logo

টরেটক্কা, টরেটক্কা, টরে….

  • August 13th, 2022
Reminiscence, Suman Nama

টরেটক্কা, টরেটক্কা, টরে….

সুমন চট্টোপাধ্যায়

বহুদিনের জমে থাকা পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা কার্ড দেখে হৃদয়তন্ত্রিতে হঠাৎ কিঞ্চিৎ কাঁপন লাগল যেন। একদা তার রং ছিল গাঢ় হলুদ, এখন মলিন, বিবর্ণ। হাতে তুলে দেখলাম কার্ড ইস্যু হওয়ার তারিখটি জ্বলজ্বল করছে। পয়লা এপ্রিল, ১৯৮৫। সাড়ে তিন দশক আগের ব্যাপার। জীবনের বিচারে অনেকটা সময়, কালের বিচারে ক্ষণকাল।

অন্তর্হিত সেই জমানায় প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে রিপোর্টারদের হাতে এমন তিনটি কার্ড তুলে দেওয়া হত, দু’টির রং হলুদ, তৃতীয়টি সাদা। হলুদ কার্ড দু’টি ব্যবহার করে অফিসে ট্রাঙ্ককল করা যেত, সাদা কার্ডটি ছিল টেলেক্স করার জন্য। দেশের ডাক ও তার বিভাগের দেওয়া এই কার্ডগুলি যে কোনও শহরের সেন্ট্রাল টেলেক্স অফিসে গিয়ে ব্যবহার করা যেত, কোনও পয়সা লাগত না। এক বছরের মেয়াদ ফুরোলে ফের নতুন কার্ড।

আমরা সেই টরেটক্কা যুগের নাগরিক, পিছনে ফিরে তাকালে এখন প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়। রিপোর্টার হিসেবে আমাদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপের আদ্যক্ষর ছিল ‘ট’, টাইপ রাইটার, টেলেক্স, টেলিপ্রিন্টার, ট্রাঙ্ককল। টেলিপ্রিন্টারে ২৪ ঘণ্টা ধরে সংবাদ সংস্থার পাঠানো হাজারো খবর আসে, গুরুত্বপূর্ণ খবর হলে মেশিন টুংটাং আওয়াজ করে সতর্ক করে দেয়। ভিন শহরে রিপোর্টারের সবচেয়ে অপরিহার্য বন্ধু সিটিও-র টেলেক্স অপারেটর, তিনি করুণা করলে তবেই কপি যাবে। আর অফিসের সঙ্গে সংযোগের একমাত্র উপায় হলো ট্রাঙ্ককল যা আবার তিন প্রকার-অর্ডিনারি, আর্জেন্ট ও লাইটনিং। যত দ্রুত চাইবে তত বেশি খরচ। তিন মিনিট হয়ে গেলেই মহিলা অপারেটর চক্ষুলজ্জার থোড়াই কেয়ার করে সংলাপের মধ্যে শিং উঁচিয়ে অনুপ্রবেশ করবেন, ৯ মিনিট হয়ে গেলে আর কোনও সতর্কবার্তা না দিয়েই টুক করে লাইনটি কেটে দেবেন।
পাঠকের সঙ্গে সংযোগের আগের পর্বে অফিসের সঙ্গে সংযোগটাই ছিল মুশকিলের। খবর লেখা তার মানে রিপোর্টারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, পাঠানো নয়। সে জন্য তাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকেদের ওপর নির্ভর করতে হত, তাঁদের মেজাজ-মর্জি মোতাবেক পা ফেলতে হত। কোনও শহরে গেলে হোটেলের ঘরে ব্যাগটা রেখেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল সিটিও-তে গিয়ে টেলেক্স অপারেটরের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসার কাজটি সম্পন্ন করা, এমন ভাব করা যেন তাঁর চেয়ে পরমাত্মীয় কেউ নেই, কোনও দিন ছিলেনও না। সরকারি কর্মচারীরা তখনও বেশ নীতিনিষ্ঠ ছিলেন, ‘স্পিড মানি’ চেয়ে বসতেন না কথায় কথায়, আমাকে অন্তত রিপোর্ট পাঠানোর জন্য কাউকেই রিশওয়াত দিতে হয়নি। তৃষ্ণার্ত কাউকে কাউকে রাতে হোটলে ডেকে দু’পাত্র খাইয়ে দিলেই যথেষ্ট।

ভাবলে অবাক লাগে, কিঞ্চিৎ নস্টালজিয়াও হয়, প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য গতির মুখে এই ‘ট’-কারান্ত বিষয়গুলি সাংবাদিকতার আঙিনা থেকে কেমন বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। এই তো সেদিন পর্যন্ত রিপোর্টারদের সসম্মানে বলা হত ‘টাইপ রাইটার গেরিলাজ’। পণ্ডিতের প্রমাণ যেমন তাঁর টিকিতে, তেমনি রিপোর্টারের আইডেনটিটি কার্ড ছিল তার হাতে ঝোলা টাইপ রাইটার। শহরে ইতি-উতি টাইপ রাইটিং ইস্কুল ছিল, অনেকে সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে টাইপিস্টের চাকরিতে আবেদন করতেন। আমাদেরও সারাক্ষণ এই যন্ত্রটি বয়ে বেড়াতে হত কেন না আমরা বাংলা লিখতাম রোমান হরফে দু’আঙুলে টাইপ করে। বহুদিন হলো সে পাট চুকে গিয়েছে, আমার পুরোনো অলিভেতি টাইপ রাইটারের কী গতি হয়েছে, সম্যক স্মরণেও নেই। রিপোর্টাররা দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেও রোমান হরফে বাংলা লেখার চল এখন প্রায় সর্বজনীন হয়েছে। স্মার্ট ফোনের সৌজন্যে।

