logo

অভিনেতা যখন নেতা

  • August 13th, 2022
News

অভিনেতা যখন নেতা

অভিনেতা যখন নেতা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

হচ্ছেটা কী?

যা হচ্ছে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, সবাই দেখছে।

টালিগঞ্জের ছোট-বড় পর্দার কলাকুশলীরা প্রায় আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়ে যে যার পছন্দের দলের ঝান্ডা হাতে তুলেনিচ্ছেন। বাংলা মিডিয়া সেই খবরে ছয়লাপ, সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজিয়া আর কুকথার বন্যা। বাংলার ভোটের খাতায় এবার সবচেয়ে উত্তেজক পর্বটি দেখছি তারকা-হাফতারকা-মিনিতারকাদের ঘিরেই।

নাগরিক সমাজে আলোচনা, জল্পনা, উত্তেজনার সঙ্গত কারণ আছে। একসঙ্গে এত অভিনেতার নেতা হওয়ার গণ-আহ্লাদের আগে বাংলা কখনও দেখেছে কী? তার চেয়েও সঙ্গত প্রশ্ন, সব্বাই যদি পার্টি করা নিয়ে মত্ত হয়ে ওঠে তাহলে অভিনয়টা করবে কারা?

তত্ত্ব-তালাশ করলে এই মনোরঞ্জক প্রবণতার কারণগুলি হয়তো চিহ্নিত করা সম্ভব। আমি করব না, কারণ আমার কোনও ইন্টারেস্টই নেই। আমি শুধু এটুকু মানি, নেতা-অভিনেতার অবস্থান একই মুদ্রার দুই পিঠে। অভিনেতা পর্দায় অভিনয় করেন, নেতা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। দু’জনের লক্ষ্যই আসলে এক। মনোরঞ্জন। তবে অভিনয় করার স্বাভাবিক ক্ষমতা কার বেশি আছে, নেতা না অভিনেতার, তা নিয়ে কোনও বাংলা চ্যানেল ইচ্ছে করলে সাজানো জলসাঘরে খেলা-খেলা বিতর্কের আয়োজন করতেই পারে। করলে হাই টিআরপি গ্যারান্টিড।

এই বাংলায় দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল বামেদের। বাম-মনস্ক না হলে তিনি মনুষ্য পদবাচ্য হিসেবে গ্রাহ্যই হতেন না। তবে এঁদের অবস্থান ছিল দলীয় রাজনীতির আড়ালে, দলকে তাঁরা নিঃশর্ত সমর্থন দিতেন, দল আদেশ করলে না পড়েই যে কোনও স্মারকলিপিতে নিজের স্বাক্ষরটা ব্যবহার করতে দিতেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমরা সবাই জানতাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অথবা উৎপল দত্ত, অথবা মৃণাল সেন কোন দলকে সমর্থন করেন, তা নিয়ে এঁদের কোনও রাখঢাকও ছিল না। তবে এঁদের কেউ লাল-ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে ভোটের বাজারে মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন ছবি কেউ কখনও দেখেছেন কী?

কখনও-সখনও খুচরো ব্যতিক্রম একেবারেই হতো না, তা নয়। যেমন অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার বা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সিপিএম প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বিপরীত শিবিরের হয়ে একবার হঠাৎ মাধবী মুখোপাধ্যায় যাদবপুরে সোজা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে যান সাত-পাঁচ না ভেবেই। তাঁর কাছে পরে জানতে চেয়েছিলাম, এমন বোকামি করার সত্যিই কোনও দরকার ছিল কী? আপাদমস্তক ভালো মানুষ মাধবীদির অকপট উত্তর ছিল, ‘কী করব বলুন, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এসে এমন জোরাজুরি শুরু করলেন, আমি না বলতে পারলাম না।’ প্রথমবারেই শিক্ষা হয়ে যাওয়ায় মাধবীদি আর কখনও শখের মজদুরি করার হাতছানিতে সাড়া দেননি।

সময় বদলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-সংসারের ছবিটিও। এমন উদ্ভট, অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয়, সস্তার যাত্রাপালার প্রেক্ষাপটে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে, এক ধরনের আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়ে যায়। বিভ্রম হয়, চোখের সামনে যা দেখছি তা সত্যিই ঘটছে তো? মনে হয় যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনও গ্রহে ভুল করে চলে এসেছি, এখানে আমি নেহাতই আগন্তুক। বিস্ফারিত চোখে অবলোকন করার পরে নিভৃতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কোনও ভূমিকা নেই, থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ‘সব চলতা হ্যায় জি’, এটাই এখন বঙ্গ-সমাজের সিগনেচার টিউন।

সব চলতা হ্যায়। পয়সা ফেঁকো তামাশা দেখো!

নেতা-অভিনেতার নিকট সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরোনো, বহুচর্চিত, এখনও চর্চা হয়ে চলেছে নিরন্তর। বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর-দক্ষিণে এই সম্পর্কের মধ্যে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য আছে। সময়ের পরতে পরতে দক্ষিণে মেগাস্টারেরা হঠাৎ হঠাৎ রাজনীতিতে আসেন কিন্তু সচরাচর অন্যের দলে যোগ দিয়ে তার শোভা বৃদ্ধি করেন না। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের দল গঠন করে ময়দানে নামেন, অনেক সময় সব হিসেব-নিকেশ গুলিয়ে দিয়ে বিস্ময়কর ভাবে সফল হন। যেমন তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রন ডিএমকে থেকে বেরিয়ে এআইএডিএম-কে তৈরি করলেন, সব্বাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে টানা দশ বছর শাসন করলেন নিজের রাজ্য। তুলনায় কম সময়ের জন্য হলেও অন্ধ্রপ্রদেশে একই কাজ করেছিলেন নন্দমুড়িতারক রামা রাও, জন্ম হয়েছিল তেলুগু দেশম পার্টির। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে নিজের দল গড়েছেন কমল হাসান। একই কাজ করার জল্পনা বারেবারে উস্কে দিয়ে শেষ পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিয়েছেন রজনীকান্ত। দক্ষিণের তারকারা নিজেদের ভক্তকুলের নিঃশর্ত বশ্যতা সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে রাজনীতিটাও তাঁরা ওই মেগাস্টারের স্টাইলেই করে থাকেন, করতে পছন্দ করেন। পরগাছা না হয়ে তাঁরা নিজেরাই বটবৃক্ষ হতে চান।

কাট টু মুম্বই অথবা কলকাতা। গত অর্ধ-শতকে বলিউড-টলিউডের অজস্র অভিনেতা দলীয় রাজনীতিতে এসেছেন, ভোটে লড়েছেন, জিতেছেন কিংবা হেরেছেন, একজনও কিন্তু নিজের দল গড়ার হিম্মত দেখাননি। তাঁরা সবাই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও প্রশ্রয়েই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন। মহারাষ্ট্রে নিজের দল গড়ে রাজ্য-রাজনীতির যাবতীয় সমীকরণ যিনি বদলে দিতে পেরেছিলেন, তিনি অভিনেতা নন, স্বল্পখ্যাত একজন কার্টুনিস্ট। দুনিয়া তাঁকে চেনে বালাসাহেব ঠাকরে নামে।

আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে অভিনেতার নেতা বনে যাওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক দেখেছি, উত্তরে এবং দক্ষিণে। ১৯৮৫ সালে আমি বদলি হয়ে দিল্লিতে যাই, দেশ তখন রাজীব-ময়। যুবা প্রধানমন্ত্রী তখন ভারতীয় রাজনীতির পিটার প্যান, তাঁর নেতৃত্বে লোকসভায় কংগ্রেস এত আসনে জিতেছে (৫৪২টি আসনের মধ্যে ৪১২) যা জওহরলাল নেহরুর জীবদ্দশাতেও কখনও সম্ভব হয়নি। সংসদের অন্দরে রাজীব গান্ধীর চেয়েও সকলের বেশি কৌতুহল আর একজনকে নিয়ে, মাথায় সবার চেয়ে উঁচু, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা, অতিশয় গম্ভীর মুখ। মিডিয়া তাঁকে সর্বক্ষণ নজরবন্দি করে রাখে, লোকসভা কক্ষের বাইরে দেখতে পেলে তাঁকে ছেঁকে ধরে, তিনি যাই করুন, নমস্কার অথবা সৌজন্য বিনিময়, বাধ্য ছাত্রের মতো লোকসভায় নিজের আসনে সোজা হয়ে বসে থাকা, সেটাই খবর।

অমিতাভ বচ্চন। ভোটের ময়দানে আবাল্য-সুহৃদ অমিতাভকে নিয়ে আসা ছিল রাজীব গান্ধীর মাস্টার-স্ট্রোক। এলাহাবাদ কেন্দ্রে ডাকসাইটে বিরোধী নেতা হেমবতী নন্দন বহুগুণাকে প্রচুর ভোটে হারিয়ে বচ্চন লোকসভায় এসেছিলেন। ৯ নম্বর মতিলাল নেহরু মার্গ ছিল তাঁর ঠিকানা। আনন্দবাজারের সৌজন্যে দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত মহল্লা গুলমোহর পার্কে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম আমি। তার একটু দূরেই ছিল হরিবংশ রাই বচ্চনের বাড়ি, অমিতাভের মা তেজি বচ্চন সেখানেই থাকতেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে অমিতাভ আসতেন আমাদের পাড়ায়, দিল্লি পুলিশের বাড়-বাড়ন্ত দেখে সেটা টের পাওয়া যেত। ওই বাড়ির ঠিক পিছনের গলিতে একটি সুদৃশ্য, প্রাসাদোপম তিনতলা বাড়ি ছিল যেটা সারা বছর তালাবন্ধ হয়েই পড়ে থাকতো। পাড়ার লোকে মস্করা করে বলতো, ওই বাড়িটির মালকিন রেখা ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।

গান্ধী-পরিবারের সঙ্গে বচ্চন পরিবারের গভীর বন্ধুত্বের কথা সুবিদিত। বিয়ের আগে দিল্লিতে পৌঁছে সনিয়া তেজি বচ্চনের কাছেই উঠেছিলেন। সনিয়া জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকারটিও দিয়েছিলেন অমিতাভের মায়ের নির্দেশেই, হিন্দি ধর্মযুগ পত্রিকায়। রাজনীতিতে আসার পরে রাজীব-অমিতাভকে দেখে মনে হতো যেন মানিক-জোড়, পরস্পরের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত তো ছিলই, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বলয়ে অমিতাভের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। বছরের শেষে কয়েকটা দিন রাজীব ছুটি কাটাতে যেতেন সপরিবার, সঙ্গীদের মধ্যে অমিতাভ-জয়া থাকবেনই। তখনও সুইডিশ রেডিও বফর্স কেলেঙ্কারির কথা দুনিয়াকে জানায়নি, বফর্স যে একটি কামানের নাম প্রতিরক্ষা-বলয়ের বাইরে কেউ সে কথা জানতই না।

বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশজোড়া হই-চইয়ের মধ্যে সবার চোখের অন্তরালে গান্ধী-বচ্চন পরিবারের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করেছিল, অমিতাভ লোকসভা থেকে মাঝপথে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। সেই ফাটল আর জোড়া লাগেনি, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একদিন দুই পরিবারের মুখ দেখা দেখিই বন্ধ হয়ে গেল। রাজীব-অমিতাভর বিচ্ছেদ এখনও পর্যন্ত রহস্যে-মোড়া এক গোপন অধ্যায় যা নিয়ে দু’পক্ষের কেউই আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি, খবরের কারবারিরাও ব্যর্থ হয়েছে এই রহস্য-ভেদে। সাংবাদিকের প্ররোচনায় পা দিয়ে অমিতাভ এ নিয়ে একবারই কেবল প্রকাশ্যে একটি শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওহ হ্যায় রাজা ঔর হাম হ্যায় রংগ।’ প্রজা কখনও রাজার বন্ধু হতে পারে কী?

তারপর অমিতাভ আর রাজনীতির ছায়াও মাড়াননি। জয়া বচ্চন ময়দান ছাড়েননি। কংগ্রেসের সঙ্গ ত্যাগ করার পরে বচ্চন পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে উত্তরপ্রদেশের যাদব কুলোপতি মুলায়ম সিংয়ের সঙ্গে। উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করেছিলেন সদ্য প্রয়াত এবং অতিমাত্রায় বিতর্কিত অমর সিংহ। কলকাতার বড়বাজারের ছেলে, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অনুগামী হিসেবে ছাত্র পরিষদে তার রাজনীতিতে হাতে খড়ি। সেই বড়বাজারের অমর দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়ে কী ভাবে ধীরে ধীরে ধনকুবের হয়ে উঠল, রাজধানীর চরম প্রভাবশালী পাওয়ার ব্রোকারদের মধ্যে তাঁর নামটি কী ভাবে শিরোণামে চলে এল, সেই ইতিহাসও যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। বফর্সের ঝড়ের ঝাপটা কাটিয়ে ওঠার আগেই অমিতাভ চরম সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কোম্পানি এ বি সি এলে লালবাতি জ্বলে যাওয়ায়। সেই চরম সঙ্কটের সময় অমরই তাঁর একমাত্র মুশকিলআসান ছিলেন, ক্ষুরধার ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর ব্যবসায়ী মহলে অবিশ্বাস্য প্রভাবের সুবাদে অমর প্রায় হাত ধরে অমিতাভকে সঙ্কট থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। তারপরে অমর সমাজবাদী পার্টি ত্যাগ করেন, বচ্চন পরিবারের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বাড়তে এক সময় প্রায় বৈরীতায় পর্যবসিত হয়। আমি অমরকে ছেলেবেলা থেকে চিনতাম, দিল্লি যাওয়ার পরে গোড়ার দিকে আমার নিত্য ওঠ-বোস হতো, খবর সংগ্রহের কাজে আমাকে তিনি অকৃপণ হাতে সাহায্যও করেছেন। দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে সোয়া দু’বছর আগে কলকাতায় একটি আলোচনা সভায় বক্তার তালিকায় আমরা দু’জনেই ছিলাম। দেখলাম কিডনির অসুখে জেরবার অমরের কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে, অনুষ্ঠানের আগে-পরে চায়ের আড্ডায় অনেক ব্যক্তিগত কথাও হল ওর সঙ্গে। বচ্চন পরিবারের সঙ্গে ওর মধুর সম্পর্ক ভাঙল কেন জানতে চাইলে অমর কাঠগড়ায় তুললেন জয়া বচ্চনকে। ‘বুঝলে না এই ভদ্রমহিলাই বচ্চন পরিবারে সব সর্বনাশের মূলে। ফর অমিতজি শি ইজ এ বিগ লায়াবেলিটি।’

জয়া বচ্চন তবু মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন রাজ্যসভায়, সমাজবাদী পার্টির টিকিটে। সক্রিয় সদস্য, পছন্দের বিষয় হলেই বলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন, যা বলেন তাতে যুক্তি তো থাকেই, তার চয়েও বেশি থাকে আবেগ। একদিন পার্লামেন্টের একতলার করিডরে বিপরীত দিক থেকে অন্যমনস্ক হয়ে আসাতে আসতে সনিয়া আর জয়া প্রায় মুখোমুখি এসে পড়েন। পাছে পাবলিক প্লেসে অস্বস্তি আরও বাড়ে, মুখোমুখি হওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে দুই মহিলাই ফৌজি স্টাইলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। দু’জনেই যেন দু’জনের কাছে সমান অস্পৃশ্য! কোনও এক ইংরেজ কবি লিখেছিলেন না, ‘ইভন হেল হ্যাথনো ফিউরি লাইক এ উওম্যান স্কর্নড!’

