logo

কেন লং কোভিডের শিকার মহিলারা?

  • August 16th, 2022
Health World

কেন লং কোভিডের শিকার মহিলারা?

নিজস্ব প্রতিবেদন: লং কোভিড। গত দেড় বছরে আমাদের দৈনন্দিন অভিধানের অংশ হয়ে ওঠা শব্দগুলোর অন্যতম। সমীক্ষা বলছে, মহিলারাই এর শিকার হচ্ছেন বেশি। কিন্তু কেন? কারণ খোঁজার চেষ্টা যেমন চলছে, সমান্তরাল ভাবে চলছে ‘মহিলাসুলভ বাড়াবাড়ি’ বা ‘বাতিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও। এই একুশ শতকেও লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতের বাইরে যেতে ব্যর্থ জনস্বাস্থ্য গবেষণা।

লং কোভিড, অর্থাৎ করোনা সংক্রমণ সেরে যাওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় ধরে চলা নানা শারীরিক সমস্যার বিষয়টি চিকিৎসকদের নজরে প্রথম আসে গত বছরের মাঝামাঝি। তখনও পর্যন্ত ভাইরাসের প্রকৃতি, মানব শরীরে তার গতিবিধি, সবই ধোঁয়াটে কিছু ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু ২০২০ সালের জুন মাস নাগাদ যে বিষয়টা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল, তা হল লিঙ্গভেদে এই ভাইরাসের প্রভাবের হেরফের। একদিকে মারাত্মক উপসর্গ যাঁদের দেখা দিচ্ছে, তাঁদের বেশিরভাগই পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ। অন্য দিকে লং কোভিডে আক্রান্তদের বেশিরভাগ মহিলা এবং বয়স পঞ্চাশের নীচে। প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লং কোভিডে মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার হার পুরুষদের তুলনায় প্রায় চারগুণ ছিল। গত এক বছর ধরে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে দেখলেও হিসেবটা খুব একটা বদলায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যাপারটা কোভিডের ক্ষেত্রে একচেটিয়া নয়। অন্যান্য কিছু রোগের ক্ষেত্রেও সংক্রমণ পরবর্তী জটিলতায় মহিলাদেরই বেশি ভুগতে দেখা গিয়েছে। যেমন ক্রনিক লাইম ডিজিস। এই ধরনের সংক্রমণ পরবর্তী জটিলতার মধ্যে অন্যতম ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম বা দীর্ঘস্থায়ী, চরম ক্লান্তি। কোভিড পরবর্তী দিনগুলোয় অনেকের ক্ষেত্রে এই ক্লান্তি এমন পর্যায়ে যাচ্ছে যে, তাঁদের স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু কোভিড নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি এখনও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বরং ইতিউতি শোনা যাচ্ছে, কোভিড থেকে সেরে ওঠা কোনও মহিলা রোগী ক্লান্তি বা গায়ে ব্যথা জাতীয় উপসর্গ নিয়ে এলে তাঁদের পাত্তাই দিচ্ছেন না চিকিৎসকদের একাংশ। ‘মানসিক সমস্যা’ বা ‘উদ্বেগ’ বলে বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লং আইল্যান্ড স্কুল অফ মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক জুলি নুসবাওমের মতে, যে সব সমস্যায় মূলত মহিলারাই আক্রান্ত হন, তা নিয়ে গবেষণায় এখনও যথেষ্ট অনীহা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। এই ধরনের বিষয়গুলি না তেমন গুরুত্ব পায়, আর না এমন গবেষণায় কেউ সহজে টাকা ঢালতে রাজি হন। বিশেষ করে ব্যথা বেদনার উপসর্গ যেখানে প্রধান। গা-হাত-পায়ে ব্যথার মতো সমস্যা নিয়ে কোনও মহিলা ডাক্তারের কাছে গেলে, ধরেই নেওয়া হয়, শারীরিক কোনও অসুবিধা নয়, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাই রোগের উৎস। কেউ কেউ তো খতিয়ে না দেখেই বিষয়টাকে সটান হাইপোকন্ড্রিয়া বা নিজের স্বাস্থ্য বিষয়ে অকারণ, অতিরিক্ত উদ্বেগ বলে চিহ্নিত করে ফেলেন।

বহু বছর ধরে চলে আসা এই প্রবণতা প্রভাব ফেলেছে লং কোভিড নিয়ে ভাবনা-চিন্তার ক্ষেত্রেও। জনা কয়েক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক, যাঁরা লিঙ্গভেদে কোভিডের প্রভাবের তারতম্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং তার গোড়ায় পৌঁছতে চেষ্টা করছেন, তাঁদের একজন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, ডক্টর জ্যানেট স্কট। বিশেষজ্ঞ মহলের অন্দরেও গোঁড়া মানসিকতা ও লিঙ্গ বৈষম্যের কথা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। স্কটের কথায়, ভাবখানা এমন, যেন লং কোভিড ব্যাপারটার একমাত্র ব্যাখ্যা ‘কিছু হিস্টিরিয়া-গ্রস্ত মধ্যবয়সী মহিলা’। সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে গিয়ে স্কট এবং তাঁর মতো আরও কেউ কেউ লং কোভিডে মহিলাদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ খুঁজে চলেছেন।

পুরুষ এবং মহিলাদের শরীরে সার্স-কোভ-টু ঠিক কী কী প্রভাব ফেলে, তা নিয়েই গত এক বছর ধরে গবেষণা করছেন কানেকটিকাটের ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের রোগ-প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আকিকো ইওয়াসাকি। তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জরুরি টি-কোষগুলি মহিলাদের দেহে অনেক বেশি সক্রিয়। এই কোষগুলির কাজ ভাইরাস আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা। এই বাড়তি সক্রিয়তার কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে জিনে। মহিলাদের দেহকোষে দু’টি এক্স ক্রোমোজোম থাকে। আর রোগ প্রতিরোধের জন্য যে জিনগুলি দায়ী, তার বেশিরভাগই পাওয়া যায় এই এক্স ক্রোমোজোমে।

আবার টি-কোষের বাড়তি সক্রিয়তার জন্য ‘প্রেগন্যান্সি কম্পেনসেশন হাইপোথিসিস’ও দায়ী হতে পারে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সন্তান ধারণে সক্ষম বয়সে মহিলাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধে বাড়তি সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। গর্ভবতী অবস্থায় সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা যেহেতু বেড়ে যায়, তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই কারণেই কোভিডে মহিলাদের মৃত্যুহার পুরুষদের তুলনায় কম। কিন্তু এর একটা উল্টোদিকও রয়েছে। করোনা সেরে যাওয়ার পরও কিছু ভাইরাস দেহের নানা জায়গায় ঘাপটি মেরে থেকে যায় বেশ কিছুদিন। সেই লুকোনো ভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ফলে রোগ সারার পরেও ব্যথা, ক্লান্তির মতো সমস্যা বহুদিন ধরে চলতে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে বেশ কয়েক মাস।

লং কোভিডের এটাই অবশ্য একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। উঠে এসেছে অটোইমিউন ডিজিসের তত্ত্বও। এ ক্ষেত্রে দেহে রোগ প্রতিরোধের জন্য তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলো সুস্থ কোষকেও আক্রমণ করে বসে। ইতিমধ্যেই কোভিড রোগীদের দেহে একশোরও বেশি ধরনের অটো-অ্যান্টিবডির হদিস মিলেছে। রক্তনালীর আস্তরণ থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক―যে কোনও জায়গায় হানা দিতে পারে এই অটো-অ্যান্টিবডি। সময়ের সঙ্গে এর মধ্যে কোনও কোনও অটো-অ্যান্টিবডির সংখ্যা কমে গেলেও বাকিগুলি কয়েক মাস পর্যন্ত টিকে থাকছে। ফলে গায়ে ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, বুক ধড়ফড় করার মতো সমস্যা পিছু ছাড়ছে না।

মহিলাদের মধ্যে অটোইমিউন ডিজিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এমনিতেই বেশি। তার পিছনে রয়েছে ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারিকুরি, যা শরীরে যে কোনও প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন অটো-অ্যান্টিবডি প্রস্তুতকারী বি-কোষকে দাবিয়ে রাখে। তাই পুরুষদের অটোইমিউন ডিজিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইওয়াসকি মনে করেন এর মধ্যেই লিঙ্গভেদে লং কোভিডের তারতম্যের ব্যাখ্যা লুকিয়ে থাকতে পারে। কেউ কেউ এখনই লং কোভিডকে 'ইস্ট্রোজেন প্রসূত অটোইমিউন ডিজিস' বলে বর্ণনা করতে শুরু করেছেন। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। একবার এই লিঙ্গভেদে তারতম্যের ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে শুধু যে লং কোভিডের চিকিৎসা সহজ হবে, তা নয়। অন্য রোগের ক্ষেত্রেও সংক্রমণ পরবর্তী জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হতে পারে বলে আশা বিজ্ঞানীদের।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *