরকার হয় পরিযায়ী শ্রমশক্তি। ব্রুনো শহরজুড়ে অগুনতি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালান ভিয়েতনামী অভিবাসীরা।

২০১৭-এ অভিবাসী শ্রমিকদের পাশে থেকে সবরকম সহযোগিতার দায়িত্ব দেওয়া হয় বেশ কিছু এনজিও-কে। যদিও এ কাজে যে এনজিও-রা খুব একটা সফল হবে না, সে বিষয়ে প্রায় নিঃসংশয় ছিলেন ব্রুনো-র সরকারি ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শ্রীমতী লেঙ্কা সাফ্রাঙ্কোভা পাভলিকোভা। পাশাপাশি তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল পৌর-প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি-বিভাগের কর্মীদের প্রতি। যে ব্যবস্থার অভ্যন্তর সমস্যা নিরসনের রাস্তা খুঁজে খুঁজে সেই অনুযায়ী নীতি নির্ধারিত হয়, সেখানকার কর্মীরাই এই সেতু-বন্ধনের কাজটা সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে করবেন, এ প্রত্যয় তাঁর ছিল।

২০১৫-এ যে প্রবল উদ্বাস্তু সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ইউরোপের মানুষকে, তার ফলস্বরূপ অভিবাসী মানুষদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়। অতএব সমাজ ও সংস্কৃতির মূলস্রোতে তাঁদের সামিল করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহযোগিতা পাওয়াও খুব সহজ কাজ ছিল না সে সময়ে। সৌভাগ্যক্রমে  ব্রুনো শহরে ভাবনাচিন্তার এক উদার পরিসর তৈরি হয়েই ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ‘জিট ব্রুনো’ (বাঁচো, ব্রুনো)-র কল্যাণে। ফলে কোনও রকম বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়নি ব্রুনো-র বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে যুক্ত করার এই প্রকল্পে। কর্মসূচির খসড়া করে ফেলেন সাফ্রাঙ্কোভা পাভ্লিকোভা, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে ইউরোপীয় কমিশন।

সেবানের মতো পৌর-কর্মচারীরা অভিবাসীদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি ইস্কুল, চিকিৎসা- ক্ষেত্র, সরকারি দপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকেও সামিল করে নেন এই কর্মসূচিতে। দু’টো ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যেই ব্রুনোর আরব অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন আর এক পুর-কর্মী কারিন আতাসি। হোয়াং ভ্যান তিয়েন, ব্রুনো শহরের আর এক সংস্কৃতি-কর্মী। তিনি কাজ করেন ওলোমোউকা স্ট্রিটের ভিয়েতনামী দোকানদার আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পরিযায়ী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, মুখোমুখি কথা বলেন, ভাবের আদান-প্রদান করেন, নিজেদের কর্মসূচি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করেন তাঁদের। ইউক্রেনীয় কর্মী ক্যাটরিনা হার্টলোভাও একই কাজ করেন, কিন্তু অন্য মাধ্যমে। তাঁর কাজ পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেসবুক গ্রুপগুলোকে নিয়ে। লিয়েন ভারকোভা বিভিন্ন দৈনন্দিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ইউটিউব ভিডিও তৈরি করেন ভিয়েতনাম থেকে আগত অভিবাসীদের জন্য। সন্তানকে প্রাথমিক ইস্কুলে ভর্তি করতে গেলে কী কী করতে হবে, এরকম একটা ভিডিও পেলে অভিভাবকদের কাজটা সহজ হয়ে যায়। অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্যও ব্যবস্থা করা হয় কর্মশালার। এভাবে, নিবিড়ভাবে মিশতে মিশতে, একসময়ে, সেবান, আতাসি, হোয়াং ভ্যান তিয়েন, ক্যাটরিনা, ভারকোভারা দেশ ছেড়ে আসা মানুষগুলোর বিশ্বাস অর্জন করতে সফল হন, সামিল হয়ে পড়েন উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, বেদনা, সমস্যায়।
পর্তুগাল, স্পেন, জার্মানির মতো পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে ১৯৯০ থেকেই সংস্কৃতি-কর্মীরা কাজ করতেন। তাঁদের ডাকা হত সামাজিক-সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী নামে। চেক রিপাবলিকে একুশ শতকের শুরুর দিকে এই সংস্কৃতি বিনিময়ের ধারণাটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী লিসবন ও ভিয়েনা ছিল ব্রুনোর সংস্কৃতি-কর্মীদের স্বপ্নের শহর। উদ্বাস্তু, পরিযায়ী, অভিবাসীদের মানবাধিকার এবং সমানাধিকারের প্রশ্নে এই দু’টি শহরের উজ্জ্বল অবদান তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিল।

অস্ট্রিয়ার মতো পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিতে এই কর্মসূচি রূপায়ণে প্রয়োজনীয় অর্থের স্থায়ী জোগান থাকলেও ব্রুনোকে এখনও অর্থনৈতিক ভাবে নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আর্থিক সাহায্য নিয়ে চলতে হচ্ছে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়ক দপ্তরটিকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আর্থিক অনুদানের আবেদন ইত্যাদি ক্লান্তিকর বিষয়ে, ফলে আসল কাজটা যতখানি ফলপ্রসূ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না।

এছাড়া, আইন এড়িয়ে কোনও রকম ভিসা ছাড়াই ব্রুনোতে কাজ করতে চলে আসেন প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিক, ধরা পড়ে আটক হন চেক পুলিশের হাতে। অথবা, ভিসা না থাকায়, বছরের পর বছর কাজ করেও বহু পরিযায়ী শ্রমিক অবসরের পর বার্ধক্যভাতা পান না, দাবিও করতে পারেন না। এই প্রবণতা যাতে কমানো যায় সে বিষয়ে পুর-কর্মীদের সক্রিয় উদ্যোগ অব্যাহত আছে।

আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনি নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাফ্রাঙ্কোভা পাভ্লিকোভার উৎসাহে ও সুযোগ্য নেতৃত্বে পথ-চলা আলেক্জান্দ্রু সেবানরা স্বপ্ন দেখে চলছেন এমন এক সমাজের যেখানে উদ্বাস্তু মানুষ নতুন করে শিকড় খুঁজে পাবেন, পরিযায়ী শ্রমিক আর স্বদেশি শ্রমিক সমান অধিকার নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন, অভিবাসীর সন্তান বঞ্চিত হবে না কোনও সুযোগসুবিধা থেকে।

সাকার হোক এ স্বপ্ন! ব্রুনো হয়ে উঠুক পৃথিবীব্যাপী অগুনতি বাস্তুহারা মানুষের ইউটোপিয়া। সে স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর দিকে দিকে, কোনায় কোনায়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article