সুমন চট্টোপাধ্যায়
সাকুল্যে দিন সাতেকের সফর, দেখব তিনটি ম্যাচ, একই স্টেডিয়ামে। একটা সেমিফাইনাল, থার্ড-ফোর্থ নির্বাচনের ম্যাচ, সবশেষে ফাইনাল। তিনটি ম্যাচই হবে লস এঞ্জেলেসের শহরতলি পাসাডেনায় রোজ বোল স্টেডিয়ামে। নির্ঝঞ্ঝাট পরিকল্পনা, এক জায়গায় বসে থাক, নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু।
মার্কিনদের নিজস্ব এক ধরণের ফুটবল খেলা আছে, খুবই জনপ্রিয়, কানাডাতেও খেলা হয়। খেলা তো নয় সাক্ষাৎ যুদ্ধ, খেলোয়াড়ের মাথায় হেলমেট, দুপায়ে প্যাড, থাই প্যাড, এলবো প্যাড, শরীরের একটি অংশও বোধহয় অরক্ষিত নয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এরা বুঝি এক্ষুনি কোনও মহাকাশযানে উঠতে চলেছে। এ খেলাতেও দুই দলে এগারোজন প্লেয়ার থাকে, একটা বলও থাকে, তবে পায়ের বদলে হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষের গোলের দিকে বুনো বাইসনের মতো দৌড়তে হয়। বাকি পৃথিবী সম্পর্কে স্বভাব উদাসীন আম মার্কিনি তখনও সেভাবে জানতইনা আরও এক ধরণের ফুটবল খেলা আছে যা ওই ঢপের গিরদিওনের (আমেরিকান ফুটবলের পোশাকি নাম) চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়, অনেক বেশি উত্তেজক এবং যাকে ঘিরে পৃথিবী মাতাল।
ফিফা তবু আমেরিকাকে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছিল, কাতারকে নিয়ে যত বিতর্ক, কেচ্ছা আর জলঘোলা হচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও হয়নি তখন। কারণ? দেশটির নাম আমেরিকা, খেলাধুলোর পরিকাঠামোতেও যারা বিশ্বে এক নম্বর। সেখানে সমস্যা প্রাচুর্যের, দেশজুড়ে এত অসংখ্য আধুনিক স্টেডিয়াম যে কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখব সেই নির্বাচনটিই ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত আট নয়টি শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল বিশ্বকাপের আসর, একটি শহর থেকে আর একটি শহরের দূরত্ব কখনও আড়াই হাজার, কখনও আবার তিন হাজার মাইল, আকাশপথে চার-চারটি টাইমজোন পার করতে হয়। আমরা গিয়েছিলাম কাপের অন্তিম পর্বে, প্রিয়দা অনেক ভেবে চিন্তে লস এঞ্জেলেসকেই গন্তব্য হিসাবে স্থির করেছিল। সঠিক নির্বাচন।
এই ধরুন পাসাডেনার রোজ বোল স্টেডিয়ামের কথাই। আদতে এটি কলেজ স্টেডিয়াম বলেই পরিচিত, তাতেই লোক ধরে প্রায় তিরানব্বই হাজার। এতৎসত্ত্বেও আকারে প্রকারে আমেরিকায় রোজ বোলের চেয়েও বড় অন্তত দশটি স্টেডিয়াম আছে। বিশ্বকাপ আসার আগে পর্যন্ত এই মাঠের পরিচিতি ছিল আমেরিকান ফুটবলের জন্যই। তারপর থেকে অলিম্পিকের ফুটবল ফাইনাল, মহিলা ফুটবলের বিশ্বকাপের ফাইনাল সহ অনেক বড় টুর্নামেন্টের খেলা এখানে হয়েছে, এখনও হয়ে যাচ্ছে। খুবই পুরোনো স্টেডিয়াম, এ বছর তার শতবর্ষপূর্তি হচ্ছে, তবু নির্মান সৌকর্য, প্রযুক্তি, তত্ত্বাবধান চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর।
সে বছরই কয়েক মাস আগে প্রিয়দার বিয়ে হয়েছে দীপার সঙ্গে, রীতিমতো প্রেম করে। লাজুক এবং দীর্ঘকাল অকৃতদার থাকা প্রিয়দা তার আগে পর্যন্ত সামনে কোনও মেয়ে এসে দাঁড়ালে মুখ তুলে কথাই বলতে পারতোনা, তা নিয়ে আমি ওর পিছনে লাগতাম ক্রমাগত ।সেই প্রিয়দা হঠাৎ বদলে গেল ‘আগুনের পাখি’ নাটকে দীপার অভিনয় দেখে, তার ভিতরের সুপ্ত প্রেমের আগ্নেয়গিরির মুখটাও খুলে গেল। আমি তখন দিল্লিতে থাকি, লক্ষ্য করতাম কথা একটুদূর এগোলে অনিবার্যভাবে প্রিয়দা প্রেমের প্রসঙ্গ টেনে আনে, বুঝতে পারতাম কেস জনডিস, যাকে বলে এক্কেবারে হেড ওভার হিলস। বিশ্বাস করে তখন প্রিয়দা সব ব্যক্তিগত গোপন কথা আমাকে বলত, ওর বিয়ের রেজিস্ট্রিতে বরপক্ষের হয়ে প্রিয়দার মা ছাড়া দ্বিতীয় সাক্ষরকারী ছিলাম আমিই। আজ পর্যন্ত সেই বিশ্বাস আমি ভঙ্গ করিনি, চিতায় ওঠা পর্যন্ত করবওনা।
প্রিয়রঞ্জন তখন এ আই এফ এফের সভাপতি কিন্তু এম পি নয়। চুরাশির লোকসভা ভোটে লোককে অবিশ্বাস্য সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাওড়া কেন্দ্র থেকে জয়ী হওয়ার পরে সেখান থেকে পরের দু’টি নির্বাচনে (১৯৮৯ এবং ১৯৯১) ভোটাররা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপের সময় রাজনীতিতে প্রিয়দা কিছুটা ব্যাকফুটে, ফিফাতেও তেমন পরিচিতি গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে আমার মতো দেবা-দেবীও বিমানে ইকনমি ক্লাসের টিকিট কেটেছিল, লস এঞ্জেলেসের কোনও পঞ্চতারকা হোটেলের কথা না ভেবে পাসাডেনায় একেবারে স্টেডিয়ামের লাগোয়া একটি আটপৌরে মোটেলে ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের থাকার। মামুলি ঘর, পায়ের তলায় সেঁদো কার্পেট, কেবল ইদুর-ছুঁচোর উৎপাত নেই এই যা। দক্ষিণাও প্রতিদিনের জন্য মাত্র ষাট ডলার। জীবনে ওই একবারই প্রিয়দাকে নেমে আসতে হয়েছিল আমার মতো সাধারণ কলমচির পংক্তিতে। তার চার বছর পরে ফ্রান্সের বিশ্বকাপে দেখেছি প্রিয়দা একেবারে যেন রয়ালটি, ফিফার ম্যাচ কমিশনার, একেবারে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। অবশ্য থাক সে প্রসঙ্গ।
পরের দিনই খুঁজে খুঁজে আমাদের মোটেলে এসে হাজির আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তখন সহকর্মী মানস চক্রবর্তী। পকেটে যৎসামান্য ডলার, মাথা গোঁজার আস্তানা নেই। জন্মগত অধিকার মনে করে মানস ঢুকে পড়ল আমার ঘরে, তারপর এমন হাবভাব শুরু করল যেন ওই ঘরের মালিক, আমি অতিথি। ফুটবলের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া সে, হাতির মতো স্মৃতিশক্তি, চেহারাটাও ঐরাবত সুলভ। মানস মানেই মজা, বিনোদন, গপ্পো আর কেচ্ছার সুস্বাদু ককটেল। হঠাৎ হঠাৎ উফ কী গরম বলে মানস জামা, প্যান্ট, গেঞ্জি সব কিছু খুলে কেবল জাঙ্গিয়া পরে ঘরে দাপিয়ে বেড়াত। সোয়া ছ’ফুট লম্বা চেহারা, নয় মাসের গর্ভবতীর মতো ভুঁড়ি আর সারাক্ষণ শুধু বকবক আর বরবক। আমরা সাংবাদিক। মানস চরিত্র।
ঘুম থেকে উঠে আমার প্রথম কাজটি ছিল নীচে গিয়ে কিওস্কে পয়সা ঢেলে লস এঞ্জেলেস টাইমসের একটা কপি কিনে আনা। বড্ড কঠিন ইংরেজি বলে মানস সেটি ছুঁয়েও দেখতনা, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম অভ্যাসবশত, মার্কিন মিডিয়া কীভাবে ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করছে তা নিয়ে আমার স্বাভাবিক কৌতুহল ছিল। সেটা কম্পিউটার- ইন্টারনেট- মোবাইল ফোনের অনেক আগের যুগ,গুগল জ্যাঠার পিঠে চড়ে এক ক্লিকে দুনিয়াটা সামনের স্ক্রিনে ভাসবে, তেমন অনায়াস বিলাসিতার জো ছিলনা।
প্রথম দিন এল এ টাইমসের প্রথম পাতা খুলে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলামনা। প্রথম পাতার লিড স্টোরিটা হচ্ছে ফুটবল খেলাটা কী, কী তার নিয়ম কানুন, কারা খেলে, কারা ভাল খেলে তার একটা প্রাইমার, কিছুই না জানা একটি খেলা সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করাই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। লম্বা স্টোরি, পুরোটা মন দিয়ে পড়েই আমি লিখতে বসে গেলাম, আমার প্রথম কালার স্টোরি।
মার্কিন কাগজ এখন ফুটবল শেখানোর পাঠশালা। (চলবে)
এতো ঝরঝরে, প্রাঞ্জল বর্ণনা, মাঝে মাঝে দু একটি সরস মন্তব্যের চুষিকাঠি গুঁজে দেওয়া, একটা ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার যে ব্যঞ্জনাময় অভিজ্ঞতা আপনার বলিষ্ঠ লেখনীতে পেয়ে চলেছি, তার জন্য অশেষ সশ্রদ্ধ ধন্যবাদ।