অমিতাভ বচ্চনের মাঝপথে বিদায় লোকসভার জৌলুস অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল যদিও কংগ্রেস শিবির তা সত্ত্বেও একেবারে তারকা-শূন্য হয়ে পড়েনি। ছিলেন সুনীল দত্ত, বৈজয়ন্তীমালা এবং রাজেশ খান্না। রাজেশের ঠোঁটে সর্বদা একচিলতে মিষ্টি হাসি লেগে থাকত, পারত পক্ষে তিনি মুখ খুলতেন না। মাঝে মাঝে সেন্ট্রাল হলে আসতেন সিগারেট খেতে, তাঁর উপস্থিতি সে ভাবে চিত্তে দোলা দিত না কারওরই। অথচ রাজেশ খান্নার নির্বাচনী সাফল্যের গুরুত্ব অমিতাভের চেয়ে একছটাকও কম ছিল না, দক্ষিণ দিল্লি কেন্দ্রে তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আজবাণীর মতো মহারথীকে। রাজেশ খান্নাকে দেখে আমার বেশ মায়া হতো, তারকা-জীবনের এক বেদনাতুর ট্র্যাজেডির তিনি ছিলেন স্মৃতিচিহ্নের মতো। যতক্ষণ মাঠে আছো ঠিক ততক্ষণই তোমার গুরু-জীবনের মেয়াদ, চোখের বাইরে চলে গিয়েছ মানে মনের বাইরেও চলে গেলে। অমিতাভ ঢ্যাঙা চেহারা নিয়ে বলিউড দাপানোর আগে রাজেশ খান্নাই ছিলেন অবিসম্বাদিত সুপারস্টার। ক্যামেরা-লাইট যেই সরে গেল, রাজেশ খান্নাও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করলেন। সংসদে না থেকেও তাই অমিতাভ নিয়মিত চর্চার কেন্দ্রস্থলে রয়ে গেলেন, আর রাজেশ খান্নার পাশে বসা সাংসদটিও তাঁকে সে ভাবে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না।

উত্তর-পূবের কথা অনেক হল, চলুন এ বার বিন্ধ্য পর্বত পেরোনো যাক। এম জি আর-এর মৃত্যুর পরে তাঁর শেষকৃত্য কভার করতে গোটা দেশ থেকে রিপোর্টারকুল চেন্নাইতে আছড়ে পড়েছিল, আমিও ছিলাম সেই ভিড়ে। সেদিন মেরিনা বিচে আমি যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তার কথা ভাবলে এত বছর পরেও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। একসঙ্গে এত মানুষের উদ্বেল শোক প্রকাশ আমি কোথাও দেখিনি। দু’টো ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড জুড়ে কোনও জনসভা হলে যত লোক হবে মেরিনা বিচে সেদিন তার চেয়েও বেশি লোক জমায়েত হয়েছিল, তামিলনাড়ুর প্রতিটি কোনা থেকে, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে কান্নার রোল, গণ-শোকে বিহ্বল সেই সমুদ্র সমান জনতা। হঠাৎই আমাদের চোখের সামনে দুই মহিলা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন, কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এল না, সমুদ্রের হাওয়ায় জোর পেয়ে আগুনের লেলিহান শিখা মহিলাদের শরীরের উপর যেন তাণ্ডব শুরু করে দিল। আমার পক্ষে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না, ভিড় ঠেলে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম, সারা শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাব। তারপর কয়েক রাত ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমাকে ঘুমোতে দেয়নি। পরের দিন কাগজে পড়েছিলাম এম জি আর-এর শোক সহ্য করতে না পেরে গোটা রাজ্যে ৫৫ জন আত্মাহুতি দিয়েছেন।

তামিল ভক্তেরা এম জি আরকে বলতেন, ‘পুরৎচি থালাইভার’, বাংলা করলে হবে বিপ্লবী নায়ক। কেননা সিনেমায় সব চরিত্রেই তাঁকে দেখা যেত দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করতে। রাজনীতিতে আসার পরেও তাঁর সেই জনপ্রিয় ভাবমূর্তি এতটুকু টাল খায়নি, উত্তরোত্তর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। অভিনয়ের জগৎ থেকে রাজনীতিতে এসে এম জি আর নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তী। জীবনের শেষ নির্বাচনটিতে এম জি আর প্রচারই করতে পারেননি, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ফল বের হলে দেখা গেল, তাঁর অনুপস্থিতিতে ভোট বেড়ে গিয়েছে দলের, আসন সংখ্যাও বেড়েছে। থালাইভার কোথায় আছেন, বাড়িতে না হাসপাতালে, ভক্তদের তা নিয়ে কোনও মাথা ব্যথাই ছিল না। আছেন যে সেটাই যথেষ্ট, থাকলে তিনিই জিতবেন।