বছরের পর বছর আমি এ ভাবে রোমান হরফে বাংলা লিখে কাজ চালিয়েছি, বিদেশের নানা প্রান্ত থেকেও। মহা ফ্যাসাদে পড়েছি মাত্র একবার, লাহোরে। দৈত্যের মতো চেহারার এক গম্ভীর পাঞ্জাবী অপারেটরের হাতে পড়েছিল আমার কপি। কয়েকটি লাইন টাইপ করেই দেখি তিনি হাত গুটিয়ে নিলেন। আমি কাছে যেতেই বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন, ‘জনাব ইয়ে কৌনসা ল্যাঙ্গুয়েজ হ্যায়?’

বাংলা।

‘নেহি ইয়ে হাম নেহি ভেজ সকতে হ্যায়।’

‘কিঁউ?’

‘কেয়া পাতা ইসমে কেয়া লিখা হুয়া হ্যায়। আপ আংরেজিমে কপি লাইয়ে, হাম ফাটাকসে ভেজ দেঙ্গে।’
সেই দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি অপারেটরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল সে রাতে। যত বলি আমি গুপ্তচর নই, ‘আখবর কা নুমাইন্দে’, ভবি ভোলার নয়। প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর আইডেনটিটি কার্ড দেখাই, পাসপোর্টে পাকিস্তানের ভিসার পাতাটা চোখের সামনে তুলে ধরি, যুক্তি দিই গত তিন দিন এখান থেকেই আমি বাংলায় কপি পাঠিয়েছি, অবুঝ অপারেটর তবু গজর গজর করতেই থাকেন। শেষ পর্যন্ত রফা হয় কপির তলায় ইংরেজিতে আমি লিখে দেব বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার একার, অপারেটরের নয়। পাঞ্জাবী আর পাঠান, একবার মাথার পোকা নড়ে গেলে তাকে বের করে আনা বিনা অক্সিজেনে এভারেস্টে ওঠার মতো অসাধ্য।

ওয়াঘা সীমান্তের পূর্ব পাড়ে আর এক পাঞ্জাব, ভারতের। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সে রাজ্য হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল, দিল্লি থেকে আমাকে যেতে হত ঘনঘন। অমৃতসরের টেলেক্স অফিসের অপারেটর ছিলেন এক শিখ ভদ্রলোক, মিলখা সিংয়ের মতো ছিপছিপে চেহারা, স্বল্পবাক, সাইক্লোনের গতিতে টাইপ করেন। তাঁর হাতে কোনও কপি জমা দিলে তিনি প্রত্যেককে একটাই প্রশ্ন করতেন, ‘ইয়ে কেয়া পেজ ওয়ান মে জায়েগা’? এই কপিটা কি তোমার কাগজে প্রথম পাতায় ছাপা হবে? ভদ্রলোক এইটুকু জানতেন, খবরের কাগজে প্রথম পাতাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন খবর কোথায় ছাপা হবে তা স্থির করার অধিকার যে বেচারা রিপোর্টারের নেই, এই সত্যটি কেউ কখনও তাঁকে খোলসা করে বলেননি। বিলম্ব এড়ানোর তাগিদে সবাই মিছে কথা বলত, অপারেটর ভদ্রলোক আর কোনও প্রশ্ন করতেন না। ‘পেজ ওয়ান’ বললে কপি অগ্রাধিকার পাবে নচেৎ পড়ে থাকবে ট্রে-র ভিতর।

এ ভাবে একদিন রিপোর্টার মহলে সেই ভদ্রলোকের নাম হয়ে গেল ‘পেজ ওয়ান সিং’। তাঁর আসল নামটি কী তা নিয়ে কারও কোনও কৌতূহলই ছিল না। পেজ ওয়ান কাজের শেষে রাত্তিরে আমাদের হোটেলে আসতেন, পানীয়র পাত্র হাতে তিনি তখন শিখ ইতিহাসের শিক্ষক।

টেলেক্সের পরে এল ফ্যাক্স, তারপর কম্পিউটার, সবশেষে স্মার্টফোন। এই তো বছর কয়েক আগে ইতালি থেকে আমি রিপোর্ট লিখেছিলাম স্মার্টফোনেই। কী ভাবে কপি পাঠাব তা নিয়ে দুশ্চিন্তার দিন গিয়েছে, এখন দুর্ভাবনা কেবল কী পাঠাব তা নিয়ে। পোস্ট ট্রুথের বাজারে সে বড় কঠিন কাজ!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *