31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

বিশ্বকাপে আর মারাদোনাই নেই

Must read

ওরে বাবা ব্রাজিল (৩)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আমরা লস এঞ্জেলেস পৌঁছনর আগেই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা ফুটবল বিশ্বকে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কলম্বিয়ায় এসত্রে এসকোবারের হত্যা আর বিশ্বকাপের আসর থেকে ফুটবলের রাজপুত্রের নির্বাসন। তখন আমি কলকাতায়, নিমগ্ন হয়ে বিশ্বকাপের খবর ছাপছি। আমার মস্তিষ্ক প্রসূত একটি আট কলমের শিরোণাম ২৮ বছর পরে এখনও মনে আছে। ‘বিশ্বকাপে আর মারাদোনা-ই নেই।’

উঠতি কলম্বিয়ান প্লেয়ার এসকোবারকে প্রাণটা দিতে হয়েছিল আমেরিকার সঙ্গে ম্যাচে ভুল করে একটি আত্মঘাতী গোল করে বসায়। কলম্বিয়া ওই ম্যাচে হেরে গিয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যায়। তার পরপরই কলম্বিয়ার মেডেলিনে ভোর রাতে একা শূন্য পার্কিং লটে গাড়িতে উঠে স্টার্ট গিতে যাবে, মোটর সাইকেলে চড়ে তিন সশস্ত্র আততায়ী গুলিতে গুলিতে এসকোবারকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। নেটফ্লিক্সের সুবাদে কলম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেল, এক সময় তাদের অবিসম্বাদিত ডন পাবলো এসকোবার এখন আমাদের সকলের পরিচিত মুখ। বোঝা যায় এই নৃশংস হত্যাকান্ড তাদেরই কাজ।

মারাদোনা ডুবেছিলেন স্বখাত সলিলে, ড্রাগ টেস্টে পরপর দু’বার ফেল করে। বিস্ময়কর প্রতিভাধরেরা বখাটে, বাউন্ডুলে, সুরা, নারী, মাদকে আসক্ত হবেন, স্বভাবে কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতিস্থও হতে পারেন, এটা প্রকৃতির স্বীকৃত নিয়ম। সাহিত্য, শিল্প, অভিনয় থেকে খেলার মাঠ সর্বত্রই এমন প্রতিভার ছড়াছড়ি। এঁদের মধ্যে দিয়েগো মারাদোনা সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী, বেপরোয়া ব্যাভিচারী, নজরুলের ভাষা ধার করে বলতে হয়,’ অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল, আমি দলে যাই যত বন্ধন যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।’ মাদক সেবনের দায় ধরা পড়ে ১৯৯১-৯২ সালেই দেড় বছরের জন্য ফুটবল থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন, ইতালিতে নাপোলির হয়ে খেলার সময়। পরীক্ষা শুরু হতেই মারাদোনা সেই যে নাপোলি থেকে পালালেন আর কখনও ফিরে যাননি।

নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, এমন একটা শাস্তি পাওয়ার পরে যে কোনও পাগল বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখত, বিশেষ করে যখন সেটাই ছিল দেশের জার্সি পড়ে ফুটবলকে রাজকীয় বিদায় জানানোর শেষ অবকাশ। অনেক কসরত করে তার আগে মারাদোনা শরীর থেকে কিলো কিলো চর্বি ঝরিয়ে নিজেকে মাঠে নামার উপযুক্ত করে তুলেছিলেন অনেকখানি। তাঁর নাদুস নুদুস চেহারা দেখে যারা তাকে নিয়ে উপহাস করত বা প্যাঁক দিত, আমেরিকায় রওনা হওয়ার আগে তাদের উদ্দেশে তিনি পাটকেল ছুঁড়ে বলেছিলেন, “দিয়েগো কী বস্তু এই মূর্খগুলো এবার তা টের পাবে।’

এমন আত্মপ্রত্যয় নিয়ে, আর্জেন্তিনার অধিনায়ক হয়ে জীবনের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসে অকস্মাৎ মাথায় কেড়া নড়ে উঠল রাজপুত্তুরের, পরপর দু’বার ল্যাবরেটিরতে পরীক্ষা করানোর পরে দেখা গেল বাবাজীবন এমন ওষুধ গিলেছেন যাতে একটি-দুটি নয়, পাঁচ-পাঁচটি নিষিদ্ধ উপাদান আছে। দলের ম্যানেজারকে দিয়েগো নির্জলা ঢপ দিয়ে জানিয়ে রেখেছিলেন, সাইনাসের সমস্যার জন্য তিনি একটা ওষুধ খেয়েছেন। পরে ল্যাবরেটরির রিপোর্ট পড়ে শুনিয়ে ফিফার কর্তারা সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দিলেন দুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ওষুধ তৈরিই হয়নি যাতে একসঙ্গে এই পাঁচটি উপাদান আছে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো প্রকাশ্যে এল এই ভয়ঙ্কর খবর, গোটা আর্জেন্তিনা জুড়ে নেমে এল শোক আর বিহ্বলতা। ফুটবল খেলিয়ে গোটা বিশ্ব একাত্ম বোধ করল আর্জেন্তিনার সঙ্গে। ফুটবলের রঙ্গমঞ্চ থেকে চির-বিদায় নেওয়ার আগে নিজের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল থার্টিনকে মারাদোনা বলে গেলেন,’ এরা আমাকে ষড়যন্ত্র করে অবসর নিতে বাধ্য করাল। আমার মন ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে, আর কিছুই আমি বলতে পারছিনা।’

সেদিন আনন্দবাজার অফিসে নিজের ঘরে বসে আমার মনে হয়েছে, প্রিন্স অব ডেনমার্ক ছাড়া যেমন হ্যামলেট হয়না তেমনি মারাদোনা ছাড়া কি বিশ্বকাপ হয়? হতে পারে? অনেক আশা ছিল হয়ত পাসাদেনার রোজ বোলে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনাকে মহাকাব্যিক সমরে মুখোমুখি হতে দেখব,ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেব গ্যালারিতে বসে তা চাক্ষুষ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ম্যান প্রোপোজেস্য গড ডিসপ্রোপোজেস। তবু ভাবলাম যাই, দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে মিটিয়ে আসি।

পাসাদেনায় আমাদের মোটেলের একতলার সব কয়টি ঘর আমরা পৌঁছনর আগেই ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের দখলে চলে গিয়েছে। ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল ডালাসে, বিজয়ী হওয়ার পরেই, ব্রাজিলিয়ানরা পিলপিল করে ঢুকতে শুরু করে লস এঞ্জেলেসে। ভৌগোলিক কারণে ব্রাজিলিয়ানদের কাছে একটা মস্ত সুবিধে হয়েছিল সেবার, মাত্র দু-আড়াই ঘন্টার বিমান পথ, টাইম জোনও মোটামুটি এক, সময়ের প্রশ্নে ব্রাজিল লস এঞ্জেলেসের চেয়ে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা এগিয়ে। ফুটবল পাগল ব্রাজিলিয়ানরা কী আর এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে? সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে যারা হাজারে হাজারে বিশ্বকাপের আসরে হাজির হয় পাশের পাড়ায় খেলা হলে তারা কী করতে পারে তার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

প্রথম দিন এমন বিচ্ছিরি জেট ল্যাগ হোল মোটেলের ঘর ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করেনি। পাক্কা সাড়ে বারো ঘন্টার ব্যবধান, বায়োলজিকাল ক্লকটা সম্পূর্ণ উল্টে যায়। ইউরোপের কোথাও একটা দিন হল্ট করে গেলে আমেরিকায় যাওয়ার জেটল্যাগ তবু কিছুটা কম হয়, আমাদের হাতে তার জন্য না ছিল সময়, না তেমন বিলাসিতা করার রেস্তোঁ। আমরা সোজা ব্রিটিশ এয়ারের বিমানে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে লন্ডন, তার ঘন্টা খানেকের মধযে আবার প্লেনে উঠে লস এঞ্জেলেস। ঘুমের ওষুধ খেয়ে চোখ দু’টো বোজার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। নীচের তলায় অসভ্য ব্রাজিলিয়ানগুলো এমন চেঁচামিচি করছে, ব্যান্ড বাজাচ্ছে যে কাকপক্ষীও ধারেকাছে বসবেনা। একবার ভাবলাম প্রিয়দার ঘরে ফোন করে বলি হোটেলের ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন করুক। পরক্ষণেই মনে হোল তা কী করে হয়, ওরা যুগলে এসেছে খেলা দেখার সঙ্গে বিয়ের পরের হানিমুনটাও সেরে নিতে। এমন মধু যামিনীতে কেউ কাবাবমে হাড্ডি হয়! আমি কি এতটা হৃদয়হীন হতে পারি?

পরের দিন সকালে কাগজ কিনে কফি-শপে যাওয়ার আগে একবার নীচের তলাটা পরিক্রমা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রতিটি ঘরের জানালায় পতপত করে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে, এক একটা ঘরে কম করে দশ বারোজন মাথা গুঁজে আছে, কলকাতায় আমার পুরোনো পাড়ার বস্তিতে বিহারি রিকশওয়ালাদের যেভাবে জমাট বেঁধে থাকতে দেখতাম, এক্কেবারে সেই রকম। কে নেই সেই জমায়েতে, দুধের শিশু থেকে বিরাশির বুড়ি, সব বয়সের, সব লিঙ্গের সবাই। ব্রাজিলিয়ান মেয়েরা অনেকেই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দরী, তদোপরি জামা-কাপড় পরে শরীর ঢাকা দেওয়ায় বিশ্বাস করেনা, অর্ধ-অনাবৃত উদ্ধত সব বুকের মিছিল। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে চরিত্র খারাপ হয়ে যেতে পারে, মেয়েগুলো আমায় লোচ্চা ভাবতে পারে, এই সব ভেবে আমি জোরে পা চালাতে শুরু করলাম।

কফি শপে ঢুকে দেখি সব কয়টা টেবিল ব্রাজিলিয়নরা অত সকালেই কব্জা করে নিয়েছে, চতুর্দিকে অবোধ্য পর্তুগিজ ভাষায় উচ্চকিত কোলাহল, মনে হোল যেন হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ঢুকে পড়েছি।এত স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছলতা, এমন হৃদয়ে মোচড় দেওয়া নারী শরীরের বিভঙ্গ, এমন তুরীয় মেজাজ তার আগে আমি কোনও জাতের মধ্যে দেখিনি। পথের পাঁচালির অপু হয়ে কিছুক্ষণ দরজার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকার পরে চোখে পড়ল একটা টেবিলের সামনে একটা চেয়ার খালি আছে, চোরের মতো মুখ করে গুটি গুটি পায়ে সেখানে এসে বললাম ‘ওব্রিগাদো’, আমার জানা একমাত্র পর্তুগিজ শব্দ। ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলাম ফাঁকা চেয়ারটিতে আমি নিজের পশ্চাদ্দেশ ঠেকাতে পারি কিনা। টেবিলে বসে থাকা একটি বাচ্চা মেয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, ‘ ইয়েস, ইয়েস, মোস্ট ওয়েলকাম।’

ওই একটি ইংরেজি বাক্য আমাকে চাঙ্গা করে দিল। দেখলাম মেয়েটির পাশে বসা দঙ্গলে সবাই পর্তুগিজেই কথা বলছে, আমি বিন্দু বিসর্গ বুঝতে না পেরে ক্যালানে মদনের মতো বসে আছি। আমার অস্বস্তি আঁচ করতে পেরে সেই মেয়েটি ইংরেজিতে খেজুরে শুরু করল, আগে নিজের পরিয় দিয়ে বলল সে লস এঞ্জেলেসই কাজ করে, তাই ইংরেজিতে সড়গড়। এবার আমাকে প্রশ্ন, কী নাম, কোথা থেকে এসেছি, ভারতে ফুটবল খেলা হয় কিনা, কেন ভারতকে বিশ্বকাপে দেখা যায়না, তাহলে অন্য দেশের খেলা দেখতে আমি কেন এত দূরে বয়ে এসেছি, ইত্যাদি ও ইত্যাদি। লজ্জায় মাথা হেঁট করে যা সত্য সেটাই বললাম। টেবিলে কেউ তা শুনে সমব্যথী হচ্ছে বলে মনে হোলনা।

আমার ইস্টবেঙ্গলি বুদ্ধি বলল, এবার কাউন্টার অ্যাটাকে যাও। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আমি জানতে চাইলাম,’ আর ইউ পিপল স্যাড ফর মারাদোনা? আফটার অল হি ইজ দ্য গ্রেটেস্ট।’

তপ্ত কড়াইয়ে দু’ছিপি তেল পড়ল যেন। সমস্বরে টেবিলের সবাই যা বলল তার মোদ্দা কথা, মারাদানো বড় প্লেয়ারই নয়, তদোপরি অসৎ, ব্রাজিলের পেলের পাশে সে দুগ্ধপোষ্য শিশু। ভীমরুলের চাকে ঢিলটা মেরে মিচকি মিচিকি হাসতে হাসতে আমি এবার উপভোগ করা শুরু করলাম ওদের উত্তেজিত সান্নিধ্য! (চলবে)

- Advertisement -

More articles

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article