এই বিস্ময়কর জাদুকরের জনপ্রিয়তা কেমন ছিল জানেন? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। বক্তৃতার মঞ্চে এম জি আর-এর সামনে পোডিয়ামের ওপর একটি ঠান্ডা পানীয়ের বোতল রাখা থাকত, কথা বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেলে তা থেকে তিনি দু-এক ঢোক পান করতেন। বাকিটা বোতলে পড়ে থাকত। সভা শেষ হয়ে গেলে আয়োজকেরা জল-ভর্তি একটি ড্রামের ভিতর অবশিষ্ট পানীয়টি ঢেলে দিয়ে চরণামৃতের মতো তা বিলি করতেন ভক্তদের মধ্যে। একটি জলের ফোঁটা মাথায় ছোঁয়ানোর হাজার হাজার মানুষের লম্বা লাইন পড়ে যেত চোখের নিমেষে।

দ্বিতীয় গপ্পোটি শুনেছিলাম তুঘলক পত্রিকার দাপুটে সম্পাদক চো রামস্বামীর মুখে। সেটি এই রকম।

দ্বিতীয় গপ্পোটি শুনেছিলাম তুঘলক পত্রিকার দাপুটে সম্পাদক চো রামস্বামীর মুখে। সেটি এই রকম।

নেতা-নেত্রীদের পর্বত-প্রমাণ কাট-আউট তৈরির জন্য তামিলনাড়ু এমনিতেই বিখ্যাত। এম জি আর এর জীবদ্দশায় তাঁর কাট-আউট বানিয়ে সংসার চলত গ্রামাঞ্চলে অনেক মানুষের। বিশেষ করে নিঃসন্তান মহিলারা কাট-আউট ভাড়া করতেন একটি বিশেষ মনস্কামনা চরিতার্থ করতে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এম জি আর-এর কাট-আউট মেঝেতে পেতে এক রাত তার ওপর শুয়ে থাকতে পারলে পুত্র-লাভ সুনিশ্চিত। ফলে রমরম করে চলত থালাইভারের কাট-আউটের বাজার।

একবার কোনও একটি গ্রামে এমনই সন্তানকামী এক রমণী একটি কাট-আউট ভাড়া করেছিলেন এক রাতের জন্য। পরের দিন সকালে দোকানে এসে তিনি বলেন, আরও এক রাত কাট-আউটটি তিনি নিজের কাছে রাখতে চান। অন্য এক গ্রামের মহিলা সে দিনের জন্য অগ্রিম দিয়ে কাট-আউট বুক করে রেখেছিলেন, সকাল থেকে তিনিও সেই দোকানে অপেক্ষা করছিলেন। আগের মহিলা কাট আউট দেবেন না শুনে দ্বিতীয়জন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তীব্র বাদানুবাদের পরে দু’জনের মারপিঠ শুরু হয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়ায় ওই দুই মহিলার পরিবার দৌড়ে আসে দোকানের সামনে। এবার তাদের মধ্যে মারপিঠ আরম্ভ হয়। সবশেষে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে দুই মহিলার দুই গ্রামের মানুষ। রীতিমতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ আসে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা শূন্যে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়।

এর পরে উড়ু-কাতু-মদনা অথবা খেঁদি-পেঁচি-নূরজাহানদের কথা শোনার কোনও অর্থ হয়? যাঁরা ভোটে দাঁড়ালে বাড়ির লোকেরাও ভোট দেবেন কিনা সন্দেহ, বুঝতে পারি না তাঁদের নিয়ে এত ঝপাং-ঝপাং করা কেন? গোল্লায় গিয়েছি অনেক দিন আগেই, এ বার কি রসাতলই হবে আমাদের অনিবার্য গন্তব্য?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *